ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুশফিকের বিশ্ব রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

মুশফিকের বিশ্ব রেকর্ড

মোঃ মামুন রশীদ ॥ প্রতিটা দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সমধারায় প্রবাহিত হয় না- কারণ জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ। উত্থান আর পতন থাকে প্রতি মুহূর্তেই। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বলা হয়- ফর্ম ক্ষণস্থায়ী। ব্যাট হাতে ধারাবাহিক উত্থান দেখিয়ে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ পরিচিতি পেলেও, নিজের ছন্দ পতনও দেখেছেন মুশফিকুর রহীম। তাই চাপ কমাতে মাঝে তাকে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব থেকে কয়েক টেস্টে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছিল। যদিও মুশফিকের দাবি ছিল, উইকেটের পেছনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাতেই তার ব্যাটিং অনেক ভালো হয়। সেটার প্রমাণও দিয়েছেন অনেকবার। আর এবার উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বরেকর্ডই গড়লেন। টেস্ট ক্রিকেটের ১৪১ বছরের ইতিহাসে প্রথম উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরল কীর্তি গড়েছেন। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে চলমান সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২১৯ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিক। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি এটি দেশের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসও। দেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ৫৮৯ মিনিট ও সর্বাধিক ৪২১ বল খেলার নতুন রেকর্ডও গড়েছেন মুশফিক এদিন। টেস্টে আগে ৫টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ছিল না কোন সেঞ্চুরি। সেই আক্ষেপ তিনি ভুলেছেন চলমান মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। তাই উদযাপনটা ছিল নিজের লক্ষ্যটা পূরণের আনন্দে ভরপুর। ১১১ রানে অপরাজিত থাকার সময়ে চতুর্থ উইকেটে দেশের পক্ষে ২৬৬ রানের জুটির রেকর্ড গড়েছিলেন মুমিনুল হকের সঙ্গে। দ্বিতীয় দিন নিজেকে আরও বড় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ১০৮ রান যোগ করে। আগের দিন খেলেছেন ২৩১ বল, আর দ্বিতীয় দিন খেলেছেন আরও ১৯০ বল। সবমিলিয়ে ৫৮৯ মিনিট ক্রিজে থেকে ৪২১ বল। ১৮ চার, ১ ছক্কায় ২১৯ রানে অপরাজিত থেকেই ফিরেছেন। অষ্টম উইকেটে ১৪৪ রানের নতুন জুটির রেকর্ড গড়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজের সঙ্গে। বাংলাদেশের হয়ে অষ্টম জুটিতে আগের রেকর্ডেও ছিল মুশফিকের নাম। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে নাঈম ইসলামের সঙ্গে মিলে তুলেছিলেন ১১৩ রান। মুশফিক মিরপুরে সেঞ্চুরি না থাকার আক্ষেপ ভুলেছেন ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। এতে করে পৌঁছে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের ডাবল সেঞ্চুরির সংখ্যা ৪টি। ২০১৩ সালে মুশফিকের ২০০, ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তামিম ইকবালের ২০৬ এবং ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাকিব আল হাসানের ২১৭ এর পর আবার মুশফিক দ্বিশতক পেলেন। কিন্তু তিনিই প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির মালিক হয়েছেন। দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটিই ছিল তার নিজের প্রথম দ্বি-শতক। ২০১৩ সালের মার্চে গল টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কাঁটায় কাঁটায় করেছিলেন ২০০। এবার দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত টেস্ট ইনিংস উপহার দিলেন। গত বছর জানুয়ারিতে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের করা ২১৭ রান ছিল এতদিন দেশসেরা ইনিংস। এখন সবার ওপরে মুশফিক। তাছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘতম ইনিংস খেলার রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বল খেলার রেকর্ডও গড়েছেন। এর আগে ৫৩৫ মিনিট খেলে দেশের দীর্ঘতম ইনিংস ছিল বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে (নবেম্বর, ২০০০) ১৪৫ রান করা আমিনুল ইসলাম বুলবুলের। সবচেয়ে বেশি বল খেলেছিলেন ২০১৩ সালে গল টেস্টেই ৪১৭ বল খেলে ১৯০ রান করা মোহাম্মদ আশরাফুলের। আর মুশফিকের ব্যক্তিগত দীর্ঘতম ইনিংস ছিল ৪৩৭ বল ও ৩২১ মিনিটের। এই ডাবল সেঞ্চুরির আগে মুশফিকের ৯টি ইনিংস খুব বাজে কেটেছিল। ৩১ বছর বয়সী এ ব্যাটসম্যান মাত্র ১৫.০০ গড়ে করেছিলেন ১৩৫ রান, সর্বোচ্চ ছিল ৩১! এরও আগে বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হতে ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে চরম ব্যর্থ ছিলেন মিডল অর্ডারের এ নির্ভরতা। ১৯ ইনিংসে মাত্র ২টি ফিফটিসহ ২২.৯৪ গড়ে করেছিলেন সে সময় মাত্র ৪১৩ রান। দলের অন্যতম নির্ভরতার প্রতীক হয়েও এটি ছিল দলের জন্য বেশ বাজে। তাই একই সঙ্গে টেস্ট নেতৃত্ব, উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব ও ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে দায়িত্বের চাপ থেকে মুক্তি দিতে তাকে ১২ টেস্টে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো থেকে। কিন্তু উইকেটরক্ষক হিসেবেই এবার বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। সিকান্দার রাজার করা বলটি স্কয়ার লেগে ঠেলে দিয়েই প্রয়োজনীয় একটি রান নিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যান মুশফিক। রাজা যেমন ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিলেন, তেমনি জিম্বাবুইয়ের বোলিং দশাকে হতশ্রী করেছেন মুশফিক। টেস্ট ইতিহাসে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে এ নিয়ে মাত্র ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি দেখা গেছে। কিন্তু ইতিহাসের প্রথম উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন তিনি। এছাড়া শুধু একজন উইকেটরক্ষকেরই সুযোগ ছিল দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানোর। এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ১৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন। দলের ইনিংস গুটিয়ে যাওয়াতে তার সেই ডাবল সেঞ্চুরিটি হয়নি। আর ভারতের বুধি কুন্দেরান ১৯২ রানে সাজঘরে ফিরেছিলেন ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে। এছাড়া ম্যাচে উইকেটরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আর কেউ ১৯০ এর ঘরে ইনিংস খেলতে পারেননি। ফলে দুটি ডাবল সেঞ্চুরির কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেননি কেউ। নিজ দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড দুইবার গড়ে মুশফিক ঢুকে গেছেন ছোট্ট এক তালিকায়। গল টেস্টে তার ২০০ রানও ছিল সে সময় দেশের পক্ষে সেরা ব্যক্তি ইনিংস। আবারও তিনি সেরা হয়েছেন। টেস্ট ইতিহাসে এই কীর্তি গড়তে পেরেছেন আগে কেবল পাঁচজন- অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র্যাডম্যান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হ্যাডলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, ভারতের ভিনু মানকড় ও বীরেন্দর শেবাগ। হাতছানি ছিল আরও দু’টি দারুণ রেকর্ডের। টেস্টে কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড জিম্বাবুইয়ের এ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে নাগপুরে অপরাজিত ছিলেন ২৩২ রানে। আর মিরপুরের সর্বোচ্চ ছিল ২০১৫ সালে পাকিস্তানী ওপেনার আজহার আলীর ২২৬ রান। এবার দল ইনিংস ঘোষণা করে দেয়ায় মুশফিককে থামতে হলো ১৩ রান দূরে।
×