ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ট্রাম্প না মানলেও তেল কোম্পানি মানছে

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৭ নভেম্বর ২০১৮

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ট্রাম্প না মানলেও তেল কোম্পানি মানছে

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি বার বার প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই চুক্তির পিছনে যেসব বৈজ্ঞানিক যুক্তি কাজ করেছে সেগুলোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তেল কোম্পানিগুলো ট্রাম্পের বিপরীত পথে অগ্রসর হয়ে বলেছে যে তারা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুটির মোকাবেলা করতে চায়। কার্বন নিঃসরণ জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব রাখবে তা পারমিয়ান বেসিনের কিছু কিছু তেল কোম্পানি স্বীকার করেছে। বলাবাহুল্য পারমিয়ান বেসিন হলো যুক্তরাষ্ট্র তেল উৎপাদনে জোয়ার সৃষ্টির ক্ষেত্র। ওখানেই চলছে অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানির বড় ধরনের কর্মকা-। পারমিয়ান বেসিনের তেল যে কেউ আশাই করতে পারে যে হাজারো কাজে ব্যবহার হবে। এই তেলে গাড়ি চলবে, জেট বিমান চলবে। অসংখ্য ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হবে এই তেল। এই তেল পোড়ানো থেকে নির্গত হবে কার্বন ডাই অক্সাইড যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ, তবে অক্সিডেন্টাল কোম্পানি যদি তার দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকল্প বাস্তবায়নে সফল হয় তাহলে এই এলাকার তেল ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদিত তেল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরোলেও তা বায়ুম-লে মিশবে না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বনের কোন ভূমিকা থাকবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে তেল ব্যবহৃত হবে, কার্বন উদগীরণ হবে অথচ বায়ুম-লে যাবে না এ আবার কেমন কথা? তেলের কার্বন অংশটা কোথায় যাবে? অক্সিডেন্টাল কোম্পানির জন্য এই অঙ্কের হিসাবটা সোজা। টেক্সাস সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইল দূরে এই তেল ক্ষেত্রগুলো এমন এক এলাকায় যে এলাকার তেল পরীক্ষা করে অলাভজনক বলে গণ্য হয়েছিল। অক্সিডেন্টাল কোম্পানি এই ক্ষেত্রের উৎপাদিত তেল পোড়ানো হলে তেলের কার্বন অংশটা আলাদা করে ধারণ করে সেটা তেল খনির ভিতর ফুকিয়ে দিয়ে তেলকে কার্বন থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে কার্বন মাটির তলেই মজুদ থাকছে। ফলে তা জলবায়ু পরিবর্তনে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোম্পানি এভাবে ওখানে বছরে যে পরিমাণ কার্বন মাটির তলে মজুদ করছে তা হাওয়াই বা মেইনের মতো ছোট রাজ্যগুলোয় যে পরিমাণ তেল বায়ুম-লে গিয়ে মিশছে তার সমান। অক্সিডেন্টাল এই প্রক্রিয়াটি কয়েক বছর ধরে কাজে লাগিয়ে আসছে। কিন্তু কোম্পানি এখন সেটাকে প্রসারিত করতে এবং ভূগর্ভে মজুদ করা মানুষের তৈরি কার্বনের পরিমাণ বাড়াতে চাইছে। এই প্রক্রিয়া ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মতো কার্বন ধরে রাখার প্রযুক্তিটিই হলো জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা সমাধানের প্রধানতম উপায় বলে দাবি করেছে কোম্পানি। তারা বলেছে, প্যারিস চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে কার্বন নির্গমন আটকে রাখতে না পারলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রী বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার কোন উপায় নেই। কার্বন আটকে রাখার ক্ষেত্রে অক্সিডেন্টাল একা নয়। আরও আছে। নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মীরা তেল কোম্পানিগুলোর প্রতি কি ভূমিকা নেয়া যায় তা নিয়ে যখন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে সে সময় এই উদ্যোগ একথা নেয়া হলো তেল কোম্পানির তরফ থেকে। একদিকে বিজ্ঞান দেখিয়ে দিচ্ছে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে হলে বিশ্বকে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। অথচ বিশ্ব অর্থনীতির সিংহভাগই এই তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এই উত্তরণ কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই উপলব্ধি থেকেই তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাটি মোকাবেলায় সমাধানের অংশ হিসেবে নিজেরাই উদ্যোগ নিতে এগিয়ে এসেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর অক্সিডেন্টাল, এক্সন-মোবিল ও শেভরন আনুষ্ঠানিকভাবে অয়েল এ্যান্ড গ্যাস ক্লাইমেট ইনিশিয়েটিভ (ওজিসিআই) নামে একটি কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে। এটি হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জ্বালানি কোম্পানিগুলোর কোয়ালিশন। গ্রুপটি কার্বন নির্গমন হ্রাসে সম্ভাবনাময় উদ্যোগে অর্থায়নের জন্য ১শ’ কোটি ডলার নিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। গ্রুপটি দ্বিতীয় সর্বাধিক বিদ্যমান