ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার মাসুদ

শরৎচন্দ্র ও বিদেশী উপন্যাসিক

প্রকাশিত: ০৭:২০, ৯ নভেম্বর ২০১৮

শরৎচন্দ্র ও বিদেশী উপন্যাসিক

বাঙালী লেখককে এক বা একাধিক বিদেশী লেখকের সঙ্গে মেলানোর একটা রীতি দীর্ঘকাল ধরে চালু আছে আমাদের দেশে। এক্ষেত্রে তুলনাযোগ্য বিদেশী লেখকটি সচরাচর কোন ইংরেজ লেখক কিংবা ইংরেজী ভাষার লেখক। সে জন্য মধুসূদন তুলিত হয়েছেন মিলটনের সঙ্গে, নজরুল বায়রনের সঙ্গে, জীবননান্দ ইয়েটসের সঙ্গে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ডিলান টমাসের সঙ্গে। উপন্যাসের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্রকে বহু আগেই ‘বালার স্কট’ খেতাব দেয়া হয়েছে। শরৎচন্দ্রখ্যাত হয়েছেন ‘বাংলার ডিকেন্স’ নামে। কথাকার হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র রোমাঞ্চপ্রবণ। সুতরাং ‘আইভানহো’ (ওাধহযড়ব) খ্যাত ওয়াল্টার স্কটের অনুরাগী পাঠক তিনি হবেন, এটাই স্বাভাবিক। স্কটের প্রভাবকে তিনি রীতিমতো হজম করেছেন। বঙ্কিমের সৃষ্টি ‘কপাল-কুন্তলা’ ওই অভিন্ন কারণেই জমজমাট এক রোমাঞ্চ। অন্যদিকে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আর জীবনভাবনার সাযুজ্যের প্রশ্নে ডিকেন্সই শরৎচন্দ্রের নিকটতম আত্মীয়। শরৎচন্দ্রের অতিমাত্রিক ডিকেন্সপ্রীতির কারণ কি? কারণ চার্লস ডিকেন্স শরতের মতোই পারিবারিক বা সামাজিক উপন্যাস রচনা করেছেন। তার লেখায় মানুষের দুঃখ-কষ্টের মর্মন্তুদ বর্ণনা আছে। মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণীর জীবনের টানাপড়েন চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে সেখানে। ডিকেন্সের মধ্যে বাস্তববাদিতা প্রবল। আদর্শবাদিতাও লক্ষণয়ী। এগুলো শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্যেরও প্রধান চরিত্র। আবার কারুণ্য ও হাসি-মশকরা দু’ধরনের রসেরই সমন্বয় ঘটেছে ডিকেন্সে যা আমরা শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিও পেয়ে থাকি। ডিকেন্স ও শরৎ দু’জনেই পীড়িত হয়েছেন মানুষের সীমাহীন দুঃখে। লাঞ্ছিত-নির্যাতিত মানুষের জন্য উভয়েরই কলম হয়ে উঠেছে দরদি, সহমর্মী। ‘অলিভার টুইস্ট’ (ঙষরাবৎ ঃরিংঃ) উপন্যাসে ডিকেন্স পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের দুঃসহ জীবনের সমব্যথী চিত্র এঁকেছেন। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (উধারফ পড়ঢ়ঢ়বৎভরবষফ)-এ দেখা যাচ্ছে, জনসাধারণের জন্য স্থাপিত স্কুলে চালু খাতা শিক্ষা পদ্ধতি, জেলখানা ও কারাবন্দীদের শোচনীয় অবস্থা প্রভৃতির সমালোচনা করেছেন। অনুরূপভাবে সামাজিক দলাদলি ও মানুষের নীচতা (‘পল্লী সমাজ’-এ); লোকনিন্দা, পশ্চাৎপদতা ও সামাজিক অনাচার (‘অরক্ষণিয়া’য়), অন্যায় ভাবাবেগ আর নারীর অসামান্য আত্মসংযম (‘চরিত্রহীন’-এ) প্রভৃতি খুবই হৃদয়- সংবেদী ভাষায় তুলে এনেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপরন্তু এই দুই লেখকই চরিত্র চিত্রনে ওস্তাদ। যেমন নিটোল গল্প তেমনি বাস্তবানুগ চরিত্র (ডিকেন্সের বেলায় কোথাও কোথাও একটু ব্যতিক্রম আছে। একটার পর একটা সৃষ্টি করেছেন উভয়েই। