ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কার্তিকে ফুটেছে বর্ষার ফুল

হলদেটে সজীব পাতার ফাঁকে আষাঢ়ের কদম, অসময়ে স্নিগ্ধতা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

হলদেটে সজীব পাতার ফাঁকে আষাঢ়ের কদম, অসময়ে স্নিগ্ধতা

সমুদ্র হক ॥ লোকজন তো বিস্মিত। অবাক হয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে উর্ধপানে। যেখানে হেমন্তের মধ্যভাগে বিশাল ঝাঁকড়া শাখা-প্রশাখার বৃক্ষে ফুটেছে কদম ফুল। পাতাও হলদেটে সজীব। কেউ কালের মতিভ্রমের ফেরে পড়ে বলছে, এখন আ-ষা-ঢ় মাস! এ আবার কেমন আষাঢ়। তবে কী প্রকৃতির টাইম মেশিনে ফিরে এলো কোন কাল! এমন ভ্রমই হওয়ার কথা। বগুড়া নগরীর নবাববাড়ি সড়কের ধারে সার্কিট হাউসের ভেতরে দুটি এবং তার সামনে সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (ভিএম গার্লস স্কুল) ভেতরে একটি কদম (নীপবন নামেও পরিচিত) বৃক্ষে ফুল ফুটেছে। বাংলার ষড়ঋতুর পরিচিতিতে কদম বরষার ফুল। নীপবনে ফুল ফুটে আষাঢ়ের আগমন ঘটে। রূপসী তরুর মধ্যে অন্যতম কদম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন “এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে, এসো করো স্নান নব ধারা জলে...”। যে গান প্রণয়ের মানব-মানবীর কাছে খুব প্রিয়। পুরাণে আছে- নীপবনে বৃষ্টিতে ভিজে কৃষ্ণের মোহনীয় বাঁশির সুরে রাধা ছুটে আসত। পুরাণে যাই থাক, বাস্তবতা হলো, ঋতুবৈচিত্রে প্রকৃতির নিয়মে কদম ফুটবে আষাঢ়ে। শীতে পাতা ঝরবে। বসন্তে কচিপাতা (কিশলয়) গজাবে। সেই কদম যখন কার্তিক- অগ্রহায়ণে ফোটে তখন অবাক হওয়ার কথা। সার্কিট হাউসের কেয়ারটেকার জানালেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে গাছভর্তি কদম ফুল ফুটেছে। ফুলের মার্কেটের দোকানি রুবেল মিয়া বললেন, দিনাকয়েক আগে তিনি গাছে কদম ফুল দেখে অবাক হয়ে যান। বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন জানালেন, জ্যৈষ্ঠের শেষের দিকে কদম ফোটে। এর পর ভাদ্র, আশি^নে কমে যায়। ফের কার্তিকে ফোটে। এরপর ফুল কমে যায়। ফের ফোটে। এভাবে প্রায় ভর বছর কদম ফুটছে এই গাছে। এই কদম বৃক্ষটি অনেক পুরনো ও বড়। গাছের ছাল-বাকল অনেক পুরু ও ফাটল। অবাক করা আরেকটি বিষয় হলো : করতোয়া নদীর তীরে বগুড়ার জেলা প্রশাসকের অফিসের মধ্যে কদম গাছ আছে। সেখানে কোন ফুল ফোটেনি। এর কারণ কি! উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের এক অধ্যাপক তাৎক্ষণিক কারণ জানাতে পারেননি। বৃক্ষপ্রেমী সদরুল হক বললেন প্রকৃতি, ভূগঠন, আবহাওয়াগত ও জলবায়ুর পরিবর্তন এর যে কোন কারণে এমনটি হতে পারে। বিশ^জুড়ে কখন যে কি পরিবর্তন হচ্ছে। কদম অসময়ে ফুটলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কদমের বিজ্ঞান নাম এ্যানথোসিফালাস ইন্ডিকাস। ইংরেজী নাম