ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

টেস্টে হোল্ডারের স্বপ্নের বছর

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ৭ নভেম্বর ২০১৮

টেস্টে হোল্ডারের স্বপ্নের বছর

ভারত সফরের শুরুতেই বিধ্বস্ত উইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে ‘হোয়াইটওয়াশ’ ২-০ ব্যবধানে। দলটির সাম্প্রতি পারফর্মেন্স মোটেই সুখকর নয়। ২০১৯ বিশ্বকাপের টিকেটের জন্য বাছাই খেলতে হয়েছে এক সময়ের পরাক্রমশালী ক্যারিবীয়দের। অথচ দলের কঠিন সময়ে বল হাতে দারুণ ধারাবাহিক জেসন হোল্ডার। একসময় ক্রিকেট বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াতেন উইন্ডিজ পেসাররা। নব্বইয়ের দশকেও পিচে আগুন ঝরাতেন কার্টলি এ্যামব্রোস-কোর্টনি ওয়ালশ। সেই দিন আর নেই। গতি হারিয়েছে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট। এই হতাশর মধ্যেও যেন সুদিনের বাতাস এনে দিলেন অধিনায়ক হোল্ডার। গড়লেন গত ১০০ বছরের মধ্যে পেসারদের মধ্যে এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে কম গড়ের নতুন রেকর্ড। হায়দরাবাদ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক। এ নিয়ে চলতি বছর ১১.৮৭ গড়ে ৩৩ উইকেট পূর্ণ করেন হোল্ডার। বছরে কম পক্ষে ৩০ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে যা গত ১০০ বছরে সেরা গড়ের নতুন নজির! চলতি ২০১৮ সালে এ পর্যন্ত ৬ টেস্ট খেলেই এমন কীর্তি গড়েছেন মাঠের ক্রিকেটে ধুঁকতে থাকা উইন্ডিজ সেনাপতি। এক্ষেত্রে আগের রেকর্ডটা শোয়েব আকতারের। ২০০৩ সালে ৩০ উইকেট নেয়া সাবেক পাকিস্তান স্পিডস্টারের গড় ছিল ১২.৩৬। তবে গড়ের বিষয়টি বাইরে রাখলে বছরে সর্বোচ্চ ৬২ শিকারের রেকর্ড কিন্তু ইমরান খানের, ১৯৮৬ সালে দুর্দান্ত মৌসুম কাটানো বর্তমান পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের গড় ছিল ১৩.২৯। টানা তৃতীয়বারের মতো ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন হোল্ডার। ইনজুরি সত্ত্বেও চলতি বছরে মাত্র ৬ টেস্ট খেলেই শিকার করেছেন ৩৩, এর মধ্যে ৪ বার ইনিংসে ৫ উইকেট। ভারত সফরে টেস্ট সিরিজে এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন হোল্ডার। সেগুলো দেখে নেয়া যাকÑ ভারতের মাটিতে কোন ক্যারিবীয় পেসারের ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার ঘটনা ঘটেছিল সবশেষ ১৯৯৪ সালে। সে বছর মোহালি টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন ক্যানি বেঞ্জামিন। ২৪ বছর পর আবার এ কীর্তি দেখালেন হোল্ডার। এছাড়া চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন হোল্ডার। যার সবগুলোই তার সবশেষ চার টেস্টে। ২০০০ সালে কোর্টনি ওয়ালশের পর প্রথম ক্যারিবীয় পেসার হিসেবে এক পঞ্জিকা বর্ষে চারবার ৫ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়ে হোল্ডার। ১১.৮৭- গত একশ’ বছরে এক পঞ্জিকাবর্ষে কমপক্ষে ৩০ উইকেট নেয়া পেসারদের মধ্যে সেরা গড় এখন হোল্ডারের। এছাড়া সময়সীমা ৫০ বছরে নামিয়ে আনলে সব বোলারদের মধ্যেই সেরা গড় তার। ইতিহাসের মাত্র পঞ্চম অধিনায়ক হিসেবে ভারতের মাটিতে ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েছেন হোল্ডার। তার আগে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, রিচি বেনো, ফজল মাহমুদ ও কোর্টনি ওয়ালশ এ কীর্তি দেখিছিলেন। ‘অতীতে আরও শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ভারতে এসে টেস্ট সিরিজ জিততে পারেনি। ব্রায়ান লারার মতো তারকাও পারেননি। সেদিক থেকে দেখলে এই দলে অনেক বেশি তরুণ ক্রিকেটার রয়েছে। অভিজ্ঞতা কম।’ কঠিন সময়ের উইন্ডিজ সেনাপতি। হোল্ডার আরও যোগ করেন, ‘আমাদের নিয়ে কড়া সমালোচনা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আমরা কিন্তু ধীরে ধীরে উন্নতি করছি। গত পাঁচ সিরিজের মধ্যে দুটিতে জিতেছি। তারপরেও লোকজন কেন এত সমালোচনা করছে সেটা বুঝতে পারছি না!’ উইন্ডিজকে নিয়ে সম্ভবত ক্রিকেটপ্রেমীদের খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। প্রথম টেস্টে শোচনীয় হারের পর সিরিজের ফলটাও হয়ে উঠেছিল অনুমিত। তবে বছরজুড়ে দারুণ বোলিংয়ে ক্রিকেটবিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছেন জেসন হোল্ডার। তবে সিরিজ হারের পাশাপাশি অভিষেকেই দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে হোল্ডারকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছেন পৃথ্বী শ’। মাত্র ১৮ বছর বয়সে অনেক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছেন ভারতীয় ওপেনার। দুর্বল উইন্ডিজের বিপক্ষে ভারত যে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতবে, সে বিষয়ে কারওরই বোধ হয় সন্দেহ ছিল না। আগ্রহের বিষয় ছিল, তরুণ পৃথ্বী শ তাঁর অভিষেক টেস্ট সিরিজে কী রকম খেলেন। সিরিজে পৃথ্বীর পরিসংখ্যান এ রকম: একটি সেঞ্চুরিসহ মোট ২৩৭ রান, গড় ১১৮.