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রে যদি সাবিত্রী (‘চরিত্রহীন’-এ), দেবদাস, শ্রীকান্ত, গফুর, রাজলক্ষ্মী প্রমুখ চরিত্র সেরা সৃষ্টির উদাহরণ হয়, তা হলে ডিকেন্সের বেলায় তা হবে মিস হ্যাভিশাম, পিপ, বেট্সি ট্রটউড, জো গার্গেরি, মি. নিকোবার, লিটল্নেল প্রমুখ। যাকোহ, এই দুই মহান লেখকের ভেতরের সাদৃশ্যর কথা আমরা আবার বলব। সে সময় দু’জনের মধ্যকার বৈসাদৃশ্যের প্রসঙ্গটিও আসবে। আপাতত যে ইংরেজ লেখকদের গল্প-উপন্যাস শরৎচন্দ্র পছন্দ করতেন, তাদের সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা যাক। শরৎচন্দ্র পছন্দ করতেন মিসেস হেনরি উড ও মারি করেলি নামের দুজন মহিলা লেখকের উপন্যাস। হেনরি উড (১৮১৪-৮৭) ছিলেন রক্ষণশীল টাইপের লেখক। মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্রকে উপজীব্য করেছিলেন তিনি। ‘ইস্ট লিন’ (ঊধংঃ খববহ), ‘দ্য চ্যানিং তার বিখ্যাত উপন্যাস। ‘ইস্ট লিন অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। এই উপন্যাসের সঙ্গে ‘বিরাজ বউ’-এর, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় চরিত্রভিত্তিক, কিছু সাদৃশ্য আছে। উডের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল। তা সত্ত্বেও গল্প বলার কায়দায় তার আন্তরিকতা টের পাওয়া যায়। মারি কেরলি (১৮৫৫-১৯২৪)-এর নাম করা উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘অ ৎড়সধহপব ড়ভ ঃড়ি ড়িৎষফং, ঃযব ংড়ৎৎড়ংি ড়ভ ংধঃধহ, ঃযব সরমযঃু অঃড়স’ ‘আ রোমাঞ্চ অব টু ওয়ার্লডস’ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। লেখকের জীবনের বিচিত্র সব ঘটনার উল্লেখ আছে এখানে। অনেক স্বীকারোক্তি অকপট বলেই মনে হয়। করেলির গদ্যভঙ্গিও বেশ আন্তরিক। আধাত্মবোধের সঙ্গে লেখক সুলভ নীতিবোধের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানসম্মত জীবনদৃষ্টি এই লেখককে মিসেস হেনরি উডসহ অনেক সমকালিক উপন্যাসকার থেকে আলাদা করেছে। সঙ্গীতশাস্ত্রে শরৎচন্দ্রের ব্যুৎপত্তির কথা আমরা জানি। মারি করেলিও ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু এরা কেউই প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক নন। জীবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সঙ্কীর্ণ পরিধির সহজাত, সাবলীল কাহিনী উপহার দিয়েছেন এরা। গার্হস্থ্য জীবনের ছবি বেশ ভালভাবেই চিত্রিত হয়েছে এদের লেখায়। পারিবারিক বা সামাজিক উপন্যাসের প্রসঙ্গে অগ্রসর পাঠকের মনে পড়বে জেন অস্টেনের কথা। তার সমাজ দৃষ্টির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের অনেকখানি সাদৃশ্য লক্ষণীয়। প্রতিবেশীদের মধ্যে নবাগত একজন তরুণ অফিসার (অবিবাহিত)কে ঘিরে একটি পরিবারের পাঁচ বোনের মধ্যে আকাক্সক্ষা ও সংশয়ের জন্ম হয়। তাদের বাবা-মা, পাড়া-পড়শীদের মধ্যে ঔৎসুক্য ও কৌতূহল দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই