ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ম’ তে মহসিন ‘ম’ তে মোহামেডান

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ৭ নভেম্বর ২০১৮

‘ম’ তে মহসিন ‘ম’ তে মোহামেডান

১৯৮২ সালের ঢাকা ফুটবল লীগের প্রথম পর্বের ম্যাচ চলছে। মুখোমুখি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের দুই দিকপাল, চির প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা মোহামেডান বনাম ঢাকা আবাহনী। বাবা ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে পেনাল্টি পেয়ে যায় আবাহনী। ছেলে মোহামেডানের গোলবারে দাঁড়িয়ে। পেনাল্টি যিনি নিতে আসছেন তিনি দেশ সেরা স্ট্রাইকার আবাহনীর কাজী সালাহউদ্দিন। বাবা দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে আছেন। কারণ স্পষ্ট, বাবা হয়ে স্টেডিয়াম ভর্তি সমর্থকদের সামনে ছেলের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখতে পারবেন না। মুহূর্তের মধ্যে মোহামেডান গ্যালারি থেকে ভেসে আসা বিকট আওয়াজ বলে দিয়েছিল তার ছেলে জয়ী হয়েছে। চোখ খুলে হাজারো মোহামেডান সমর্থকদের সঙ্গে তিনিও চিৎকার চেঁচামেচিতে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু চোখ ঢেকে রাখার আফসোস বাবাকে বহুদিন যন্ত্রণায় ভুগিয়েছিল। সেই চোখ ঢেকে রাখা বাবা ছিলেন মুসলেম উদ্দিন এবং ছেলে ঢাকা মোহামেডানের গোল বারে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব হওয়া মোহাম্মদ মহসিন। ঢাকা ফুটবলের সমর্থকদের কাছে গোলরক্ষক মহসিন নামে যিনি আজও পরিচিত। মহসিন ঘরোয়া ফুটবলে যেমন সুনামের সঙ্গে খেলেছেন তেমনি খেলেছেন আন্তর্জাতিক ম্যাচে। ১৯৮২ সাল থেকেই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়। সেটা ছিল বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে কিন্তু সেবার মাঠে নামা হয়নি। তবে সে বছরই দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে মাঠে নামার সুযোগ হয়। নিয়মিত গোলরক্ষক মোতালেব প্রথম ম্যাচে ভারতের সঙ্গে ভাল খেলতে না পারার কারণে দ্বিতীয় ম্যাচে চীনের বিপক্ষে মাঠে নামানো হয় মহসিনকে। চীনের কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হয় বাংলাদেশ তবে মহসিন খেলেন দারুণ। তাছাড়া ১৯৮৮ সালে তেহরানে ইরানের বিপক্ষে এবং ১৯৯৬ সালে আরব আমিরাতের বিপক্ষে যদিও ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দারুণ খেলেছিলেন গোলরক্ষক মহসিন। মহসিন ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ২৪তম এশীয় যুব ফুটবলের গ্রুপ ২ এর বাছায় পর্ব, ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আযম ট্রফি, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল, সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সাদা দল, ১৯৯১ সালে সিউল ও কুয়ালালামপুরে প্রি-অলিম্পিক, কলম্বে^ায় পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল এবং জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ বাছায় পর্বে অংশ নেন। তিনি ১৯৭৯-৮১, ১৯৮৭-৯৩ পর্যন্ত খেলেন আবাহনীতে। ১৯৮২-৮৬ সাল পর্যন্ত খেলেন মোহামেডানে এবং ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে খেলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। খেলা শেষ করে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। দেশের টানে প্রায় ফিরে আসেন। তবে এবার এসেছেন তার মা অসুস্থ এবং বাবা ও তার টাকায় কেনা সাভারে দুই বিঘার বেদখল একটা জমি দখলে আনার জন্য। তার ন্যায় বিচার পাবার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। মহসিন যখন যে দলে খেলেছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েই খেলেছেন। আর তাইতো জীবনের ঝুঁকি নিয়েও গোল পথে বিপক্ষ দলের বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। নিজের স্কিল, আই সাইট, পজিশন জ্ঞান এবং বিচক্ষণতা দিয়ে বার বার প্রমাণ করেছেন তিনিই দেশ সেরা গোল রক্ষক। আর তাই বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাসে দুই প্রতিপক্ষ মোহামেডান আবাহনীর লাখ লাখ সমর্থকদের হৃদয়ে আজও স্থান করে আছেন গোলরক্ষক মহসিন। তিনি ঢাকা ফুটবলের তিন প্রধান মোহামেডান, আবাহনী এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অধিনায়ক ছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশ অনুর্ধ ১৯, সবুজ দল, লাল দল এবং বাংলাদেশ জাতীয় মূল দলের অধিনায়ক ছিলেন মোহাম্মদ মহসিন। ১৯৮২ সালে ফেডারেশন কাপে মোহামেডানের হয়ে খেলে একটি গোলও হজম করেননি। এটা একটা বিরল রেকর্ড। মহসিন ছিলেন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার। গোল রক্ষকের জন্য এই উচ্চতা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ কারণে অনেক সময় ঝুঁকি নিয়েই উপরের বল মোকাবেলা করতে হতো। আহত হওয়ার কারণে চার বার মাঠ থেকে সরাসরি হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তবু গোলপোস্টে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিংবদন্তি এই গোলরক্ষকের সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। * কার অনুপ্রেরণাতে আপনি ফুটবলার মহসিন, কখন থেকে ফুটবলের হাতে খড়ি? ** তিন জনের নাম উল্লেখ যোগ্য। অবশ্যই বাবা, স্কুল গেম টিচার মনির হোসেন যিনি জাতীয় রেফারি ছিলেন এবং ফুটবলার আলাউদ্দিন আলী। ছোট বেলা কেটেছে রেলওয়ে কলোনিতে। কলোনি থেকে শাজাহানপুর মাঠ নিকটেই। সেই স্কুল জীবন থেকেই ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। * স্কুল ফুটবল থেকে কিভাবে প্রথম বিভাগে আগমন? ** ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল রেলওয়ে ব্লুজের হয়ে খেলেছিলাম। ওই বছরই রেলওয়ে ব্লুজ শের-এ- বাংলা কাপে অংশ নেয়। রেলওয়ে ব্লুজের পক্ষে খেলেন আবাহনীর আশরাফ উদ্দিন চুন্নু ভাই। ফাইনালে চুন্নু ভাইয়ের ২ গোলের সুবাদে দল চ্যাম্পিয়ন হয়। তাছাড়া তখন আন্তঃজুটমিল জুটবল টুর্নামেন্ট হতো। আমি ৭৮ সালে বাওয়া জুটমিলের পক্ষে খেলি। চুন্নু ভাইও ছিলেন আমাদের