ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার...

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৮ নভেম্বর ২০১৮

সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার...

জন্ম নিলে চলে যেতে হয় বুঝি! এমন নির্মম সত্য জেনেও আমরা আগামীর পথে হাঁটি, কারণ চলতে হয়। এটাই বোধহয় জীবনের নিয়ম। জীবন তো ছুটে চলে বহতা নদীর মতো। ঠিক তেমনি ছুটে চলতেন আবৃত্তির জাদুকর হিসেবে পরিচিত রণজিৎ রক্ষিত। এই গুণীজনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে। বাবা বিপ্লবী যতীন্দ্রমোহন রক্ষিত ও মা রানী রক্ষিত। ষাটের দশকে নিয়মিত আবৃত্তিচর্চার পাশাপাশি নাট্য আন্দোলনেও সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৬৫ সালে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর কুনজরে পড়েন এবং কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম সহায়ক সমিতির সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের ‘যায় দিন ফাগুন দিন’ এ মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তখন থেকে গণায়ন ও নান্দীকার নাট্য সম্প্রদায়ে কাজ করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারে নিয়মিত কাজ করেন রণজিৎ রক্ষিত। অভিনয় করেন চারটি টেলিফিল্মে। তিনি দেশের বাইরে ভারত, যুক্তরাজ্য, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে আবৃত্তি পরিবেশন করে সমাদৃত হন। সম্মাননা দিয়ে তাকে সম্মানিত করে সুচেতনা কলকাতা, স্বনন ঢাকা, প্রমা, অবসর, বান্ধব পাঠাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ, বর্ণ আবৃত্তি সংসদ, বিশ্বজনীন শান্তি সংঘ, মোপলেসসহ নানা সংগঠন। তিনি মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল এ্যান্ড কলেজে ৪১ বছর জীববিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ, প্রবর্তক সংঘসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের আজীবন সদস্য। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের আমন্ত্রণে রণজিৎ রক্ষিত ভারতের কলকাতা ও বর্ধমানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন। এই গুণীজন গত ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরলোক গমন করেন। সংস্কৃতির বিকাশের জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই আবৃত্তিজন। তার শেষ দিন গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় নগরের আগ্রাবাদে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষ করে লিফটে নামার সময় স্ট্রোক করেন তিনি। তার প্রয়াণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহ-সভাপতি ও বোধন আবৃত্তি স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। নিজের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের অপূর্ণতা রেখেই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতকে একা ফেলে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন এই গুণী আবৃত্তি শিল্পী। আবৃত্তিজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন ঠিক এই ভাবেÑ ‘রণজিৎ রক্ষিত সুহৃদ্বরেষু- সকলকেই যেতে হবে, তাই বলে এইভাবে!’ রূপা চক্রবর্তী তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেন- প্রিয় রণজিৎ রক্ষিত দাদা, আপনার অকাল প্রয়াণ আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি। আমরা প্রার্থনা করেছি, প্রতীক্ষা করেছি। কিন্তু আপনাকে জীবনের কাছে ফেরাতে পারিনি। ’৮৭ তে প্রথম দেখেছিলাম। ’৯৫ তে প্রথম গিয়েছিলাম আপনার বাসায় অতিথি হয়ে। আপনার স্নেহ থেকে কখনও বঞ্চিত হইনি। আপনাকে হারানোর যাতনায় আমরা শোকাতুর। স্বননের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা আপনার জন্যে। ভালবাসা সকল আবৃত্তি শিল্পীর পক্ষ থেকে। আপনার পরিবার কেবল নয়, জাতি হারিয়েছে তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। শিল্প হারিয়েছে এক অকৃত্রিম বান্ধবকে। জীবনের ওপারে গিয়ে দেখুন আমাদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে। শান্তিতে থাকুন। আপনার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। শোকসন্তপ্ত সকলকে সমবেদনা জানাই। এক মহৎপ্রাণ শিল্পীকে হারিয়ে আমরা কাতর হয়ে আছি। আবৃত্তিজন শিমুল মুস্তফা তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন ঠিক এই ভাবে- ‘আমাদের মাথা থেকে আরেকটি ছায়া সরে গেল। আমি এখন কার জন্য চট্টগ্রাম যাবো? ‘প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, রণজিত রক্ষিত কবিতাকে আবৃত্তির ভাষায় আলাদা শিল্পরূপ দিয়েছেন। তাঁর ভরাট কণ্ঠ কবিতার নিভৃত বাণীকে জনারণ্যে পৌঁছে দিয়েছে। এই কণ্ঠ প্রেম-দ্রোহ-বিপ্লব-সংগ্রামে কখনও স্থিমিত হবে না। আমরা বয়সে প্রবীণ, তবে কে কার আগে হারিয়ে যাব তা জানি না।
×