৫০! স্বাভাবিকভাবেই তিনিই সিরিজের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন। পাশাপাশি আরও ‘পুরস্কার’ থাকছে এই তরুণ ব্যাটসম্যানের জন্য সাবেক ক্রিকেটারদের কাছ থেকে পাওয়া উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। তবে ভারতীয় কোচ রবি শাস্ত্রীর কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্র পেয়েছেন এই তরুণ ব্যাটসম্যান, তা সব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে ‘পৃথ্বীর ব্যাটিং দর্শকদের কাছে বিনোদনের একটা বড় মাধ্যম। পৃথ্বী যখন ব্যাট করে, তখন ওর মধ্যে একটু শচীন, একটু শেহবাগের ছায়া দেখা যায়। আবার ও যখন হাঁটে, তখন পৃথ্বীর মধ্যে ব্রায়ান লারার একটা আদল চোখে পড়ে।’ শাস্ত্রী আরও বলেন, ‘পৃথ্বীর জন্মই হয়েছে ক্রিকেট খেলার জন্য। সেই আট বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে ও। মুম্বাইয়ের ময়দানে এক দশক খেলা হয়ে গেছে। ওর ব্যাটিং দেখলেই বোঝা যায়, দর্শকরা কতটা আনন্দ পায়।’ তবে সতর্কবার্তাও রয়েছে শাস্ত্রীর, ‘পৃথ্বীর মাথা যদি ঘুরে না যায়, আর পরিশ্রমের সঙ্গে কোনও সমঝোতা না করে, তা হলে ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল।’ রাজকোটে সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে খেলেছেন ১৩৪ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। পৃথ্বীর অভিষেক যাঁর সঙ্গে সব চেয়ে বেশি করে তুলনা চলে আসছিল, সেই শচীন টেন্ডুলকরও আবেগাপ্লুত উত্তরসূরির ব্যাটিং দেখে, ‘জীবনের প্রথম ইনিংসেই তোমার থেকে এ রকম আগ্রাসী ব্যাটিং দেখে ভাল লাগল। এই রকম ভয়ডরহীন ব্যাটিংই করে যাও।’ টুইটারে লিখেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি। শুধু ভারতীয় ক্রিকেটাররাই নন, বিদেশের মাটি থেকেও এসেছে অভিনন্দনবার্তা। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভন যেমন লিখেছেন, ‘১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে কী খেলল পৃথ্বী! দেখে মনে হচ্ছে, আরও একজন ভারতীয় মহাতারকা এসে গেল।’ অভিষেক টেস্টে পৃথ্বীর চেয়ে কম বয়সে (১৮ বছর ৩২৯ দিন) আর কোন ভারতীয় সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। তবে তার চেয়ে কম বয়সে ভারতের পক্ষে শতক হাঁকানোর রেকর্ডটা শচীনের। প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার জন্য বিন্দুমাত্র অস্বস্তি ছিল না তার মধ্যে। এর কারণ তার কিশোর বয়স থেকে দুর্দান্ত কিছু রেকর্ড। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ক্রিকেটের এক ইনিংসে ৫৪৬ রান, ১৭ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকে নেমেই সেঞ্চুরি, সর্বশেষ প্রথম শ্রেণীর আসরে ৫টি সেঞ্চুরি। এমন রেকর্ডগুলো যার দখলে তিনি কোনভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার মতো অবস্থানে নেই সেটা ক্যারিবীয় বোলাররা হাড়ে-হাড়েই টের পেয়েছে। পৃথ্বি তুলে নেন ৯৯ বলে সেঞ্চুরি। টেস্ট অভিষেকে এটি তৃতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। এর আগে শিখর ধাওয়ান ৮৫ বলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহালিতে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডোয়াইন স্মিথ ৯৩ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন অভিষেকে। তবে অভিষেক টেস্টে তারচেয়ে কম বয়সে কোন ভারতীয় ব্যাটসম্যান শতক হাঁকাতে পারেননি। আব্বাস আলী বেগ ১১২ রান করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওল্ডট্র্যাফোর্ডে ১৯৫৯ সালে। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর ১২৬ দিন। অবশ্য ভারতের হয়ে টেস্টে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড শচীনের। তিনি ১৭ বছর ১০৭ দিন বয়সে হার না মানা ১১৯ করেন ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯০ সালে। পরবর্তী দুটি রেকর্ডও তারই দখলে, ১৮ বছর ২৫৩ দিনে ১৯৯২ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৮ এবং একই সিরিজে পার্থে ১৮ বছর ২৮৩ দিন বয়সে ১১৪ রান করেছিলেন। এরপরই পৃথ্বির অবস্থান।
×