মানসিক টানাপোড়েনে ভুগতে আরম্ভ করে। বোনদের মধ্যে শুরু হয় নীরব প্রতিযোগ। চৎরফব ধহফ ঢ়ৎবলঁফরপব উপন্যাসে অস্টেন এসব ব্যাপার দক্ষ শিল্পীর মতো চিত্রিত করেছেন। সাধারণ ঘটনা, মামুলি বিষয় কলমের জাদুতে হয়ে উঠেছে অসাধারণ। স্যার ওয়াল্টার স্কট ১৮২৬-এ রচিত এড়ঁৎধহষ এ জেন অস্টেনের সাহিত্যিক গুণপনা প্রসঙ্গে ঊীয়ঁরংরঃব ঃড়ঁপয ফ্রেজটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন জেনের ‘ঞযব ঃৎঁঃয ড়ভ ঃযব ফবংপৎরঢ়ঃরড়হ ধহফ ঃযব ংবহঃরসবহঃ’- এর কথা। হ্যাঁ, এই বিষয়গুলোই জেন অস্টেনের কথাসাহিত্যকে উচুঁ স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। স্কটকথিত ওই ঊীয়ঁরংরঃব ঃড়ঁপয (লেখনীর জাদুশক্তি) যেমন অস্টেনকে, তেমনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও সামর্থ্যবান করে তুলেছে সাধারণ বিষয়-আশয়কে উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দেয়ার কাজে। অবশ্য পার্থক্যও আছে। যেমন, সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনাকে জেন থিম হিসেবে গ্রহণ করেননি, অন্তত সেই চেষ্টা করে গেছেন। সাধ্যমতো। এ ব্যাপারে লেখকের অনীহা গধহংভরবষফ ঢ়ধৎশ উপন্যাসের মুখবন্ধে সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে খবঃ ড়ঃযবৎ ঢ়বহং ফবিষষ ড়হ মঁরষঃ ধহফ সরংবৎু অর্থাৎ, অন্য লেখকরা এ বিষয়ে লিখুক; এটা তার কাজ নয়। প্রসঙ্গত টমাস হার্ডির কথা বলব। হার্ডির গল্প-পৃথিবী প্রায়শই গড়ে উঠেছে শহর থেকে দূরে প্রায় নৈ:শব্দ্যশাসিত, নিরিবিলি নিস্তরঙ্গ মফস্বলে। ঋধৎ ভৎড়স ঃযব সধফফরহম পৎড়বফ উপন্যসটির নামকরণ থেকেই হার্ডির স্বনির্মিত প্রশান্তির পৃথিবী সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। ধরা যায় সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে তার মৌল প্রবণতাটি হার্ডির গল্প-উপন্যাসে আবেগ একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে, ঠিক যেমনটা দেখা যায় শরৎচন্দ্রে। শরতের মতো ইনিও যর্থাথ নারী দরদি লেখক এবং গ্রামীণ জীবনের সার্থক রূপকার তিনি। প্রকৃতি (ঘধঃঁৎব) একটি ব্যতিক্রমী ভূমিকায় অবতীর্ণ হার্ডির লেখায়। ঞবংং ড়ভ ঃযব উঁৎনঁৎারষবসহ তার একাধিক উপন্যাসে আমরা দেখি, ভাগ্যদোষে, জীবনের বিড়ম্বনায় হার্ডির যে সব চরিত্র বিপর্যস্ত তাদের নিয়ে পরিহাস করছে প্রকৃতি। ফ্রস্টের কবিতায় আমরা প্রকৃতির নির্লিপ্তি বা ঔদাসীন্য দেখেছি। হার্ডির ক্ষেত্রে দেখা গেল তার নির্দয় রূপ। মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও শরৎচন্দ্র টমান হার্ডির অনুগামী বলেই মনে হয়। শরৎ বিষয়ক তুলনামূলক আলোচনায় মহিলা লেখকদের প্রসঙ্গ আসাটা কেবল প্রাসঙ্গিক নয় খুব প্রয়োজনীয়ও। তার কারণ সবাই জানেন, নারী, বিশেষ করে গ্রামবাংলার নারী, তার কথাসাহিত্যে বিরাট জায়গা জুড়ে আছে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কল্যাণে আমরা নারীর ভেতরকার সুপ্ত পরুষ সত্তা এবং পুরুষের ভেতরকার সুপ্ত নারীসত্তার কথা জানি। এ কারণে, অন্য কারণও থাকতে পারে, শরৎচন্দ্র নারী চরিত্রের অতটা গভীরে ঢুকতে পেরেছিলেন। তার মধ্যে নারী সত্তার প্রবল উপস্থিতি অনুভব করা যায়। এই সত্তা অপরাপর অনেক পুরুষ লেখকের তুলনায় বেশি পরিপক্ব ও সংবেদী ছিল। সে জন্যই গার্হস্থ্য উপন্যাস রচনায় সিদ্ধহস্ত প্রাগুক্ত মহিলা লেখকের মতো শরৎচন্দ্র ও সমজাতীয় লেখার ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতী দেখাতে পেরেছেন। চার্লস ডিকেন্সের প্রসঙ্গে আসা যাক, পুনরায়। শরৎচন্দ্র ও ডিকেন্স দু’জনেই গভীর অর্থে মানবদরদি, মানবতাবাদী। এদের মধ্যে যেমন প্রচুর মিল আছে, তেমনি অমিলও কম নেই। ডিকেন্স অত্যন্ত বাস্তবনিষ্ঠ কথাকার। তার অবিস্মরণীয় উপন্যাস অ ঃধষব ড়ভ ঃড়ি পরঃরবং দাঁড়িয়ে আছে ফরাসী বিপ্লবের পটভূমির ওপর। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে যদিও তার কাহিনীর সূত্রপাত ১৭৭৫-এ। শরৎচন্দ্র কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় আগ্রহ দেখাননি। তিনি যে কালে বেঁচে ছিলেন সেই সময়কালের মধ্যেই নিজের উপন্যাস ভাবনাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তিনি কদাচিৎ নগরের পটভূমিতে গল্প সাজিয়েছেন। অন্যদিকে ডিফেন্স একান্তভাবেই নাগরিক লেখক। তার সাহিত্যের পৃথিবী আবর্তিত হয়েছে লন্ডন শহরকে ঘিরে। উপন্যাসের প্লট কিংবা কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় লেখকেরই দুর্বলতা আছে। কিন্তু ডায়ালগ তৈরির ক্ষেত্রে উভয়েই খুব আগ্রহী ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সম্ভবত পাঠকরঞ্জনের বিষয়টি মাথায় ছিল বলেই তারা ডায়ালগের পেছনে অনেকখানি জায়গা ব্যয় করেছেন; প্রশ্রয় দিয়েছেন মেলোড্রামাকে। আবার অবিশ্বাস্য অনেক কা--কারখানাও ঘটিয়েছেন। কখনও কখনও মনে হয়েছে, গল্প বা উপন্যাস তার স্বাভাবিক পরিণতির ভেতর দিয়ে শেষ হতে পারেনি। শরৎচন্দ্রের ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসটি এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। এই বইয়ে দুশ্চরিত্র, লম্পট নায়ক পূর্ব পরিত্যক্তা স্ত্রী ষোড়শীর সান্নিধ্যে আসার পর রাতারাতি ভাল মানুষ হয়ে যায়। এটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। ডিকেন্সের উধারফ ঈড়ঢ়ঢ়বৎভরবষফ উপন্যাসের শেষে মি. মিকোরার যিনি ভাল কিছু একটা ঘটবে এই আশায় প্রায় সারা জীবন হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন, তাকে দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ম্যাজিট্রেট হতে। এটাও কি খুব বিশ্বাস্য মনে হয় কিন্তু এগুলো জনপ্রিয় গ্রন্থ। তার কারণ এ ধরনের পরিণামই সাধারণ পাঠকের কাছে প্রীতিকর, যেহেতু কোন প্রশ্ন তাদের বিচলিত করে না; কোন অসঙ্গতিও দেখতে পায় না তারা। এই পাঠকেরা যুক্তি নয়, হৃদয়াবেগ দ্বারা চালিত। এরা কেবল পাঠ করার আনন্দেই পাঠ করে যান। ডিকেন্স ও শরৎচন্দ্র দু’জনের লেখাতেই হাস্যরস ও করুণরস রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরির মতো অস্তিত্ববান। করুণরসের