দলে। সেমিতে প্রতিপক্ষ ছিল আদমজী জুট মিল । আদমজী জুট মিলে ছিলেন সান্টু ভাই, টুটুল ভাইসহ জাতীয় দলের চার পাঁচ জন খেলোয়াড়। সে ম্যাচে আমরা জয় লাভ করে ফাইনালে উঠি কিন্তু দুর্ভাগ্য জনকভাবে হেরে যাই। ফাইনালে আমাকে খেলানো হয় নি । খেলেছিলেন মোতালেব ভাই। তখন আমার খেলা দেখে পছন্দ করেন চুন্নু ভাই। তিনি আমাকে সেখান থেকে ঢাকায় আবাহনী ক্লাবে নিয়ে আসেন। * মোহামেডানে আসার গল্প? ** আবাহনীতে আমার মাঠে নামার সুযোগ খুব একটা হতো না। আবাহনী যখন ৪/৫ গোলের লিডে থাকত হয়ত দেখা গেছে শেষ ৫ মিনিট আগে আমাকে মাঠে নামিয়েছে। তবে আবাহনীর গোল রক্ষক সুহাস ভাই ঢাকা লীগের পাশাপাশি চিটাগং লীগেও খেলতেন। ১৯৮১ সালে চিটাগং লীগে এক ম্যাচে খেলতে গিয়ে হাতে ব্যথা পান। আমাকে তখন মাঠে নামানো হয়। সুপার লীগের শেষ ৫/৬ ম্যাচ খেলেছিলাম। কোন গোল হজম করতে হয়নি। পরে ১৯৮২ সালে লীগে খেলার জন্য আমাকে মোহামেডান আমন্ত্রণ জানায়। * কিন্তু তখনতো মোহামেডানে দেশ সেরা গোল রক্ষক লাল মোহাম্মদ? ** হ্যাঁ, তারপরও আগপাছ না ভেবেই আমি দল পালটিয়ে মোহামেডানে যোগ দেই। আমার ইচ্ছা ছিল দেশ সেরা গোল রক্ষকদের খুব কাছ কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। তবে প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়াটা ছিল আরেক কাহিনী। ৮২ সালের মোহামেডান দল ছিল দুর্দান্ত। লাল মোহাম্মদ ভাই অসুস্থ থাকার কারণে ফেডারেশন কাপ আমি খেলি। পরে আবার লীগে শুরু থেকেই লাল ভাই ফিরে আসেন। মোহামেডান সব ম্যাচ জিতে চলেছে কিন্তু আকস্মিকভাবে ২-০ গোলে হেরে যায় ভিক্টোরিয়ার কাছে। সমর্থকরা লাল ভাইকে খুব গালিগালাজ করে। মাঠ থেকে বের হতে সেদিন রাত ১২টা বেজে গিয়েছিল। লাল ভাই সেদিন রাত দুইটার সময় সেই যে ক্লাব থেকে চলে গিয়েছিলেন আর ফিরে আসেননি। পরের ম্যাচেই আমার যায়গা হয়ে যায় মূল একাদশে। *মোহামেডানের হয়ে আপনার প্রথম দল ঢাকা আবাহনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলার দিন কেমন লাগছিল? ** সে এক অন্য অনুভূতি। প্রথম মোকাবেলা হয় ফেডারেশন কাপে ১৯৮২ সালের ফাইনালে। তবে লীগের প্রথম মোকাবেলাটা ছিল ঘটনায় ভরপুর। নিজে গোল বারে দাঁড়িয়ে আছি। এই দুই দলের মোকাবেলা লীগে সেই প্রথম আমি খেলছি। ঢাকা স্ট্যাডিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ। প্রথমে একটু নার্ভাস লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আবাহনী যখন পেনাল্টি পেয়ে বসে। তাও আবার কিক নিতে এসেছিলেন দেশের সেরা স্ট্রাইকার আবাহনীর কাজী সালাহ উদ্দিন। কিন্তু আমার বার বার মনে হচ্ছিল আমি সালাহউদ্দিন ভাইয়ের কিক আটকিয়ে দিব। যখন আবাহনীতে খেলতাম তখন সালাহউদ্দিন ভাই আমাকে পেনাল্টি কিক মেরে প্র্যাক্টিস করাতেন। উনি কোন দিক দিয়ে সাধারণত কিক নিতে পারেন তা আমার একটু ধারণা ছিল। আমি সেদিন যে দিকটাকে টার্গেট করেছিলাম তিনি যেন আমার কথা শুনে ঠিক তাই করলেন। