ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে দরকার শেখ হাসিনা সরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৩ নভেম্বর ২০১৮

যে কারণে দরকার শেখ হাসিনা সরকার

অস্কারপ্রাপ্ত বাঙালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘হীরক রাজার দেশে’-তে প্রজাবিমুখ অত্যাচারী রাজার কাছে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-শিক্ষক কারও মূল্য ছিল না। কৃষক তার শস্যের ন্যায্য দাম চেয়ে পেত না, শ্রমিক তার শ্রমের দাম পেত না, ছাত্র-শিক্ষক পেত না শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। এগুলো চাইতে গেলে কপট বিজ্ঞানীর পরামর্শে রাজা পেয়াদাকে আদেশ দিতেন, নিয়ে যাও এরে, যন্তর-মন্তর ঘরে। উদ্দেশ্য মগজ ধোলাই। সেই যন্তর-মন্তর ঘরে যন্ত্র চালানো হতো আর তাদের শেখানো হতো নানান শ্লোক- ‘কম খেলে নাহি ক্ষেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ’/ ‘যে করে খনিতে শ্রম, জেনো তারে ডরে যম’/ ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে শিক্ষক ব্যতীত সবাই সব জায়গায় বলে বেড়াতো এসব শ্লোক। যন্তর-মন্তর ঘরে মগজ ধোলাইয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কেবল রাজার জয়গান। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ১৯৭১-এ ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন হবার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে টেনে তুলে গঠন করার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন তাঁর এ দেশ-গঠনকে থামিয়ে রাষ্ট্রকে ধাক্কা দিয়ে পশ্চাতে ঠেলার মানসে তাঁকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করার পর সামরিক জান্তা জিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানী ভাবধারার যে সরকার আসে, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালী জাতির মগজ ধোলাই। জিয়া জানতেন, কোন ব্যক্তি বা জাতি যদি গ্রীক মনীষী সক্রেটিসের দশহড়ি ঃযুংবষভ’ অনুসরণে নিজের অমিত শক্তি সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারে, তাহলে তার যথাযথ প্রয়োগে সে পিছপা থাকবে না। জাতি নিশ্চয় পৌঁছাবে উন্নতির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। তাই জাতিকে আত্মভোলা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুছে দিলেন আমাদের ‘জাতীয়তা বাঙালী’। তদস্থলে অন্যকিছু না লিখলেও রাজনৈতিক প্রপাগা-া হিসেবে চালু করলেন, আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। জিয়া তাঁর অশ্রয়দাতা ও জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ও পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় দিয়ে নতুন টোপ ফেললেন জনগণের মাঝে। জিয়া জনগণকে দেখালেন তাঁর ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙ্গা স্যুটকেস, আর গ্রামে-গ্রামে হাঁটলেন ধুলা-কাদার মধ্যে। এই ভেলকিবাজিতে আর যন্তর-মন্তরে ভুলে গেল জনগণ। বলতে থাকল, আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেল নিজেকে, নিজের আত্মপরিচয়কে, নিজের বাঙালী জাতীয়তাকে। নিজকে না-জানা বাঙালী জাতি চলতে শুরু করল নিরুদ্দেশ যাত্রায়, ভাসতে থাকল অজানা গন্তব্যের পানে, যেমনটি বৈঠাবিহীন নৌকা ভাসতে থাকে সমুদ্রে। এই পথভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট জাতিকে ‘হীরক রাজার দেশে’-র শিক্ষকের মতো অজানা পথ থেকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে দীর্ঘ সাত বছরের বিদেশে-নির্বাসিত-জীবন থেকে অমিত সাহস নিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন যে শিক্ষক, তাঁর নাম শেখ হাসিনা, যিনি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ও বিপ্লবী রক্তের যোগ্য উত্তরসুরি। বাঙালী জাতীয়তাবাদী আদর্শ শিক্ষা দিয়ে ও প্রচার করে তিনি শোনালেন অমিত সাহসী বাণী, তুমি কে, আমি কে, বাঙালী-বাঙালী। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পট-পরিবর্তনের পর সুকৌশলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে নেন জিয়াউর রহমান। দেড় মাস পর ১৯৭৬-এর ২৬ সেপ্টেম্বর সেনাশাসক জিয়া পকেটস্থ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাককে দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করান, যার মাধ্যমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। অতঃপর জিয়া অবৈধ ও অসাংবিধানিক পথে রাষ্ট্রপতি হবার পর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানসম্মত করেন। সেই সঙ্গে উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের বিধান ‘বাঙালী’ জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলেন। তাঁর প্রধান