ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি নির্বাচনে যাবে ॥ আজকালের মধ্যেই ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১০ নভেম্বর ২০১৮

বিএনপি নির্বাচনে যাবে ॥ আজকালের মধ্যেই ঘোষণা

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে বিএনপি। আজ-কালের মধ্যেই নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেবে দলটি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনেই নির্বাচন করতে দলীয় হাইকমান্ড গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছে। এ বিষয়টি দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও জেনে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোন কারণে ঐক্যফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন করা না গেলে ২০ দলীয় জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে দলটি। এ জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও চালাচ্ছে। এদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদারের পাশাপাশি তফসিল পেছানোর দাবিতে জোটগত ও দলগতভাবে সোচ্চার থাকবে বিএনপি। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে এতদিন সিনিয়র নেতারা হাঁকডাক দিলেও বাস্তবতার আলোকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে বিএনপি। দলীয় হাইকমান্ডের মতে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না গেলে একদিকে দলের নিবন্ধন হারাবে এবং অন্যদিকে নানান বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি নতুন করে দলটি ভাঙ্গনের মুখে পড়বে। কারণ, দল নির্বাচনে অংশ না নিলে বেশ ক’জন নেতা বিএনপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তারা তলে তলে সরকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই সরকারী দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। জানা যায়, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও অধিকাংশই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। এ পরিস্থিতিতে ৮ নবেম্বর আদালতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে নির্বাচনের বিষয়ে মতামত চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। তফসিল ঘোষণার পর মির্জা ফখরুল ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারাও আপাতত নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিতে বলেন। এরপর লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও আপাতত নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। এছাড়া ২০ দলীয় জোটের বৈঠককালে অধিকাংশ দলই নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেন। এরপর মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল যেসব নেতা যোগাযোগ করেছেন তাদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এদিকে আপাতত বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে হলেও তফসিল পেছানোর দাবিতে সোচ্চার থাকবে। তফসিল পেছানোর দাবি নিয়ে তারা শীঘ্রই নির্বাচন কমিশনে যাবে বলেও জানা গেছে। বেশি দিন না হলেও মনোনয়নপত্র দাখিল ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ অন্তত এক সপ্তাহ পেছালেও তারা নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত জানাবে। আওয়ামী লীগ ও তাদের রাজনৈতিক জোট আগেভাগে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে পারলেও বিভিন্ন কারণে বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক জোট প্রস্তুতি নিতে পারেনি এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরে তফসিল পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানাবেন তারা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সব রাজনৈতিক দল ও জোটের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও নেতাকর্মীদের যেন মামলা-হামলার মাধ্যমে হয়রানি না করায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে জোরালো দাবি জানাবে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ৮ নবেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর যেহেতু বিএনপিসহ বেশ ক’টি রাজনৈতিক দল তফসিল পেছানোর দাবি জানিয়েছে। আর বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনও বলেছে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে চায় তাই শেষ পর্যন্ত হয় তো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল কিছুদিন পিছিয়ে দেয়া হবে। আর তা করা হলে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে। আর শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল না পেছালে কিংবা বিএনপিকে রাজপথে নির্বাচনী প্রচারসহ কর্মসূচী পালনে বাধা সৃষ্টি করলে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের নির্দেশ মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে যদি কোন কারণে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাই নেবে। সে ক্ষেত্রে রাজপথে কঠোর কর্মসূচী পালন করবে। তবে রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচীতে না গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নানান কৌশলে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করে দলের জন্য একটি সুবিধাজনক ফল প্রত্যাশা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষেই বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা রয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ৭ দফা দাবি না মানলে নির্বাচনে যাবে না বলে বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের পক্ষ থেকে হুঙ্কার দেয়া হলেও তফসিল ঘোষণার পর তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। বরং বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক জোটের নেতারা সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তবে তারা সবাই সমস্বরে একটি কথা বলেছেন আর তাহলো ‘এক তরফা নির্বাচন করতেই তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।’ এ ছাড়াই এ জোটের সব নেতাই তফসিল পেছানোর দাবি জানালেও তফসিল না পেছালে নির্বাচনে যাবে না এমন কথা কেউ বলেননি। তাই এ প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক না হলেও খুব একটা নেতিবাচক নয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসতেই পারে। অভিজ্ঞ মহলের মতে বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক জোট যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে তা তফসিলের পর তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা গেছে। কারণ, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা থেকে বলেছিল তাদের দাবি মতো না পিছিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে পদযাত্রা করবে। এ ছাড়াও রাজপথে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করবে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর এর প্রতিবাদে কোন কর্মসূচীই দেয়নি। নির্বাচনে না গেলে তারা তফসিল প্রত্যাখ্যান করত এবং সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করত। তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য শুনে এমনটি দেশের সাধারণ মানুষও মনে করেছিল। কিন্তু বাস্তবতার কারণে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক জোট এমন নেতিবাচক অবস্থান থেকে পিছু হটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, রাজনীতিতে একবার ভুল করলে তা শোধরাতে অনেক সময় লেগে যায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে দলীয় হাইকমান্ড যে ভুল করেছিল এবার আর তা করতে চাচ্ছে না। তাই সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখতে মাঠের বক্তব্যে নির্বাচনের বিষয়ে নেতিবাচক কথা বললেও এবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই মত দিয়েছে। দলীয় হাইকমান্ডও আপাতত নির্বাচনের পক্ষে। তবে কোন কারণে নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হলে বা দলের নেতাকর্মীদের ওপর গ্রেফতার-নির্যাতন অব্যাহত থাকলে সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। তবে কখন কি হবে সময়ই বলে দেবে। আপাতত নির্বাচন করার বিষয়ে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মত দিয়েছেন। তাই দু’একদিনের মধ্যেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দলীয় কিংবা জোটগত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। এ জন্য দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। শীঘ্রই দলের পক্ষ থেকে দলের নেতারা কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে নির্বাচনের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে আসবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন নেতা তার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির সব সময়ই থাকে। তবে আমাদের দাবি উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে শীঘ্রই বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা হবে। আশা করব নির্বাচন কমিশন ও সরকার বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে পরিবেশ নিশ্চিত করবে। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সূত্র জানায়, তফসিল ঘোষণার পর জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরাও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ করে নির্বাচনের বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া ৮ নবেম্বর রাতে ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নেয়া অধিকাংশ নেতাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। এদিকে তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশের অনেক নেতা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কাছে নির্বাচনের বিষয়ে দিক নির্দেশনা চেয়েছেন। সে সময় দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। তবে দু’কদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত নির্দেশনা দেয়া হবে বলেও তৃণমূল নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
×