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে রুখে দেই তার কিক। মোহামেডান গ্যালারির চিৎকার যেন আজও কানে বাজে। বাদল রায়ের দেওয়া গোলে আমরা ১-০ গোলে জয় লাভ করি। গোলরক্ষক মহসিনের উত্থান কিন্তু সেদিন থেকেই। * ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় পর্বের লীগে আবাহনীর সঙ্গে খেলা পন্ড হয় এবং খেলা শেষে চারজন জেলে যায় এ প্রসঙ্গে যদি কিছু বলবেন? ** হ্যাঁ ১৯৮২ সালের সুপার লীগে আমরা আবাহনীর সঙ্গে ১-০ গোলে এগিয়ে ছিলাম। খেলার শেষের দিকে আবাহনী একটা কর্নার পায়। সম্ভবত আনোয়ার ভাই কর্নার কিকটা নেন। কর্নার কিক নেওয়ার পর কেউ একজন গোলে কিক নিয়েছিলেন কি না আমার স্মরণ নেই তবে বলটা আমি আমার শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে গ্রীব করি। আবাহনীর খেলোয়াড় সমর্থকদের ধারণা বল ক্রসবার ক্রস করেছে এবং গোল, যেখান থেকে গন্ডোগোলের সূত্রপাত। তবে আমি এখনো বলি সেটা গোল ছিল না। এর পরের ঘটনা সবার জানা যা দুঃখজনক। * আপনাদের সময়ের ফুটবল আর এখনকার ফুটবল পার্থক্য কোথায়? ** আন্তর্জাতিক ফলাফলের দিকে তাকালেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। * অনেকে সমর্থকরা বলে থাকেন আপনার সঙ্গে গোল রক্ষক সাইদ হাসান কাননের রেষারেষি ছিল? কতটা সত্যি। ** কানন (উচ্চৈঃসরে হাসতে হাসতে) আমার সব সময়ের ভাল বন্ধু। সমর্থকরা অনেক কথাই বলে থাকেন। তবে এটা ঠিক ওই সময়ে এই জাতীয় আলোচনা আমরাও খুব উপভোগ করতাম। * আপনার সামনে কোন ডিফেন্ডার থাকলে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং কোন স্ট্রাইকার কে সমীহ করতেন ? ** ডিফেন্ডার হিসেবে অবশ্যই মুন্না, কায়সার এবং পাকির আলী ভাইয়ের নাম বলতে হবে আর স্ট্রাইকার হিসেবে সালাহউদ্দিন ভাইকে। * কোন খেলাটার কথা আজও মনে পড়ে? ** ঘরোয়া ফুটবলের কথা যদি বলি তবে ১৯৮২ সালের লীগের প্রথম পর্বের ম্যাচ আবাহনীর বিরুদ্ধে। যে ম্যাচে সালাহউদ্দিন ভাইয়ের কিক ঠেকিয়েছিলাম। সেই ম্যাচটাই আমার জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ। আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনেক আছে তবে ১৯৮২ সালের মারদেকা টুর্নামেন্টে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলের ম্যাচটা ছিল আমার জীবনের সেরা ম্যাচ। * সমর্থকদের ভালবাসা কেমন পেয়েছেন? ** দেশে এবং দেশের বাইরে মানুষের অনেক ভালবাসা পেয়েছি, এখনো পায়। দিল্লী এসিয়াডে মালয়েশিয়ার সঙ্গে খেলা শেষ হবার মিনিট দুই আগে আমি প্রচ- আঘাত পাই। তখন আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে আছি। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে মাঠ থেকেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। জ্ঞান ফিরে তার পরের দিন। পরে শুনি আমরা ২-১ গোলে জিতেছি। আমরা কিছুদিন পর আজমির শরিফ যাই। সেখানে এক খাদেম কোচ টিপু ভাইকে জিজ্ঞেস করেন ‘গোলকিপার মহসিন কি মার গিয়া?’ পরে টিপু ভাই আমাকে দেখিয়ে বলেন এই যে মহসিন। খাদেম আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এখনও যখন যেখানে যাই সবাই জটলা পাকিয়ে দেখে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরনো খেলার স্মৃতিমাখা দিনগুলোর কথা জানতে চায়। সমর্থকদের আলোচনায় বুঝি তারা আমার চাইতে অনেক বেশি মনে রেখেছে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয় পুরনো সব খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেই দেখেছি। আসলে আমাদের দেশের মানুষ ফুটবল পাগল। তারা এখনও ফুটবল কে দারুণ ভালবাসে। অবাক লাগে সেই কবে খেলেছি অথচ সমর্থকদের সব মুখস্থ। কষ্ট লাগে আজকের ফুটবলের অবস্থান দেখে। * কেন এই অবস্থা? এ থেকে উত্তরনের উপায় কি? ** কারণ পরিষ্কার। একটা গাছকে যদি সঠিক সময় সঠিকভাবে পরিচর্যা না করেন তবে সে গাছ ঠিকমতো বেড়ে উঠবে না এবং আশানারূপ ফল দিবে না। আমি মনে করি ফুটবল উন্নয়নে সাবেক ফুটবলারদের কাজে লাগানো যেতে পারে। জেলা ভিত্তিক ফুটবল একাডেমি তৈরি করতে হবে এবং প্রয়োজনে সাবেক সব খেলোয়াড়দের হাতে এর পরিচর্যার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বিদেশ থেকে কোচ এনে দেশীয় কোচদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তীতে যেন দেশীয় কোচেরা প্রশিক্ষণ দিতে পারে। প্রতি বছর সব একাডেমির মধ্যে লীগ বা টুর্নামেন্ট হতে পারে। * কোন্ মজার স্মৃতির কথা মনে আছে? ** এলিফ্যান্ট রোডে একটা কাজে গিয়েছি। পিছন থেকে মেয়ে কণ্ঠের ডাক কানে এলো। মেয়েটি ডাকছে ‘মহসিন ভাই মহসিন ভাই’। ফিরে দেখি অভিনেত্রী শমি কায়সার। বললেন আমি আমাদের বাসায় দুজন ফুটবলারের ছবি টানানো আছে। একটি বাদল রায়ের এবং অন্যটি আপনার। আমি মোহামেডান এবং আপনাদের ভক্ত। এই ঘটনা খুব মনে পড়ে। তখন মোহামেডান আবাহনী ম্যাচ মানে দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া। দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল অফিস আদালতগুলোতে একই আলোচনা হতো। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, পীযুষ নন্দী, মনোজ সেনগুপ্ত সবাই মোহামেডানের সমর্থক ছিলেন। আবাহনীর ম্যাচের আগে ক্লাবে আসতেন হুমায়ুন ফরীদি। একটার পর একটা সিগারেট ধরাতেন। আমাদের চাইতেও যেন তার টেনশন বেশি ছিল। ভাবতেই অবাক লাগে বাংলাদেশ ফুটবলের জনপ্রিয়তা তখন কোথায় ছিল। * মনে করেন বাংলাদেশ ফুটবলের রমরমা অবস্থা ফিরে এসেছে। আপনিও ফিরে গেছেন সেই আশির দশকে। মোহামেডান আবাহনী দুই দল সমান পারশ্রমিকে আপনাকে দলে ভিড়াতে চায়, আপনি কাকে বেছে নেবেন? * ম’তে মহসিন ম’তে মোহামেডান (হাসতে হাসতে)। ছোট বেলায় দেখেছি বাবাকে মোহামেডান সমর্থন করতে। স্কুলে পড়ার সময় আমার স্কুল বন্ধুরা কেউ মোহামেডান কেউ আবাহনী করত। আমার নাম ‘ম’ দিয়ে হওয়ার কারণে খুব মুড নিয়ে বলতাম “ম’তে মহসিন ম’তে মোহামেডান”। মোহামেডানে থাকা অবস্থায় কখনোই ভাবিনি আবাহনীতে যাব। পরে যখন আবাহনীতে যাই তখন স্বাভাবিক কারণেই আবাহনীকেই সমর্থন করেছি। দুই দলের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা আছে। বড় কথা হচ্ছে আমি সেই আশির দশকে ফিরে যাই বা না যাই বাংলাদেশ ফুটবলে ফিরে আসুক সেই সময়।
×