ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুকতি মজুমদার স্মরণে সাংস্কৃতিক আয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১২ নভেম্বর ২০১৮

 মুকতি মজুমদার স্মরণে  সাংস্কৃতিক আয়োজন

গৌতম পান্ডে ॥ মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে সম্মেলক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ও ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে ওই বাজে’। শিল্পীরা প্রাণবন্ত হয়ে গাইছেন, শ্রোতারা নিবিড়চিত্তে শুনছেন আর বারবার অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কারণ অনুষ্ঠানে যারাই উপস্থিত ছিলেন অধিকাংশ তারই হাত ধরে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শিখেছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন। তিনি হলেন অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার। খুলনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের মানসকন্যা বলে পরিচিত। রবীন্দ্রদর্শন ধারণ করা যে গুটিকয়েক মানুষ বাংলাদেশে জাজ্বল্যমান তাদের মধ্যে অন্যতম মুক্তি মজুমদার। প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী থেকেও সকলের কাছের প্রাণের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিপরীতে মননশীল প্রয়োগের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো ঋজু অথচ বিশাল, সঙ্গীতের মতো সরল অথচ প্রগাঢ়, ছোটগল্পের মতো দুরন্ত অথচ ঝর্ণার মতন সেই মুক্তি মজুমদার। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান, মুক্তচিন্তা, উদার ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব সুধী মহলে বিশেষভাবে পরিচিত। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি ছিলেন আপোসহীন, দৃঢ় ও নির্ভিক। খুলনার মূলধারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পরিবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে গান, কবিতা আর স্মৃতি কথায় তাকে স্মরণ হয়। তার তৃতীয় প্রয়াণ বার্ষিকী উপলক্ষে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ শিরোনামে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন দখিন দুয়ার। অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রাহুল রাহা, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব রুদ্র, জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় ও ডালিয়া রহমান প্রমুখ। শুরুতে শিক্ষাগুরু অধ্যাপক মুক্তি মজুমদারের প্রতিকৃতিতে পুষ্প অর্পণ ও মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। পরে সংগঠনের শিল্পীদের পরিবেশনায় ছিল পরপর দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ এবং ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে’। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কৃষ্ণ সেন, অদিতি সেন, বর্ষা রাহা, আনন্দময়ী মজুমদার, দীপ্র, সাগরিকা জামালী, জান্নাতুল ফেরদৌস লাকী, অশোক ম-ল, নিহার হাওলাদার, কাজী শিলা, বাবু সরকার ও মুসা কলিম প্রমুখ। আবৃত্তি করেন সাজেদুর রহমান সজল, আতিকুজ্জামান মির্জা ও মঞ্জুরুল আলম পান্না। অধ্যাপক মুক্ক্তি মজুমদার ১৯৩৮ সালের ২৮ নবেম্বর খুলনার মহেশ্বরপাশায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম এ করেন। তার পিতা সুবোধচন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনবিদ ও শিক্ষাবিদ। সুবোধচন্দ্র একাধারে বেহালা, সেতার, বীণা, পাখোয়াজ, তবলা, হারমোনিয়াম, বাঁশি, এস্রাজ জানতেন। কলকাতার সঙ্গীত একাডেমিতে গিয়ে তালিম নিয়েছিলেন। সেইসব আবার শিখেছিলেন তার ছেলেমেয়েরা। যোগ্যপিতার যোগ্যকন্যা হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন দর্শনের অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে যে সুকঠিন সংগ্রাম, তাতে উজ্জীবিত করেছেন শত শত তরুণকে। গ্রামের প্রান্ত মানুষগুলোর কাছে অধ্যাপিকা মুক্তি মজুমদারের গৃহকোণ আরণ্যক ছিল নিজের আলোর ঠিকানা। জীবনের শেষ দিনগুলোতে আরণ্যকে বৃক্ষরাজি, ফুল আর পাখীরাই ছিল তার নিকটজন। কি দিয়েছেন-বিলিয়েছেন, কি পেলেন তার প্রতিদান, সে চিন্তার সঙ্কীর্ণতা স্পর্শ করতে পারেনি কখনও। তাই মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপিকা মুক্তি মজুমদার ভিন্ন ও অনন্য। অনুষ্ঠানের মুখবন্ধ ও সঞ্চালনা করেন দখিন দুয়ারের আহ্বায়ক আবদুস সবুর খান চৌধুরী।
×