ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃত আদিবাসীরা বাদ পড়ায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে অ-আদিবাসী

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের এমবিবিএসে ভর্তিতে আসন বরাদ্দে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১০ নভেম্বর ২০১৮

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের এমবিবিএসে ভর্তিতে আসন বরাদ্দে অনিয়ম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দু’বছর ধরে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়ে আসছে রিম্মিত আমুয়া চিরান। সে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ট্রাই পরিবারের মেয়ে। ভর্তি পরীক্ষার মূল ফল থেকে তৃতীয় মাইগ্রেশন পর্যন্ত ‘অ-আদিবাসী’ শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ প্রদান ও আদিবাসী সার্টিফিকেট না থাকায় তাদের ভর্তি হতে না পারার খেলা চলে। আশায় আশায় স্বাভাবিক নিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে রিম্মিত চিরান। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আন্তরিক হস্তক্ষেপে এক পর্যায়ে সে তার আসন পেয়েও যায়। কিন্তু ততক্ষণে ভর্তি হওয়ার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেছে। ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় সে। এ বছরেও সে একই পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে। এভাবে প্রতিবছর এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি কার্যক্রমের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে প্রকৃত টাইবাল শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য বরাদ্দ আসনে ভর্তি হতে পারছে না। শূন্য রয়ে যাচ্ছে আদিবাসী কোটার আসন। অথচ কোন শিক্ষাবর্ষেই আদিবাসী কোটায় (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) ভর্তি হওয়ার জন্য ন্যূনতম পাস নম্বর প্রাপ্য ৮ আদিবাসী শিক্ষার্থীও পাওয়া যায় না। বিষয়টির সুরাহা চেয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বরাবর আবেদনপত্র জমা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু গত বছরও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে একই সমস্যা নিয়ে তদন্ত হয়, যার প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এমবিবিএস কোর্সে (মেডিক্যালে) ভর্তি কার্যক্রমে আদিবাসী কোটায় (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) আসন বরাদ্দে অনিয়মের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এসব অভিযোগ করেন। বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) ও ঢাকা মহানগর শাখা এই কর্মসূচীর আয়োজন করে। বাগাছাস, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি প্যাট্রিক চিসিমের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জেউন্স ঘাগ্রার সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বাগাছাস কেন্দ্রীয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ডেভিড চিরান, বাগাছাস ঢাকা মহানগর শাখার সহ-সভাপতি সাইমন রিছিল ও রাইনাস দিও, সাংগঠনিক সম্পাদক সঠিক রুরাম, অর্থ বিষয়ক সম্পাদক সুপ্ত আজিম ও বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য মং থিংওয়াং প্রমুখ। সমাবেশে নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, প্রতিবছর একই অনিয়মের কারণে প্রকৃত আদিবাসী শিক্ষার্থীরা আসনপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত বছর আদিবাসী নেতৃবৃন্দের অভিযোগ দেয়ার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে বিষয়টি তদন্তের নির্র্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বরাবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো প্রতিবেদনে আদিবাসী কোটার (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) দু’টি আসন খালি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ততক্ষণে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার নির্ধারিত তারিখ শেষ হয়ে যায়। আসন ফিরে পাওয়ার পরও ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি প্রকৃত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের। আদিবাসী কোটায় সুযোগ পাওয়ার পরও কলেজে ভর্তি না হয়ে সময়ক্ষেপণ করা ১১ শিক্ষার্থীর আদিবাসী সার্টিফিকেট চেয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু গত এক বছরেও তা পাওয়া যায়নি। বিষয়টি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এর মধ্যে আরেকটি এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষার ফল বের হয়ে প্রথম মাইগ্রেশন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আদিবাসী কোটা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের চিত্র ও কৌশল তুলে ধরে সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে মোট ৪৫ জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস, সরকারীভাবে যারা ‘ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে পরিচিত। তিন পার্বত্য জেলায় ১৩ ভাষাভাষীর বারো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। বাকি ৩২ জাতিগোষ্ঠী দেশের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, গাজীপুরসহ রাজশাহী বিভাগের বেশ কিছু জেলায় বাস করে, যারা সমতলের আদিবাসী বলে পরিচিত। এমবিবিএসে (মেডিক্যাল) ভর্তি কার্যক্রমে কোটার ভিত্তিতে ভর্তি হওয়ার জন্য সমতলের আদিবাসীদের জন্য মোট ৮ আসন রয়েছে, যা সরকারীভাবে ‘আদিবাসী কোটা (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া)’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এই কোটা সুবিধা নিতে হলে ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় কোড নম্বর ‘৭৭’ টিক চিহ্ন দিতে হয়। যারা এই কোড নম্বরে টিক চিহ্ন দেবেন, তারাই আদিবাসী শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে অনেক ‘অ-আদিবাসী’ শিক্ষার্থী আদিবাসী (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ‘৭৭’ কোড নম্বরে টিক চিহ্ন ব্যবহার করে আসছে। কারণ বরাদ্দ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ পৃষ্ঠা ‘৭৭’ কোড নম্বর ব্যবহারকারীর ‘আদিবাসী সার্টিফিকেট’ যাচাই বাছাইয়ের করার মাঝপথে আর কোন কর্তৃপক্ষ নেই। একজন শিক্ষার্থী যখন ভর্তির অনুমতি পেয়ে কোন কলেজে ভর্তি হতে যায়, শুধু তখন ওই কলেজ কর্তৃপক্ষই আদিবাসী সার্টিকেট যাচাই করে। মেধাস্কোর ও মেধাস্থান বিবেচনায় তুলনামূলক এগিয়ে থাকার সুযোগে কোড নম্বর ‘৭৭’ ব্যবহারকারী অনেক ‘অ-আদিবাসী’ পরীক্ষার্থী আদিবাসী কোটার আসন দখল করে নেয়।
×