ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্পটের যাঁতাকলে শেয়ারবাজার

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১১ নভেম্বর ২০১৮

স্পটের যাঁতাকলে শেয়ারবাজার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ স্পট মার্কেটের যাঁতাকলে পিষ্ট দেশের শেয়ারবাজার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় শেয়ারবাজারের লেনদেন আগের তুলনায় কমেছে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক আচরণে শেয়ার কেনা-বেচার পরিমাণ কমেছে। সেই সঙ্গে স্পট মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের নগদ টাকায় শেয়ার কেনার বাধ্যবাধকতার কারণে লেনদেনের পতনকে তরান্বিত করেছে। কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে স্টক একচেঞ্জগুলোও এই বিষয়ে উদাসীন। সম্প্রতি দরবৃদ্ধি পাওয়া কয়েকটি কোম্পানিকে স্পট মার্কেটে পাঠানোর পর তা প্রত্যাহার করা হয়নি। সেই সঙ্গে জুন ক্লোজিংয়ের লভ্যাংশ ঘোষণার পর রেকর্ড ডেট সংক্রান্ত স্পট মার্কেটেও বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিদিনই লেনদেন হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে স্পটে নগদ টাকার লেনদেনের কারণে শেয়ারবাজারের ওপর কিছুটা নগদ তারল্যেও চাপ বাড়ছে। ফলে লেনদেনেও কিছুটা গতি হারাচ্ছে শেয়ারবাজার। তাই বাজারের লেনদেন বাড়ানোর জন্য স্পট মার্কেটে কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত বাজারে ফেরানোর দাবিও উঠছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। জানা গেছে, গত কয়েক মাসের তুলনায় শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ¯œায়ুচাপে ভুগছেন বিনিয়োগকারী। সবাই ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। সেইসঙ্গে শেয়ারবাজারে একটি পক্ষের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ানোর কারণে সূচকও কমছে আশঙ্কাজনক হারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবির যেমনটি সাপোর্ট দেয়ার কথা কিন্তু এখন পর্যন্ত বাজারে তা অনুপস্থিত। উল্টো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আইসিবির বন্ড অনুমোদন ও ঢাকা স্টক একচেঞ্জের কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির টাকা কর ছাড়ের পর ট্রেকধারীদের কাছে জমা হলেও শেয়ার কেনার হার বাড়েনি। তাই বাজারে এক ধরনের তারল্য সঙ্কট স্পস্ট হয়ে উঠছে। সেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্পট মার্কেটে কিছু কোম্পানির বাধ্যতামূলক শেয়ার কেনা-বেচার নির্দেশ আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো শামিল হয়েছে। স্টক একচেঞ্জ ও বিএসইসির ওয়েববসাইট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, বিডি অটোকার ও মুন্নু জুট স্টাফলারের লেনদেন স্থগিত করে। অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির কারণে কোম্পানিগুলোর লেনদেন স্থগিতের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯ আগস্টে তা কার্যকর হয়। একইদিনে কমিশনের পক্ষ থেকে মুন্নু সিরামিক, কে এ্যান্ড কিউ, আজিজ পাইপ, স্টাইলক্রাফট এবং ড্রাগন সোয়েটারের লেনদেন স্পট মার্কেট নিষ্পন্নের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এটিও গত ১৯ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়। এরপর থেকেই কোম্পানিগুলোর লেনদেন স্পট মার্কেটে চলছে। পরবর্তীতে ৯ সেপ্টেম্বর ড্রাগন সোয়েটারের লেনদেন মূল মার্কেটে ফেরানো হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানিগুলোর লেনদেন স্থগিতের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়। একইসঙ্গে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার এবং বিডি অটোকারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির তদন্ত শেষে স্পট মার্কেটে লেনদেনের সিদ্ধান্ত দেয়া হয় গত ৩ অক্টোবর। পরবর্তীতে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের লেনদেনও স্পট মার্কেটে স্থানান্তর করা হয়। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লেনদেন বন্ধের আগে গত ছয় মাসে ডিএসইতে বিনিয়োগকারীদের চাহিদার শীর্ষের কোম্পানিগুলোর অন্যতম ছিল লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, বিডি অটোকার, মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু জুট স্টাফলার্স। একইসঙ্গে ড্রাগন সোয়েটার, স্টাইলক্রাফট ও আজিজ পাইপেরও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। শেয়ারবাজারের টানা পতনের মধ্যেও বিনিয়োগকারীদের চাহিদার শীর্ষে ছিল কোম্পানিগুলো। সর্বশেষ ঘোষণা অনুসারে জুন ক্লোজিং এই কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগেরই কর্পোরেট ঘোষণা আগে তুলনায় বেড়েছে ঈষর্ণীয়ভাবে। সেইসঙ্গে বেড়েছে লভ্যাংশ প্রদানের হারও। যার কারণে বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ বেড়েছে কোম্পানিগুলোকে ঘিরে। কিন্তু স্পট মার্কেটের বাধ্যবাধকতার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে শেয়ারগুলো। নগদ টাকার লেনদেনের কারণে ইচ্ছা থাকলেও কেউ অন্য শেয়ার বিক্রি করে এই শেয়ারগুলো কিনতে পারছেন না। সেই সুযোগ নিচ্ছেন বড় বিনিয়োগকারীরা। লভ্যাংশ ঘোষণার হার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুন ২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিডি অটোকারের পরিচালনা পর্ষদ ৩ শতাংশ নগদ এবং ১২ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। একইসঙ্গে কোম্পানিটি এলপিজি ব্যবসায় আসতে রাইট শেয়ার ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগের বছর কোম্পানিটি ৩ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। ৩০ জুন ২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের পরিচালনা পর্ষদ ৫ শতাংশ নগদ এবং ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। গতবছরে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২.০১ টাকা। আগের বছর কোম্পানিটি ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করেছিল। কোম্পানিটি দেশের বাজারের জন্য কোম্পানির উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছে। মুন্নু সিরামিকের পরিচালনা পর্ষদ ৩০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের বছরে কোম্পানিটি ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। মুন্নু স্টাফলারের পরিচালনা পর্ষদ ৩৫০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ করেছে। আগের বছর কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটির আয়েও বড় উত্থান দেখা গেছে। দরবৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ও মুনাফায় বড় উত্থানের কারণেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি ছিল। কিন্তু লভ্যাংশ ঘোষণার পরও স্পট মার্কেটে লেনদেনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নগদ টাকার অভাবে কেউ শেয়ার কিনতে পারছেন না। সেই কারণে মূল মার্কেটে ফেরানোর দাবি উঠেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে। বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত, নির্বাচনের আগে শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে স্পটের কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফেরানো উচিত। কারণ ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া সব কোম্পানিই জুন ক্লোজিং কোম্পানি। এই সব কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের কারণে প্রতিদিনই কিছু কোম্পানির এই মার্কেটে লেনদেন হচ্ছে। তাই শাস্তিমূলক স্পটের কোম্পানিগুলোকে মূল বাজারে ফেরানো উচিত।
×