গ্রীনহাউস গ্যাস মিথেনের নির্গমন ২০১৫ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এই উদ্যোগ ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপের ঠিক বিপরীতে। সম্প্রতি তাঁর প্রশাসন মিথেন গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবেশ রক্ষা সংস্থার (ইপিএ) একটি বিধি এড়িয়ে গেছে। কার্বন ডাই অক্সাইডকে ধারণ করে পরে তা ভূগর্ভে মজুদ করার যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির কথা আগে বলা হয়েছে তা জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত শিল্প ও বিদ্যুত কেন্দ্রের বড় বড় উৎস কেন্দ্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এসব কেন্দ্রে তেল বা গ্যাস ব্যবহারের ফলে যে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় তা বিশেষ ব্যবস্থায় ধারণ করে রাখা হয়। পরে তা মজুদ করার স্থানে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত সেই স্থানটি হলো ভূগর্ভস্থ কোন স্তর যেখান থেকে ঐ কার্বন কোনভাবেই বায়ু ম-লে এসে মিশবে না। কিংবা সাগরের জলরাশিতে মিশে অম্লত্ব বাড়াবে না। গত কয়েক দশক ধরে কার্বন ডাই অক্সাইড বিভিন্ন উদ্দেশে ভূগর্ভে প্রবেশ করানো হয়েছে। তবে দীর্ঘকালের জন্য এই গ্যাসকে ভূগর্বে রেখে দেয়া এক নতুন ধারণা। সেটারই প্রয়োগ করছে অক্সিডেন্টাল ও অন্যান্য কোম্পানি। এটা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে একটা কার্যকর কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আন্দোলনরত অনেক পরিবেশবাদী ও নীতিনির্ধারক তেল কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে সন্দিহান। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার উদ্যোগকে বিজ্ঞান সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য প্রচারসহ অন্যান্য কৌশলে মন্থর করে নেয়ার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে এই তেল শিল্পের। আজও অনেক তেল কোম্পানি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে একটা বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করলেও সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে তাদের নিজেদের বিবিধ ধরনের তথ্য পরিবেশনের সময় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ বিধিকে সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। কর্পোরেট একাউন্টিবিলিটি নামে এক পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মী জেসি ব্র্যাগ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবেলার সর্বোত্তম উপায়টি হলো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ব্যাপকভাবে হ্রাস করা। আর এই কাজে তেল কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে হবে। এখন বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছে যে এই একই তেল কোম্পানিগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা সমাধানের অংশীদার হতে চায়। তারা দেখতে পাচ্ছে যে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি আসছে। তাই তারা ভাবছে যে এমন সমাধান বের করতে পারাই শ্রেয় যেখানে তাদের তেলের ব্যবসা অব্যাহত রাখার সুযোগ থাকবে। বলাবাহুল্য সেই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে ট্রাম্প পিছু হটা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী তেল আইরন কাজের নেটওয়ার্ক আছে এমন কোম্পানিগুরোকে ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে কঠোর সব বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেল শিল্পের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্রে এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ নিতে ডেমোক্রেট বা মডারেট রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে খুব বেশি বিলম্ব হবে না। অক্সিডেন্টাল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ভিকি হোলার বলেন, শেষ পর্যন্ত একটা কার্বন মূল্য অর্থাৎ কার্বন নির্গমন হলে তার জন্য অর্থদ- দিতে হবে। সেটাই যদি হয় তাহলে অক্সিডেন্টালের স্ট্র্যাটেজি সার্থক বলে প্রমাণিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিয়োজিত সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ বাস্তববাদী সদস্য বলেন, যেখানেই সম্ভব তারা তেল, গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে রাজি। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংস্থার প্রধান প্যাট্রিসিয়া এসপিনোসা চলতি বছর তেল ও গ্যাস সম্মেলনে একথা বলেন। কিন্তু অন্যরা বলেন, তেল ও গ্যাস শিল্পের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটা প্রয়োজন। তাদের মতে বড় বড় তেল কোম্পানিকে কার্বন নির্গমন কতটুকু হলো বা হচ্ছে তা বের করার এবং এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পরিবেশন করার জন্য আরও উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই ঐ কোম্পানিগুলোর জলবায়ু কর্মসূচীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে। সূত্র : টাইম
×