ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত বয়ান ‘লালজমিন’

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১১ নভেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত বয়ান ‘লালজমিন’

সাজু আহমেদ ॥ বাংলাদেশী বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম প্রধান গৌরব উজ্জল অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের যে বিশেষ কয়েকটি কারণে স্মরণ করা হয় তার মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে এই মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ বীরের রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। যেখানে অসাধারণ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর বাংলাদেশের আরও ২ লাখ নারী। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ঠিক প্রত্যাশিতভাবে উঠে আসেনি। তবে আশার কথা বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাস উঠে এসেছে অনেকটা সাবলীল ও সমৃদ্ধভাবে। বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে বলা হয় বিশ্বমানের। যাকে অনেকটা ঋদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভিত্তিক বিভিন্ন নাট্য প্রযোজনা। এমনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি মঞ্চনাটক সম্প্রতি বেশ আলোচনায় এসেছে। আর সেটি হলো শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের ‘লালজমিন’। ‘লালজমিন’ নাটকটির গল্প মুক্তিযুদ্ধের একটি খ-চিত্রের বয়ান। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন কিশোরীর অংশগ্রহণ, গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা, মেয়েটির ত্যাগ-সবশেষে স্বাধীনতা অর্জন দর্শকদের এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘লালজমিন’। ‘লালজমিন’ কিশোরীর রক্তরাঙা অভিজ্ঞতার মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর এক নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্য প্রকাশ। ‘লালজমিন’ নাটকটি তের পেরিয়ে চৌদ্দ বছর ছুঁই ছুঁই এক কিশোরী কন্যার গল্প। কিশোরীর দু’চোখ জুড়ে মানিক বিলের আটক লাল পদ্মের জন্য প্রেম। সে কৈশোরেই শোনে বাবা-মায়ের মধ্যরাতের গুঞ্জন। শুধু দু’টি শব্দ কিশোরীর মস্তকে আর মনে জেগে রয়, মুক্তি-স্বাধীনতা। ওই বয়সে কিশোরী এক ছায়ার কাছ থেকে প্রেম পায়। বাবা যুদ্ধে চলে যায়। অগোচরে কিশোরী নানা কৌশলে যুদ্ধে যাওয়ার আয়োজন করে, সশস্ত্র যুদ্ধ। কিন্তু বয়স তাকে অনুমোদন দেয় না। এক পর্যায়ে কিশোরীর সেই ছায়াপ্রেম সম্মুখে দাঁড়ায়। সে তার সেনাপতিকে চিনতে পারে। তারপর যুদ্ধ যাত্রা। লক্ষে পৌছুবার আগেই পুরুষ যোদ্ধারা কেউ শহীদ হোন, কেউ নদীর জলে হারিয়ে যান। পাঁচ যুবতীসহ যুদ্ধযাত্রী এই কিশোরীর জীবনে ঘটে নানা অভিজ্ঞতা। চৌদ্দ বছরের কিশোরীর ধবধবে সাদা জমিন যুদ্ধকালীন নয় মাসে রক্তরাঙা হয়ে ওঠে। ‘লাল জমিন’ কিশোরীর রক্তরাঙা অভিজ্ঞতার মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর এক নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্য প্রকাশ। দেশের বরেণ্য নাট্যাভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরীর প্রাণবন্ত অভিনয় নাটকটি নিমিষেই দর্শকদের আকৃস্ট করে। নাটকে চরিত্রানুযায়ি কণ্ঠের সুক্ষœ কাজ যেমন দেখিয়েছেন তেমনি কোরিওগ্রাফিতে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছেন গল্পের বুনুনিতে। নাটকের পোষাক, সেট, আলো সবই যেন মোমেনা চৌধুরিকে নিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে। মঞ্চে মোমেনা চৌধুরী যেন হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্বাক্ষী । ‘লালজমিন’ নাটকটি বেশ কয়েকটি কারণে দর্শকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলেছে। প্রথমত এটি মুক্তিযুদ্ধের নাটক। দ্বিতীয়ত এটি একটি মনোড্রামা বা একক অভিনেয়র প্রযোজনা। তৃতীয়ত নাটকটিতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পী মোমেনা চৌধুরী। প্রখ্যাত নাট্যকার মান্নান হীরার রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন এই প্রজন্মের জনপ্রিয় নাট্য নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী যা নাটকের চমতকারিত্বের অন্যতম অনুষঙ্গ। সব মিলিয়ে নানা উজ্জলতায় মঞ্চে আলো ছড়িয়েছে ‘লাল জমিন’। দেশে বিদেশে অসংখ্য মঞ্চায়ন সাফল্যে অনেকটাই উচ্ছ্বসিত নাটকের অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী। তিনি বলেন শুরু থেকে নাটকটির প্রতি দর্শকদের আমাদের পথচলাকে করেছে গতিময়। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে যারা আমাদের ‘লালজমিন’ নাটকটি প্রদর্শন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি আরণ্যক নাট্যদলের কাছে। আর আমাদের সবটুকু ভালবাসা দর্শকদের জন্য। তাদের অনুপ্রেরণায় আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী জানান, ‘লালজমিন’ গত অর্থবছরে ৪৪টি প্রদর্শনির জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয় অনুদান দিয়েছিলো। তিনি বলেন, আমরা সফল ভাবে ৪৪টি প্রদর্শনী সম্পূর্ণ করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় এই অর্থ বছরেও ‘লালজমিন’ নাটক আরও ৩০টি প্রদর্শনীর জন্য অনুদান দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়। কৃতজ্ঞতা মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি, সচিব মো: নাসির উদ্দিন আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব মো: আব্দুল মান্নান ইলিয়াস, যুগ্ম সচিব মো: ফয়জুর রহমান ফারুকী ও সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী, জেলা প্রশাসন ও শিল্পকলা একাডেমিকে ধন্যবাদ। দর্শকদের ভালবাসা জানাই । ‘লালজমিন’ নাটকের পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি। সঙ্গীত পরিকল্পনায় জুলফিকার চঞ্চল ও রামিজ রাজু। কণ্ঠ দিয়েছেন বারী সিদ্দিকী, রামিজ রাজু, নীলা সাহা। নেপথ্যে আতিকুল ইসলাম, আতিকুর রহমান, মীর্জা শাকিব, মমতাজ, জুয়েল মিজি, তানভীর সানি ও নিথর মাহবুব। ঢাবির নাটম-লে ২০১১ সালের ১৯ মে ‘লালজমিন’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। মহিলা সমিতিতে সম্প্রতি নাটকটির ১৭৪তম মঞ্চায়নেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন দর্শকরা।।
×