ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টে ফাটল ধরার ইঙ্গিত!

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টে ফাটল ধরার ইঙ্গিত!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিএনপি শীর্ষ নেতাদের ঐক্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলপ্রধান কারাবন্দী খালেদা জিয়া। সোমবার বিকেলে কারাগারে দলের নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি এ নির্দেশ দেন। যখন বিএনপি প্রধান এ নির্দেশ দিলেন তার ঠিক দু’ঘণ্টা আগে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল অসুস্থ থাকায় মতিঝিলে ডাকা নতুন এই রাজনৈতিক মোর্চার স্টিয়ারিং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। নানা নাটকীয়তা শেষে বরিবার ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট পৃথকভাবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। ঠিক পরদিন প- হলো বৈঠক! এর আগে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ঐক্যফ্রন্টে রাজশাহীর সমাবেশে যোগ দেননি কামাল হোসেন। শুধু তাই নয়, ফ্রন্টের প্রথম সভা হয়েছিল সিলেটে। সেখানে কামাল হোসেন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাননি। বক্তব্য শেষ করে যখন চলে আসছিলেন তখন বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদার মুক্তির বিষয়ে কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এরপর তিনি মুক্তির দাবি জানান। তাছাড়া আন্দোলন সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি যখন কামাল হোসেনের কাছে শেষ আশ্রয় নিয়েছে তখন কা-ারিই বলছেন তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান না! তাহলে প্রশ্ন হলো, কী হচ্ছে ঐক্যফ্রন্টে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সব সময় সুবিধাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কামাল হোসেন। এমন বাস্তবতায় বিএনপি তাকে কতটুকু বিশ্বাস করবে তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় ঐক্যের কথা কামাল হোসেন বলে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপির কাছে তার ঐক্যের ঠাঁই হয়েছে। এখন তিনি কোন পথে ঐক্যেকে এগিয়ে নেবেন তাই দেখার বিষয়। নির্বাচনমুখী হওয়ার পর বিএনপি, জেএসডি ও গণফোরামের পক্ষ থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়েছে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত কামাল হোসেন কোন আসন থেকেই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেননি। ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক নাগরিক ঐক্যের মাহামুদুর রহমান মান্নাও কোন দল থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেননি। নিজের দল নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন না পাওয়ায় তিনি কোন দল থেকে মনোনয়ন কিনবেন তাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের কোন দল নেই। তিনিও কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন তা পরিষ্কার হয়নি। ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের বেহাল দশার মধ্যে সামনে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে তারা কতটুকু গুরুত্ব পাবে তাই এখন দেখার বিষয়। ১৩ নবেম্বর বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা দেয় কামাল হোসেন। রাজনীতিতে নতুন করে চমক আসে নতুন এই রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের মধ্য দিয়ে। বিএনপিও কিছুটা হাফ ছেড়েছে কামাল হোসেনসহ অন্যদের ওপর ভর করে। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে ঐক্যফ্রন্টে পথচলা কতটুকু মসৃণ থাকবে এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনীতির ময়দানে। কামাল হোসেনকে নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করেছে অবিশ্বাসের। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে ১৪০টি আসন দাবি করা হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের দাবি দাওয়া তো রয়েই গেছে। গণফোরাম, জেএসডির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপি ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে ১০ জনও যোগ্য প্রার্থী নেই। যাদের মনোনয়ন দিলে পাস করে আসার নিশ্চয়তা আছে। ড. কামাল হোসেনেরও ভোটের মাঠে গ্রহণযোগ্য একেবারেই তলানিতে। ডেএসডির আসম আবদুর রবের মাঠের গ্রহণযোগ্য কতটুকু তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ রাজনীতিতে নামমাত্র টিকে আছে। মাহামুদুর রহমান মান্না ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের তো কোন দলই নেই। এই প্রেক্ষাপটে আসন নিয়ে দর কষাকষিতে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের অবস্থান বিএনপির কাছে একেবারেই থাকবে না বলে মনে করছেন তারা। বিএনপির একাধিক নেতা বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের ওপর ভর করে মূলত বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট নিজেদের দাবি দাওয়া যতটুকু সম্ভব আদায় করেছে। নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতেও তারা আন্দোলনমুখী। সামনের দিনগুলোতে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির কাছে কামাল হোসেন ছাড়া ফ্রন্টের নেতারা খুব একটা পাত্তা পাবেন না। তাছাড়া ১০ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এমন বাস্তবতায় দলের সব নেতাই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের বাদ দিয়ে ফ্রন্টের নেতাদের মনোনয়ন দিলে দলের মধ্যে বিভক্তি আরও বাড়বে। যা বিএনপির জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। যদিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শীর্ষ নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন কামাল হোসেন। ৫ বছর আগে যে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল, সেই বিএনপি আজ কার্যত তার ওপর ভর করেই নির্বাচনে যাচ্ছে। অথচ তিনিই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। নির্বাচনী আয়োজনে অনুঘটকের কাজ করলেও নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়টি বিএনপিকে ভাবিয়ে তুলছে। তার মানে ঐক্যের মধ্যে নতুন করে ফাঁটল ধরল কিনা এ নিয়ে ভাবনা অনেকের মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বড় ভূমিকা পালন করবেন কামাল হোসেন। সেখানে যদি নিজের দল ও শরিকদের জন্য ভাল কিছু অর্জন করতে না পারেন তাহলে কামাল হোসেনের হাতে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং আদৌ থাকবে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, বি চৌধুরী, আসম রবসহ অনেক নেতা জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেছে সবারই পথ ভিন্ন। জোটের আর পাত্তা নেই। তাই রাজনৈতিক সমীকরণে এবারের জোটেও কামাল হোসেনের স্থায়িত্ব কত সময় পর্যন্ত তা হয়ত সময়ই বলে দেবে। সোমবার আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না জানিয়ে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমার নির্বাচনে অংশ নেয়া বড় কথা নয়। দেশে ভারসাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠা পাক। আমরা একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে আসছি। নির্বাচনে কে হারল, কে জিতল সেটা বড় কথা নয়, দেশের মালিক জনগণ, তারা যেন নিজেদের পছন্দ মতো ভোট দিতে পারে সেটাই বড় কথা। কী কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না তা উল্লেখ করলেও, বয়স এবং শারীরিক অসুস্থতার বিষয়েই ইঙ্গিত দেন ড. কামাল। যদিও আগেই নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে জানিয়েছিলেন তিনি। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপকভিত্তিক যে বিরোধী রাজনৈতিক জোট গঠন হয়েছে, তার শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি এটিকে রাজনৈতিক জোট উল্লেখ না করে বলেছিলেন, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই একজোট হয়েছেন। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বেই বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় রাজনীতির চিত্রও বদলে গেছে। দলের নেতারা জানিয়েছেন, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফলে মতিঝিলে তার চেম্বারে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক থাকলেও সেটি বাতিল করা হয়েছে। ড. কামালের ব্যক্তিগত চিকিৎসক এই মুহূর্তে তাকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, ‘ড. কামালের হাতে ও পায়ে ব্যথা। তার শরীরে জ্বরও রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডায়রিয়া। তিনি জানান, দলীয় নেতারা মিলে দুপুরে কামাল হোসেনের বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থ থাকায় আর কথা হয়নি।
×