লারান লিচহার্ডন্টপাইন। এই ফুলের বাংলা নাম অনেক। যেমন নীপ, বৃত্তপুষ্প, মেঘামপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, প্রকৃষ্য, ললনপ্রিয়, সিন্ধুপুস্প। কদমের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মালয়। কোন উষ্ণাঞ্চলেও কদম ফোটে। কদম সমান্তরাল বহু শাখাবিশিষ্ট বিশাল বৃক্ষ। বহু ফাটলে রুক্ষ। পাতা বড় ডিম্বাকৃতির। পরিণত পাতার চেয়ে কচিপাতা বড়। একটি পূর্ণ মঞ্জরি এই ফুল; যা বলের মতো গোল। পুষ্পাধারে অজস্র সরু বিকর্ণ। হলুদ ও সাদার আধিক্য বেশি। বাদুর, কাঠবিড়ালির প্রিয় খাদ্য। ওরাই বীজ ছড়ানোর বাহন। বিশেষ করে কদম ফুলের মাংসল পুষ্পাধারে ফুলের বিকর্ণ বিন্যাসে যেখানে হলুদের আধিক্য বেশি সেই অংশ পেকে গেলে তা পাখিরা খেতে থাকে। তবে কদম সবচেয়ে বেশি প্রিয় বাদুরের। এই বাদুর একগাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে যাওয়ার সময় কদমের ছোট্ট বীজ মাটিতে ফেলে দেয়। সেখানেই মানুষের অনাদরে প্রকৃতির পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে কদম বৃক্ষ। যেখানে নীপবন আছে সেখানে ফুল ফোটার সময় কাঠবিড়ালি খেয়ালেরবশে লাফিয়ে গাছের শাখা-প্রশাখায় ঘুরে বেড়ায়। যখন কদমের মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পায় তখনই কৌতূহলী হয়ে খাওয়া শুরু করে। তার পর যখন দেখে এই গোলাকৃতি ফুলের মঞ্জরির স্বাদ কিছুটা টক তখন কাঠবিড়ালি লেজ নাড়িয়ে গাপুস গুপুস খেতে থাকে। যেমনটি তারা পেয়ারা খায়। কাঠবিড়ালির এমন খাওয়া দেখে গাছের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিরা কদমের ডালে গিয়ে বসে। তারাও কদম ফুল ঠোঁটে দিয়ে স্বাদ পায়। কদমের ওপর পাখিকুল আর প্রাণিকুলের এমন ভোজন দেখে কোন এক সময় কোন ভেষজ কবিরাজ কদম ফুলকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এর পর কদম ফুলের ভেষজ গুণাগুণ প্রকাশ পায়। এর পর আজও কদম ফুলের ভেষজ গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা চলছে। কদম ফুলকে নিয়ে যাই ঘটুক বর্তমানে এই ফুল নিয়ে আরও বিষয় কৌতূহলী করে তুলেছে। তা হলো কদম ফুল কি শুধু আষাঢ়ের বা বর্ষা কালের ফুল? যদি তাই হয় তাহলে বাংলাদেশে অসময়ে তো আগে কদম ফুটতে দেখা যায়নি। এখন কেন ফুটছে! বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কদম গাছে প্রায় ভর বছর ফুল ফুটছে। হেঁটে যাওয়া দূরত্বে জেলা প্রশাসনের অফিসের ভেতরে কদম ফুল ফোটেনি। সার্কিট হাউসের ও সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরের কদম গাছে মাঝে মধ্যেই কাঠবিড়ালি দেখা যায়। এর আগে ওরা আসত বর্ষা মৌসুমে। এখন আসছে ভর বছর। পাখিরা তো বছরজুড়েই উড়ে বেড়াচ্ছে মুক্ত আকাশে। প্রকৃতির সঙ্গে বৃক্ষ ও প্রাণিকুলের কি অসাধারণ যোগাযোগ এনে দিয়েছে এই কদম ফুল।
×