বিষয়টি প্রথমে আলোচনা করা যাক। করুণরসের অতিরেক শরতের গল্প-উপন্যাসে অনেক সময় ভাবালুতার জন্ম দিয়েছে। তার ট্রাজিক গল্প ‘মহেশ’-এর শেষ অংশটুকু স্মরণ করুন। এখানে ক্ষোভ-দুঃখ-যন্ত্রণায় কাতর গফুর শেষ পর্যন্ত তার অতি প্রিয় বলদ মহেশকে নিজ হাতে মেরে ফেলে। তারপর কিশোরী কন্যা কামিনাকে নিয়ে গৃহত্যাগী হয় রাতের আঁধারে। প্রসঙ্গ ঙষফ পঁৎরড়পরঃু ংযড়ঢ় উপন্যাসে লিটল্ নেলের মৃত্যুদৃশ্যের কথাও বলা যেতে পারে। ডিকেন্স খুবই চড়া রঙে এঁকেছেন এই দৃশ্যটি যাতে পাঠক সহানুভূতিতে আর্দ্র হয়ে ওঠে। আসলে হৃদয়াবেগের আতিশয্যকে এই দুই লেখক খুব মূল্য দিয়েছেন। পড়তে পড়তে পাঠকের চোখ যাতে অশ্রু ছল ছল হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে উভয়েই বেশ যতœবান ছিলেন মনে হয়। ‘শ্রীকান্ত’ শরৎচন্দ্রের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ও আত্মজীবনমূলক উপাদান ঋদ্ধ। কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্রের বাউন্ডেলেপনা আর রাখালি সুর ‘শ্রীকান্ত’কে এমন তারে, বেঁধেছে যে, ডিকেন্সের ওই বইটি থেকে তার পার্থক্য স্পষ্ঠ ধরা পড়ে। দু’জনেই জীবনবাদী উপন্যাসিক। জীবনকে তারা ভেতর থেকে জেনেছেন এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন কথাসাহিত্যে। তাহলে এদের লেখালেখির মূল কথাটা কি? মূল বক্তব্য হচ্ছে, জীবনে আঘাত থাকবে, দুঃখ-যন্ত্রণা থাকবে; কিন্তু এসব তরঙ্গের অভিঘাতকে সহ্য করে টিকে থাকতে হবে। মুখের হাসি দিয়ে মনের ক্ষত আড়াল করতে না পারলে বাঁচা যাবে না। ডিকেন্স অঙ্কিত চরিত্র বেটসি ট্রটউড যেমন বলেছেন- ডব সঁংঃ সবপঃ ৎবাবৎংবং নড়ষফরু ... বি সঁংঃ খরাব সরংভড়ৎঃঁহব ফড়হি হ্যাঁ, ‘গরংভড়ৎঃঁহব’ বা দুর্ভাগ্যকে পদানত করে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাই দিয়েছেন এরা। হৃদয়াবেগের প্রাবল্যের নিরিখে বিচার করলে ডিকেন্সের চেয়ে শরৎচন্দ্র এক ধাপ এগিয়ে আছেন বলে মনে হয়। এর অন্যতম কারণ শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাস নায়িকাকেন্দ্রিক। যেসব উপন্যাসের কেন্দ্রে নারী নেই সেগুলোতেও নারী চরিত্রের প্রবল উপস্থিতি লক্ষণীয় এবং নারী, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া, সচরাচর ভাবাবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। নারী চরিত্র গভীরভাবে অনুধাবন করার উপযোগী অন্তর্দৃষ্টি ডিকেন্সের মধ্যে নেই। বরং সেখানে হিউমারের পাশাপাশি পুরুষসুলভ ভাব অনেক বেশি পরিস্ফুট। করুণরস প্রকাশের ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের ক্ষমতা অসামান্য। অচলা (উপন্যাস : গৃহদাহ), সাবিত্রী (উপন্যাস : চরিত্রহীন), কমললতা (উপন্যাস : শ্রীকান্ত, পর্ব-৪) প্রভৃতি নারী চরিত্রের মর্মান্তিক জীবন পরিণতির কথা আমাদের জ্ঞাত। তা সত্ত্বেও বলা চলে, শরৎ-প্রতিভার প্রবণতা ও বিকাশের পাল্লাটি ঝুঁকে আছে কমেডির দিকেই। এদিক থেকেও তিনি ডিকেন্সের সমগোত্রীয় লেখক। কিন্তু করুণ ভাবাবেগের আতিশয্যের কারণে ওই হাস্যরস