ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বকুলতলায় দুদিনের বর্ণাঢ্য নবান্ন উৎসব

এই হেমন্তে কাটা হবে ধান... শূন্য গোলায় জাগবে ফসলের বান

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৫ নভেম্বর ২০১৮

এই হেমন্তে কাটা হবে ধান... শূন্য গোলায় জাগবে ফসলের বান

মোরসালিন মিজান ॥ কিছুই আর আগের মতো নেই। বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে দ্রুত। ফসলের মাঠগুলো ছোট হয়ে আসছে। বিলুপ্তির পথে সনাতন মাড়াই প্রথা। গ্রাম ঢুকছে যন্ত্রযুগে। ধানের জমিতে সুরম্য অট্টালিকা উঠছে প্রতিদিন। শহুরে মানসিকতার কাছে মার খাচ্ছে গ্রামীণ মূল্যবোধ। আধুনিকতার ঠমক আর অন্যের আচারে অভ্যস্থ প্রজন্ম নিজেকে চিনতে ভুল করছে। পরিচয়ের এই সঙ্কটের কালে ফসলকেন্দ্রিক উৎসবগুলো বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে সামনে আসে। এই যেমন, আজ শুরু হলো নবান্ন উৎসব। এই হেমন্তে কাটা হবে ধান/আবার শূন্য গোলায়/জাগবে ফসলের বান...। বান এসেছে ফসলের। এখন গোলা ভর্তি ধান। মরা কার্তিক এখন জাদুঘরে শুরু হয়েছে সমৃদ্ধির অঘ্রান। আজ বৃহস্পতিবার ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। নতুন মাসের প্রথম দিন উদ্যাপিত হবে ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান উৎসবে মাতবে গ্রাম বাংলা। নতুন চালে হবে নবান্ন। ঘরে ঘরে চলবে পিঠাপুলির আয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে সারা বছরই কিছু না কিছু ফসল হয়। এর পরও নবান্ন উৎসবের আলাদা গুরুত্ব। আজ এতিহ্যবাহী আচার অনুষ্ঠানে মাতবে বাঙালী। প্রাকৃতজনের জীবন ও লোক চেতনায় উদ্ভাসিত হবে নগর। রাজধানী শহর ঢাকায়ও থাকবে নবান্ন উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। অসাম্প্রদায়িক উৎসবে যোগ দেবে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ। নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হবে নতুন প্রজন্ম। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটিই নবান্ন। সাধারণত অঘ্রানে আমন পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। ইতিহাস বলে, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। তখন থেকেই ঘরে ফসল তোলার আনন্দে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। প্রতিবারের মতো এবারও অগ্রহায়ণের শুরুতে সোনার ফসলে ভরে উঠেছে কৃষকের জমি। হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে খেলা করছে পাকা ধানের শীষ। আপন মনে হেলছে। দুলছে। দেখে মন ভরে যায়। সোনালী ফসলের দিকে তাকিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন বুনছেন কৃষক। ধান কাটার কাজও শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। লোককবির ভাষায়Ñ আইলো অঘ্রান খুশিতে নাচে প্রাণ/ চাষি কাঁচিতে দিলো শান/ কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে চাষি পাকা ধান...। নতুন এই ধান ঘরে তোলার পর আয়োজন করা হবে নবান্ন উৎসবের। বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে পায়েস রান্না করা হয়। আজ নবান্ন উৎসবের দিনে বাংলার কৃষকের ঘরে হরেক পদের রান্না হবে। এক সময় কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি করা হতো, তার কিছু হলেও দেখা যাবে আজ। তালিকায় থাকবে সব ধরনের শাক। ভর্তা ভাজি। আর পিঠাপুলি পায়েসের কথা তো বলাই বাহুল্য। আজ এর শ্রেষ্ঠ সময়। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি পায়েস হবে। ধুম পড়বে নেমন্তন্ন খাওয়া ও খাওয়ানোর। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু আনুষ্ঠানিকতাও যোগ করা হয়। হিন্দুরা নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। পার্বণ বিধি অনুযায়ী হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। কে চায় অমন পাপ করতে! অমুসলিম রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে। আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন সে নেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলি’। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। কাকবলির আগে আরও তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নিয়ম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বীরবাশের প্রথা মূলত বরিশাল অঞ্চলের। এর নিয়ম অনুযায়ী, বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। এর পর গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে বাধা হয় ধানের ছড়া। নবান্ন উৎসবে কাকবলি, লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ হয়ে গেলে সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে কেউ কিছু মুখে নেন না। বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া গ্রামে এখনও নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এবারও মহা আনন্দে উৎসব উদ্যাপন করবে বাংলার কৃষক। নতুন চালে পিঠাপুলির আয়োজন করা হবে। আছে আরও অনেক প্রাচীন রীতি। সেগুলো মেনেই হবে নবান্ন উৎসব। এখন বাংলার ঘরে ঘরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। নাগরিক জীবনে নতুন ধান বা চালের কোন অস্তিত্ব নেই। নেই বললেই চলে। রাজধানী শহর ঢাকায় বসে শুধু অনুভব করা যায়। শেকড় সন্ধানী মানুষ চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। ঘরে ঘরে উৎসব আয়োজনের সুযোগ নেই। তাই বলে খিল এটে কেউ ঘরে বসে থাকবেনÑ এমন নয়। বরং শহরে নগরে ভিন্ন আঙ্গিকে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। আজ মনের আনন্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন শেকড় সন্ধানী মানুষ। শহরজুড়ে থাকবে হরেক আনুষ্ঠানিকতা। রাজধানীতে বর্ণাঢ্য আয়োজন ॥ ঢাকায় প্রতিবারের মতোই মূল আয়োজনটি থাকছে চারুকলার বকুলতলায়। এখানে বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করবে জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ। দুই দিনব্যাপী আয়োজন আজ সকাল ৭টা এক মিনিট থেকে শুরু হবে। নয়টায় বের করা হবে নবান্ন শোভাযাত্রা। একই মঞ্চে বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত উৎসব চলবে। উৎসবে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তিসহ বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী বাঙালী সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে। একই চিন্তা থেকে রাখা হবে মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা ও পিঠাপুলির আয়োজন। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত থাকবে শিশুদের জন্য বিশেষ আয়োজন। ২২ শিশু সংগঠন বিভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে থাকবে। চলবে চিত্রাঙ্কন ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। আয়োজকরা জানান, দুইদিনের উৎসবে ৬৮ সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ প্রায় ১২শ’ শিল্পী সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশন করবেন। আয়োজকদের পক্ষে লায়লা হাসান বলেন, আমাদের আয়োজন থেকে লোক-মানসের প্রচার ও প্রকাশ ঘটানো হবে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালী উৎসবে অংশ নেবেন বলে আশা করেন তিনি। এদিকে, আজ বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত মঞ্চে আয়োজন করা হবে আরেকটি নবান্নোৎসবের। এখানেও থাকবে লোক সংষ্কৃতির নানা আয়োজন।
×