চাতুরিপূর্ণ কৌশল ছিল একথা প্রচার করা যে, আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালী’ নয়। অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাঙালীরা তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার চর্চার মাধ্যমে প্রাণ-রক্ত-সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে ছিনিয়ে আনে এদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা লাভের পর বাহাত্তরের সংবিধান ছিল মূলত পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদী সনদ। পাক-আমলের সমস্ত বাঙালী-বঞ্চনা ও বৈষম্যের নিরিখে সমতা, মানব-মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রতিফলন ছিল বাহাত্তরের সংবিধান। অথচ এই বাহাত্তরের সংবিধানকে কতই না কাটা-ছেঁড়া করেছেন দুই সামরিক জান্তা জিয়া ও এরশাদ। এভাবে বাঙালী জাতিকে বিপথগামী ও লক্ষ্যভ্রষ্ট করে পাকিস্তানীকরণে তাদের চেষ্টার অন্ত থাকেনি। ‘বাংলাদেশ বেতার’-কে ‘রেডিও পাকিস্তানের’ আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা, আর বাঙালীর প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’-কে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদের’ আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করা তারই প্রমাণ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ একুশ বছর ছিল তাই বাঙালীর গ্লানিপূর্ণ কাল। অতঃপর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালীর ঘুরে দাঁড়াবার পালা। জনগণের ম্যা-েট নিয়ে তাঁর প্রথম দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে সম্পন্ন হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিচার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছিল ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতিতে আবেগাপ্লুত বাঙালী জাতি আবারও ম্যান্ডেট দেয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে। প্রতিশ্রুতি পূরণে ২০১০ থেকে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আর ২০১১-তে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। মুছে দেওয়া বাঙালী জাতীয়তাবাদকে বত্রিশ বছর পর ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৬ ও ৯ অনুচ্ছেদে পুনঃস্থাপিত করলেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এ যেন রাক্ষসের হাতে পর্যুদস্ত পিতার হারানো রাজ্য ও প্রজাদের পুনরুদ্ধার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আর বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা ব্যাপকভাবে চললেও শতভাগ সম্পন্ন হয়নি এটি চলমান রয়েছে। তবে জাতি এখন অনেকখানিই চিনতে পারছে নিজেকে। তারই ফলশ্রুতি পরপর পাঁচ বছর জিডিপির হার ৬.৫-এর ওপরে, যা বর্তমানে ৭.৮৬। জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, পদ্মাসেতুর ৭১% অগ্রগতি, প্রতিবছর ১ জানুয়ারি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব, নি¤œ-মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ইংল্যা--আমেরিকার মতো উন্নত দেশে পরিনত হওয়ার ভিশনসহ অন্তত চল্লিশটি খাত। এমতাবস্থায় আসন্ন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে বাঙালী চেতনার জাতিস্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাপের লেজে আঘাত করে ছেড়ে দিলে যেমন সে আরো ছোবল মারতে থাকে, তেমনি বর্তমানে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হবার প্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধীদের দল বিএনপি ও জামায়াত ভয়ঙ্কর গর্জনরত। পাকিস্তানী চেতনা প্রায় বিলীন হবার দরুন তারা শোকাহত বাঘিনীর ন্যায়। এতটুকু সুযোগ পেলে তারা বাঙালী জাতিকে ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে ছোবল মারবে, কামড়ে ছিন্নভিন্ন করবে। তাতে দেশ ও জাতি আবারও পড়বে পঙ্কিল গর্তে, যেখান থেকে ভিশন ২০৪১-এ উত্তরণ আর সম্ভব হবে না। সেই সঙ্গে তারা শুরু করবে আবারও সংবিধানের কাটাছেঁড়া, আবারো সংবিধান থেকে ‘বাঙালী’ জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলে পাকিস্তানীকরণে যাত্রা। তাই বাঙালী চেতনার জাতিস্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের তথা বাঙালী জনগণের পুনঃম্যান্ডেট ও পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠান সময়ের এক সুমহান দাবি। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন ধরে রাখতে বাঙালীকে তাই আবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পতাকা তলে এক হয়ে স্লোগান তুলতে হবে ‘শেখ হাসিনা এগিয়ে চলো/ আমরা আছি তোমার সাথে’। লেখক : সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
×