ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জনকণ্ঠের সঙ্গে নন্দিত শিল্পী নন্দিতা দাস

মি টু # আন্দোলন অনিবার্য ছিল- এটি পুরুষবিরোধী নয়

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৯ নভেম্বর ২০১৮

মি টু # আন্দোলন অনিবার্য ছিল- এটি পুরুষবিরোধী নয়

মনোয়ার হোসেন ॥ বলিউডের নন্দিত অভিনেত্রী ও নির্মাতা নন্দিতা দাস। বহুমাত্রিক প্রতিভাময়ী এই নারীর আরেক পরিচয় সামাজিক আন্দোলনের অধিকারী কর্মী। দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে তিনিও অতিথি হয়ে এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে। এই উৎসবের প্রথম দিনে প্রদর্শিত হলো পাকিস্তানী লেখক সাদাত হাসান মান্টোকে নিয়ে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মান্টো’। উৎসব আঙ্গিনা বাংলা একাডেমিতে সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী এই শিল্পীর সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের এই প্রতিনিধির। সেখানে তিনি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন, সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। হ্যাশ ট্যাগ মি টু আন্দোলন প্রসঙ্গে নন্দিতা দাস বলেন, প্রকৃত অর্থে আমাদের সমাজটা পুরুষপ্রধান। উপমহাদেশসহ সারাবিশ্বে কখনই নারীর অধিকার পুরুষের সমান ছিল না। তাই এই আন্দোলনটা অনিবার্য ছিল। এটা খুব ভাল বিষয় যে দেরিতে হলেও আন্দোলনটা গড়ে উঠেছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সত্যিকার অর্থেই যে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের নিয়েই এই আন্দোলন। সেসব মেয়েদের যুক্ত হতে হবে এই আন্দোলনের সঙ্গে। তাই বলে এটার অপব্যবহার যাতে না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রকৃত অর্থে হ্যাশট্যাগ মি টু পুরুষবিরোধী নয়, এটি আসলে ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আলাপকালে ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলায় কথা বলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে নন্দিতা দাস বলেন, আমি বাঙালী নই, তাই ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাতেই কথা বলব। উর্দু ভাষার প্রখ্যাত লেখক সাদাত হাসান নিয়ে নির্মিত ‘মান্টো’ চলচ্চিত্র নিয়ে নন্দিতা বলেন, ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। তারপর ছবিটি ঘুরে বেড়িয়েছে সিডনি থেকে লন্ডন পর্যন্ত নানা উৎসবে। তবে ঢাকাতেই ছবিটি প্রথম পাবলিক প্রিমিয়ার বা সর্বসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবির প্রযোজক বলছিল, ঢাকায় প্রদর্শনীর কারণে ছবিটি পাইরেসি হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কি না? আমি তাকে বলেছিলাম, আমার বিশ্বাস আছে, এখানে তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। এই প্রদর্শনীর পর আমরা সারাবিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে ছবিটির জন্য বিপণন করব। আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব ঢাকা লিট ফেস্ট প্রসঙ্গে নন্দিতা বলেন, এবারই প্রথম নয়, ২০১২ সালে আমি এই উৎসবে সংযুক্ত হয়েছিলাম। এখন এসে দেখছি দিনে দিনে উৎসবের কলেবর বাড়ছে। এবার আরও ভাল লাগছে যে, মান্টোর গল্পটা আমি সবাইকে দেখাতে পারছি। আপন সৃষ্টির মাধ্যমে ৭০ বছর আগেও মান্টো যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক। ভারতসহ সারাবিশে^ সত্য তুলে ধরার আন্দোলনে যারা সংগ্রাম করছেন তাদের কথাগুলোই উঠে এসেছে মান্টোর জবানীতে। সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক প্রসঙ্গে নন্দিতা বলেন, তুলনামূলকভাবে কম চলচ্চিত্রই সাহিত্যকে আশ্রয় করে নির্মিত হয়েছে। আমার জানামতে, এখন পর্যন্ত ভারতে সাহিত্যনির্ভর কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। সেইদিক থেকে মান্টোই সাহিত্যনির্ভর প্রথম হিন্দী চলচ্চিত্র। একটি সাক্ষাতকারে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মান্টোই কি সাহিত্য থেকে নেয়া প্রথম হিন্দী চলচ্চিত্র? তখন আমার মনে পড়ে মান্টোই নিজে মির্জা গালিবকে নিয়ে একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। আর এবার তাকে নিয়ে আমি ছবি বানালাম। এটা আমার মধ্যে উদ্দীপনা জাগায় যে, তিনি নিজেকে কখনও এ্যাক্টিভিস্ট ভাবতেন না। কিন্তু তিনি তার গল্পের মধ্য দিয়ে সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে নন্দিতা বলেন, এবার উৎসবে আসার সময় আমার আট বছরের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে যে ভালবাসাটা পেলাম সেটা শেয়ার করব ওর সঙ্গে। ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব ঢাকা শহরের চারপাশে। ৪৮ বছর বয়সী নন্দিতা দাসের জন্ম ১৯৬৯ সালে মুম্বাই নগরে। হিন্দী চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে নামের সঙ্গে যুক্ত নন্দিত অভিনেত্রীর পরিচয়টি। হিন্দী ভাষার পাশাপাশি এই অভিনেত্রী তিনটি বাংলা ছবি ছাড়াও মালায়ালাম, তামিল, উর্দু, রাজস্থানী, কনড়সহ ভারতের অজস্র আঞ্চলিক ভাষার সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এ পর্যন্ত দশটি ভাষার চল্লিশটির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে ফায়ার, ১৯৪৭ আর্থ, বাওয়ান্দার, আজাগি, বিফোর দ্য রেইনস অন্যতম। নন্দিতা দাসের সমাজ ও রাজনীতি-সচেতনতা তার সিনেমায় স্পষ্ট। পরিচালনা বা অভিনয়ের ক্ষেত্রে খুব বাছাই করে কাজ করেন তিনি। তার অভিনীত ১৯৯৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দী ভাষার সিনেমা ‘১৯৪৭ আর্থ’-এ অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিষেক অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ২০০৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত মালায়ালাম-ইংরেজী সিনেমা ‘বিফোর দ্য রেইন’ মূলত ভারতের ইংরেজ শাসন এবং এর প্রভাবকেন্দ্রিক। নন্দিতা দাস পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ফিরাক’ একই সঙ্গে হিন্দী, উর্দু এবং গুজরাটি ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল ২০০৮ সালে। ‘ফিল্মফেয়ার স্পেশাল এ্যাওয়ার্ড’সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার জিতে নেয় সিনেমাটি। পরিচালক হিসেবে ‘মান্টো’ তার তৃতীয় সিনেমা (পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার হিসেবে দ্বিতীয়)। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৯ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ‘অড্রে দেস আর্টস এট দেস লেটারস’ সম্মাননায় ভূষিত করে। নন্দিতা দাস প্রথম ভারতীয় যিনি শিল্পকলায় অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী ফোরামের নিকট থেকে সম্মানিত হন। এ ছাড়াও চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘এশিয়ান ফেস্টিভ্যাল অব ফার্স্ট ফিল্ম পুরস্কার’, ‘নন্দী পুরস্কার’, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব কেরালা পুরস্কার’সহ অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও তিনি দুইবার কান চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
×