ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিট ফেস্টেও এক আলোচনা

ভয় জয় করার 'মি টু বাংলাদেশে কতটা সফল?'

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১০ নভেম্বর ২০১৮

ভয় জয় করার 'মি টু বাংলাদেশে কতটা সফল?'

মোরসালিন মিজান ॥ নারীর জন্য পৃথিবী এখনও আদিম। এখনও পিছিয়ে পড়া। সব এগিয়ে চলেছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটি সেকেলে। পুরনো। এ অবস্থায় পরিবর্তন কোন্ পথে? ভাবতে ভাবতে অনেকেই যখন ক্লান্ত, ঠিক তখন শুরু হলো মি-টু মুভমেন্ট। অনলাইন নির্ভর আন্দোলন হলেও পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। এসেছে দৃশ্যমান সাফল্য। ব্যতিক্রমী প্ল্যাটফর্ম নারীকে ভয় জয় করার সাহস যোগাচ্ছে। যৌন নির্যাতনকারী পুরষের মুখোশ একে একে খুলে দিচ্ছেন তারা। অনেকেই বহুকাল ধরে একলা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন যে কষ্ট-স্মৃতি, অবঈলায় প্রকাশ করছেন। তাতেই ঝড় বইছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হয়ে চলে এসেছে বাংলাদেশেও। নানা মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। লিট ফেস্টেও তা-ই। এবারের আয়োজনে নারী ইস্যুটিকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন আয়োজকরা। এ কারণেও হয়ত ঘুরেফিরে আসছে মি-টু মুভমেন্ট। উৎসবের প্রথম দিন ভারতীয় পরিচালক অভিনেত্রী নন্দিতা দাস বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। কথা বলছেন অন্যরাও। সে ধারাবাহিকতায় শুক্রবার আলাদা একটি সেশনের আয়োজন করা হয়। এমন একটি বিষয়ে কত নারী আগ্রহী হবেন? পুরুষরা কি যোগ দেবেন আলোচনায়? প্রশ্ন ছিল। উত্তর পেতে দেরি হয়নি। আলোচনা শুরুর আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয় যায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন। এটি একাডেমির সবচেয়ে বড় মিলনায়তন। এর পরও মেঝেতে বসেছিলেন অনেকে। তার মানে, বাংলাদেশের নারীও বলতে চান। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরা এত সরব যে, দেখে সত্যি খুব আশাবাদী হতে হয়। মন্দ পুরুষের কথা হবে। ভেতরে এক আর বাইরে অন্য যে, সেই পুরুষের কথা হবে। এর পরও অনেক পুরুষ এসেছিলেন। তরুণরা এসেছিলেন। সবাই মানুষ পরিচয়ে কথা বলেছেন। সেশনের নির্ধারিত বিষয় ছিল ‘মি-টু যুগে বাঙালী সমাজ ও নারীত্ব।’ বিষয় ধরে আলোচনা হয়নি। সুযোগটি যে কারণেই হোক, নষ্ট হয়েছে। তবে বিচ্ছিন্ন আলোচনা থেকেও উঠে এসেছে অনেক সত্য। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন নারী অধিকার কর্মী রীতা দাস রায়। সাংবাদিক মুন্নী সাহা। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আলোচক ছিলেন জায়মা। তিনিও সাংবাদিক। সঞ্চালনা করছিলেন অভিনেত্রী বন্যা মির্জা। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেন রীতা রায়। নিজের অভিমত দিয়ে তিনি বলেন, মি-টু আন্দোলনের জন্য এখনও ঠিক প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। সমাজ কাঠামো এখনও নারীর অনুকূল নয়। মি-টু মুভমেন্টের অংশ হয়ে কোন নারী মুখ খুললে, তার পাশে কেউ দাঁড়াবে কি? প্রশ্ন তোলেন তিনি। সাংবাদিক মুন্নী সাহা বলেন, নারী নিপীড়ন বিরোধী মুভমেন্ট আমাদের এখনও আছে। ছিল। এবার এলো মি-টু হয়ে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি তুলে ধরেন তিনি। বলেন, অনেক শিক্ষক দ্বারা তার ছাত্রীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এমনকি নিজ কর্মস্থলে মি-টু মুভমেন্টের কথা উঠলে পুরুষ সহকর্মীদের কেউ কেউ হেসে ফেলেছেন বলে জানান তিনি। