ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীদের টার্গেট করে অর্থ ব্যয়

জামায়াতের আল কায়েদা লস্কর-ই-তৈয়বা কানেকশন ॥ সুইসাইড স্কোয়াড গঠনের চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১০ নভেম্বর ২০১৮

  জামায়াতের আল কায়েদা লস্কর-ই-তৈয়বা কানেকশন ॥ সুইসাইড স্কোয়াড গঠনের  চেষ্টা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়নের নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করছে জামায়াতে ইসলামী। সংগঠনটি তাদের নেতাকর্মী ও নিজস্ব এনজিওর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার, মানবিক কর্মকান্ড চালানোর কথা বলে বিদেশ থেকে কাড়ি কাড়ি অর্থ আনছে। সেসব টাকার সিংহভাগ নির্মম নির্যাতনের পর নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত যুবক-যুবতীদের টার্গেট করে তাদের পেছনে খরচ করা হচ্ছিল। টার্গেটকৃতদের জঙ্গী বানাতেই চলছিল এমন তৎপরতা। যারা দলে ভিড়বে তাদের দিয়ে সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠনের চেষ্টা চলছিল। জামায়াতে ইসলামীর মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে কাজ করছে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও লস্কর-ই-তৈয়বা। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতেই চলছে এমন তৎপরতা। ইতোমধ্যেই পুলিশের অভিযানে জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত চারটি এনজিও সর্ম্পকে সুস্পষ্ট তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে দুটি এনজিওর ১৬ জন গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা সবাই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী। এদের মধ্যে আট জন জামায়াত-শিবির থেকে রীতিমতো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় জঙ্গী হিসেবে গড়ে উঠেছে। তারা গোপন তৎপরতা চালাচ্ছিল। শনাক্ত হওয়া এনজিওগুলো বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জঙ্গী অর্থায়নকারী এনজিওর বিষয়ে তদন্ত চলছে। তাদের নিবন্ধন বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতারকৃত আট জঙ্গীকে ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমন তথ্য পাওয়া গেছে জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়নকারীদের গ্রেফতারে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চলছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর জঙ্গী অর্থায়নকারী রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমীর ও যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার চলাকালীন সময়ে মৃত্যু হওয়া মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসূফের আট সহযোগী সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃত মুহম্মদ ফজলুল হক রিকাবদার, ফজলুল হক, হুমায়ুন কবীর, আশরাফুল হক, আসগর হোসাইন, শেখ শাহজাহান কবীর, মনিরুল ইসলাম, আব্দুর রউফ ও আল মামুন খন্দকার এক সময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আবুল কালাম বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি নামের ওই এনজিওটি এনজিও ব্যুরোর কাছ থেকে নিবন্ধন নেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এনজিওটির মাধ্যমে বিদেশে থেকে সাড়ে ৬২ কোটি টাকারও বেশি অর্থ এসেছে। এসব অর্থের অধিকাংশই জঙ্গীবাদ বিস্তারে ব্যয় করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কৃষিবিদরা ‘নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেড’ ও ‘নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ নামের আরও দুইটি এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করতেন। সর্বশেষ গত ৭ নবেম্বর রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুর ডিওএইচএস-এর ৯ নম্বর সড়কের ৬৪৪ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত ‘স্মল কাইন্ডনেস বাংলাদেশ (এসকেবি)’ নামের একটি এনজিওতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। জঙ্গীবাদে অর্থায়নের জন্য সংগ্রহ করা ১৪ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার হয় সাফ ওয়ানুর রহমান (৩৪), সুলতান মাহমুদ (২৫), নজরুল ইসলাম (৩৮), আবু তাহের (৩৬), ইলিয়াস মৃধা (৩০), আশরাফুল আলম (২৪), হাসনাইন (৩০) ও কামরুল (২৮) নামের আট জন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃতরা এক সময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। গ্রেফতারকৃতরা জেএমবি ও আনসার আল ইসলামকে আর্থিকভাবে সহায়তা করত। জঙ্গীদের সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে তারা। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তৎপরতা জোরদার করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তাদের ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাবাদে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতরা বহুদিন ধরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এনজিওটির পরিচয়ে তৎপরতা চালাচ্ছিল। তারা মানবিক কর্মকান্ড চালানোর আড়ালে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে জঙ্গীবাদ প্রচার করছিল। তারা মূলত রোহিঙ্গা যুবক ও যুবতীদের টার্গেট করেছিল। তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছিল তারা। নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে নির্মম নির্যাতনের পর বিতাড়িত এসব নিঃস্ব যুবক-যুবতীদের চরম বিদ্রোহী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। দলে ভিড়লে আস্তে আস্তে প্রশিক্ষিত করে তাদের দিয়ে সুইসাইডাল স্কোয়াড (আত্মঘাতী দল) গঠনের পরিকল্পনা ছিল। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে পাকিস্তানে বসবাসরত রোহিঙ্গা জঙ্গী আব্দুল করিম টুন্ডা। জেএমবি আমির জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য কারাবন্দী মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই পাকিস্তানে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে নিহত ইজাজ ওরফে কারগিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী টুন্ডার প্রধান কাজই হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা যুবক-যুবতীদের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেয়া। সূত্র বলছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে এনজিও ব্যুরো জঙ্গীবাদে অর্থায়ন ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এনজিওটির কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে। তারপরেও এনজিওটি পাকিস্তান, তুরস্ক, ফিলিপিন্স, কানাডা, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদান আনছিল। পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন আল খিদমত ফাউন্ডেশন এনজিওটির মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিবিরে নির্বিঘ্নে জঙ্গীবাদী কর্মকান্ড চালাচ্ছিল। আল খিদমত ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও লস্কর-ই তৈয়েবার সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারকৃতরা এনজিওটির মাধ্যমে লস্কর-ই-তৈয়েবা ও আল কায়েদার হয়ে কাজ করছিল। রোহিঙ্গাদের জঙ্গী দলে ভেড়াতে আল কায়েদা, লস্কর-ই-তৈয়েবা ও আনসার আল ইসলামের গ্রেফতারকৃতদের সরাসরি অর্থায়ন করছিল।
×