ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে মাত্র ২ ভাগ কিডনি বিকল রোগীর প্রতিস্থাপন সম্ভব

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৮ নভেম্বর ২০১৮

দেশে মাত্র ২ ভাগ কিডনি বিকল রোগীর প্রতিস্থাপন সম্ভব

নিখিল মানখিন ॥ দেশে প্রতিস্থাপনকারী কিডনি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীদের মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট। সংশোধিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে কিডনি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নতুন কিছু সুবিধা সংযোজন করা হলেও কিডনিদাতা সঙ্কট রয়ে গেছে। কিডনি বিকল রোগীদের অনেকে নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকল রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মৃত্যুর মুহূর্ত দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকছে না রোগীর স্বজনদের। জটিল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ॥ বহুল আলোচিত মানবদেহে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পাস হয়েছে। পাসকৃত বিলে বলা হয়েছে, কোন হাসপাতাল সরকারের অনুমতি ছাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না। এই আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এই চিকিৎসা সেবা দিতে অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। তবে সরকারী হাসপাতালের বিশেষায়িত ইউনিটে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের ক্ষেত্রে অনুমতি লাগবে না। পাস হওয়া আইনে বলা হয়েছে, সুস্থ ও স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির চোখ ছাড়া অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিযুক্তির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকলে তিনি নিকটাত্মীয়কে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন ও প্রতিস্থাপনে নিকটাত্মীয় হওয়ার প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান আইনে শুধু পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা এই ১২ জন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়াও আইনে ‘নিকট আত্মীয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি, আপন চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাই-বোনেরাও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারবেন। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও অন্যের শরীরে সংযোজন করা যাবে। বিলে ‘অঙ্গ প্রত্যঙ্গে’র সংজ্ঞায় মানবদেহের কিডনি, হৃৎপি-, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোন অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গকে বোঝানো হয়েছে। কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রয়োজনের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি দানে আইনী জটিলতা এবং আগ্রহী ব্যক্তির স্বল্পতার কারণে তা প্রতিস্থাপন অনেকাংশে আটকে আছে। ১৯৮২ সালে দেশে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলেও নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। এ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫টি কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, এর মধ্যে শিশুদের ১১টি। ২৯ বছরের হিসাবে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মাত্র ১৭টি বা প্রতি দুই মাসে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আছে। দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। প্রতি বছর কিডনিজনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার রোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়েছে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীদের মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশুদ্ধ খাবার ও পানি পান করতে হবে। রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিতে হবে। ইনফেকশন হলে তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হবে। তিনি আরও জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করা হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৮শ’ টাকা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে লাগে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দুদিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দুটি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দুটি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০ এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দুটি ইনজেকশন দিতে হয়। এই প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে হওয়ার কারণে ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। তাই ওই দুটি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে।
×