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বারবারই এ সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেন তিনি। জাইমা বলেন, মি-টু মুভমেন্টের ফলে সারা বিশ্বের নারী নিজের নিগৃহীত হওয়ার কথাটি বলতে পারছে। অন্যরা তাদের কথা বিশ্বাস করছে। আইনের কথাও এসেছে। এক প্রশ্নের জবাবে রীতা রায় বলেন, বাংলাদেশে অনেক আইন আছে। অনেক শক্ত আইন। কিন্তু বাস্তবে তা খুব কমই কার্যকর হয়। এ জন্য নারীকেই সক্ষম হতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, যে পুরুষরা নারীর প্রতি এমন নোংরা আচরণ করছে তাদের বোঝাতে হবে। অবশ্য মঞ্চের আলোচকদের দুর্বলতা ধরার মতো দর্শকও কম ছিল না। তাদের একজন পুরুষ প্রতিনিধি। তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে নারীদের বার বার কৌশলী হতে বলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিবাদে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার বলাকে করতালি দিয়ে স্বাগত জানান দর্শক। নারী নির্যাতনের আলোচনায় উঠে এসেছে এক পুরুষ গণমাধ্যমকর্মীর নামও। এ ব্যাপারেও জানতে চাওয়া হয় মুন্নী সাহার কাছে। এখানেই শেষ নয়, দর্শক আসনে বসা আরেক নারী সঞ্চালক বন্যা মির্জার একটি ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, কিছুদিন আগে যৌন নীপিড়নের শিকার এক সহঅভিনেত্রীর পাশে তিনি দাঁড়াননি। উল্টো ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাকে আক্রমণ করেছেন। অর্থাৎ. নারীরাও নারীর বাধা হয়ে উঠছে কিনা? সে প্রশ্ন তুলেন তিনি। এভাবে বহুমাত্রিক আলোচনা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আলোচনা। লিট ফেস্টের অন্য সেশনগুলোও যথারীতি উপভোগ করেছেন দর্শনার্থীরা। বিকেলে একটি সেশনে কথা বলেন ফিলিপ হেনশার। বাথ স্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগের অধ্যাপক তিনি। ব্রিটিশ সাহিত্যিকের সাম্প্রতিক উপন্যাসটি বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের প্রসঙ্গ এসেছে উপন্যাসে। সঙ্গত কারণেই ‘দ্য ফ্রেন্ডলি ওয়ানস’ নিয়ে আলাদা কৌতূহল ছিল পাঠকের। কবি শামসুর রাহমান সম্মেলন মিলনায়তনে আয়োজিত সেশনে উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন ফিলিপ। তিনি জানান, শেফিল্ডে একটি ব্রিটিশ পরিবারের পাশের বাড়িতেই থাকেন একটি এশীয় পরিবার। দুই প্রতিবেশীর গল্প নিয়েই উপন্যাস। ক্রমে উঠে আসে ১৯৭১ সাল। সে সময় ধানমন্ডির বাসায় থাকা একটি পরিবারের দেখা মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি লেখক বলেন, এই দুটো পরিবারের ভিন্ন সংস্কৃতি। এরপরও কী করে তাদের মধ্যে একটি চমৎকার মেলবন্ধন তৈরি হয়, তাও বলার চেষ্টা করেছি আমি। সেশনটি পরিচালনা করেন অনুবাদক লেখক খাদেমুল ইসলাম। লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে শিশু-কিশোরদের জন্য ছিল বহুবিধ আয়োজন। আয়োজনগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। ফলে প্রচুর ছেলেমেয়ে উপস্থিত হয়েছিল এদিন। একাডেমির নজরুল মঞ্চে তাদের জন্য ছিল একাধিক আকর্ষণীয় পরিবেশনা। বিশেষ করে পুতুলনাট্য দেখে বাচ্চারা দারুণ খুশি। এদিন বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র তাদের ‘মানুষ’ নাটকটি পরিবেশন করে। পাপেট মানুষ ও পাপেট বাঘের গল্প। আকর্ষণীয় ঢঙে গল্প বলার পাশাপাশি প্রাণী ও প্রকৃতি রক্ষার পক্ষে একটি জোরালো বক্তব্য পাওয়া যায় নাটক থেকে। ছিল গল্প বলার আয়োজন। ‘পশু পাখির তিন গল্প’ শিরোনামে আয়োজিত সেশনে শিশুদের গল্প শোনান ফাতেমা-তুজ-জোহরা। একই দিন ‘সুপার ডগস’ সেশনে শিশুদের গল্প পড়ে শোনান হিমাঞ্জলি শঙ্কর। দুপরে শিশুদের জন্য ছিল থিয়েটার: দ্য লাস্ট ট্রি। বিদ্যাভুবন প্রযোজনা। পরিচালনা করেন শেখ আল মামুন। এখানেও নাটকের ভাষায় বৃক্ষের প্রতি ভালবাসা দেখানোর আহ্বান জানানো হয়। সব মিলিয়ে চমৎকার কেটেছে লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনটিও।
×