প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি। কমেডি সৃষ্টির বেলায় ডিকেন্সের সমতুল্য লেখক কেবল ইংরেজী সাহিত্যে নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ‘পিক্উইক পেপারস’ উপন্যাসের পিকউইক চরিত্রটি স্মরণ করুন। অনাবিল হাস্যরস সৃষ্টিতে দক্ষ এমন মজার চরিত্র সহজে মেলে না। সমগ্র ডিকেন্স সাহিত্যে অসংখ্য কমিক চরিত্র আছে। এদের অনেকেই অদ্ভুত ধরনের নর-নারী। খেয়ালি স্বভাব এসব চরিত্রে যোগ করেছে অনন্য মাত্রা। বেট্সি ট্রটউড চরিত্রটির কথা আবার মনে পড়ল। ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ উপন্যাসে ডেভিডের মায়ের কন্যা সন্তান হবে এ রকমটা ধরে নিয়ে এই মহিলা তার বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু পুত্র সন্তান হয়েছে এ খবর শোনামাত্র দৌড়ে পালিয়ে যান। এ ধরনের আচরণ সত্যিই অদ্ভুত; ব্যতিক্রমীও। এমনি এক আজব চরিত্র এৎবধঃ ঊীঢ়বপঃধঃরড়হং উপন্যাসের জো গার্গেরি। জো শক্ত-সমর্থ পুরুষ, কিন্তু তার দুর্বলতাও আছে। মেজাজি স্ত্রীকে সে সব সময় ভয় পায়। এসব অস্বাভাবিক, পাগলাটে ধরনের চরিত্র অসাধারণ নৈপুণ্যে তুলে এনেছেন ডিকেন্স। শরৎচন্দ্র ও ডিকেন্স কেউই বুদ্ধিজীবী ঘরানার লেখক ছিলেন না। পা-িত্য এদের লেখার স্বভাববৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু এরা জীবনকে নানা দিক থেকে নানাভাবে উপলব্ধি করেছেন। দু’জনেই পাঠককে অনাবিল আনন্দ দিতে চেয়েছেন; সফলও হয়েছেন। আবার মনুষ্যত্বের গৌরবকে অক্ষুণœ রাখতেও সচেষ্ট ছিলেন সর্বদাই। জীবনের প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে ক্ষমা এবং ঔদার্যের ভূমিকা অত্যন্ত গঠনমূলক। জনপ্রিয়তা কখনও কখনও লেখকের ভাবমূর্তিকে খাটো করে, ঠিক যেমনটা এক সময় হয়েছিল সমারসেট মম, ডিএইচ লরেন্স প্রমুখের বেলায়। এরা ছিলেন একই সঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত। সুদীর্ঘকাল বঞ্চিত ছিলেন। যথার্থ স্বীকৃতি থেকে। শরৎ ও ডিকেন্সের ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি। অল্প শিক্ষিত, সাধারণ পাঠকের মন জয় করেন যে সব লেখক, তাদের রচনারও মান সাধারণ- এ রকম ধারণা চালু আছে সাহিত্যের জগতে। কিন্তু সব সময় সেটা ঠিক নাও হতে পারে। যে সাহিত্যের একই সঙ্গে পশ্চাৎপদ এবং প্রাগ্রসর পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে, সময়ের কামড় সহ্য করে তারই টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ডিকেন্স ও শরৎচন্দ্র উভয়ের বেলাতেই সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। ভাবালুতা, অতিভাষিতা, বিষয়বস্তুর মামুলিত্ব- এসব ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়েও জীবনকে যতটা বিস্তৃত পরিসরে দেখেছেন এই দুই লেখক, যেভাবে মানুষের নিচতা ও মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, বিরল ক্ষমতার অধিকারী না হতে পারলে তা করা আদৌ সম্ভব নয়। আর সে জন্যই ইন্টেলেকচুয়াল ও সাধারণ দু’রকম পাঠকের কাছেই সাদরে গৃহীত হয়েছেন তারা।
×