ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন এসেছে চার পরিবারের ১১ জন, ১৫ নবেম্বর প্রত্যাবাসিত হবে ১৫০

প্রত্যাবাসন শুরুর আগে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৭ নভেম্বর ২০১৮

প্রত্যাবাসন শুরুর আগে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যেখানে প্রায় সম্পন্ন এবং আগামী ১৫ নবেম্বর থেকে এ কার্যক্রম শুরু করার দিনক্ষণ ধার্য রয়েছে সেখানে রাখাইন থেকে নতুন করে পালিয়ে এসেছে চার পরিবারের ১১ নারী পুরুষ ও শিশু। এ ঘটনা বিস্ময়কর বলে আলোচিত হচ্ছে। কেননা, ইতোমধ্যে মিয়ানমার পক্ষ বলেছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এপারে পালিয়ে আসাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করারও প্রস্তুতি নিয়েছে। সে অবস্থায় নতুন করে কিছু রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার ঘটনা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গত সোমবার রাতে উখিয়ার কুতুপালং টিভি রিলে কেন্দ্র সংলগ্ন ট্রানজিট ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে পালিয়ে আসা চার পরিবারের ১১ রোহিঙ্গা। অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গা সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এপারে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। বিজিবি আগেই ঘোষণা দিয়েছে সীমান্ত সীল করা আছে। ফলে গত ছয় মাস ধরে অনুপ্রবেশের কোন ঘটনা ঘটেনি। এ সময়ের মধ্যে ওপার থেকে রোহিঙ্গারা দফায় দফায় সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ফেরত পাঠানো হয়েছে একাধিক নৌকাভর্তি রোহিঙ্গা । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু দালাল ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার তৎপরতায় রয়েছে শুরুতেই। সোমবার রাতে যারা পালিয়ে এসেছে তারা হচ্ছেন মংডুর হারিপাড়ার বাসিন্দা মোঃ ইউনুস (৪৫), আনোয়ারা বেগম (৪০), পুত্র মোহাম্মদ খান (১৬) এবং কন্যা হান্না বিবি (১৫)। অন্যদের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের বুচিদং লাউওরপাড়ার বাসিন্দা মোঃ হোছন (২৫) ও তার স্ত্রী আমেনা বেগম (২০), মিঞ্জি গ্রামের সতের মাসের শিশুসন্তানসহ ছেনোয়ারা বেগম (২২), এছাড়া রয়েছে ওপারের সাহাববাজার এলাকার বাসিন্দা মোঃ হোবায়ের (২৪), স্ত্রী শাহজান বেগম (১৮)। এদের প্রত্যেকের মুখে সেই পুরনো কথা। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে, তাই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ইউনুস, আনোয়ারা বেগম, মোহাম্মদ খান ও হান্না বিবি এক পরিবারের। তারা জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের আটক করে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়েছে। ছেড়ে দেয়ার পর রবিবার ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীরদ্বীপ পৌঁছায়। সেখান থেকে সড়ক পথে বাসে আসে উখিয়ায়। মিয়ানমারে তাদের সহায় সম্বল শেষ হয়ে যাওয়ায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে বলে পরিবারটি জানিয়েছে। অপরদিকে, বুচিদং লাউয়ারপাড়ার বাসিন্দা মোঃ হোছন ও পরিবারের সদস্যরা জানান, সেনাদের ভয়ে তারা রাতের বেলায় পাহাড়ে জঙ্গলে অবস্থান নিত এবং দিনের বেলায় বাড়িতে থাকত। এভাবে দীর্ঘ বারো মাস কেটেছে। দিনের বেলায় কোন প্রকার কাজকর্ম করতে না পারায় আর্থিক সঙ্কটে পড়ে তারা এদেশে চলে এসেছেন বলে দাবি করেন। বুচিদং মিঞ্জিগ্রাম থেকে আসা ছেনোয়ারা বেগম জানায়, দশ মাস আগে তার স্বামী ফাইজুল করিমকে সেনারা হত্যা করেছে। স্বামীহারা এই মহিলা এতদিন সেখানে পার করেছেন নিদারুণ কষ্টে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য এতদিন সে কাউকে পায়নি। সবশেষে সাহাববাজার এলাকার বাসিন্দা মোঃ হোবাইর ও তার স্ত্রী শাহজান বেগমকে পেয়ে তাদের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে বলে জানায়। এদিকে, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে জানান, আগামী ১৫ নবেম্বর থেকে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যে শুরু হচ্ছে তা নিশ্চিত। এপারের দুটি পয়েন্টকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তুত করা হয়েছে। তিনি জানান, ১৫ নবেম্বর কেরুনতলীর ট্রানজিট ঘাট দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। শুরুতে প্রথম দফায় যাবে ১৫০ জন। এপারে এবং ওপারে এ প্রক্রিয়া নিয়ে উভয় দেশ প্রস্তুতিতে রয়েছে। তিনি ধারণা দেন, ১৫ নবেম্বর টেকনাফের পাশাপাশি ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে যদি প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত হয় তাহলে ৩শ’ জন প্রত্যাবাসিত হবে। তবে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। এর আগে তথ্য দেয়া হয়েছিল ১৫ নবেম্বর ৪৮৫ পরিবারের ২ হাজার ২৬০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হবে। এখন নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রথম দফায় যাবে ১৫০। পরিসংখ্যানের এ হেরফের কেন হচ্ছে তা কোন মহল নিশ্চিত করতে পারেনি। তিন রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ ॥ টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে একই পরিবারের ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সোমবার রাতে টেকনাফ নয়াপাড়ায় নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধরা হচ্ছে টেকনাফ নয়াপাড়া ক্যাম্পের আই ব্লকের এক নম্বর রুমের গৃহকর্তা (এমআরসি-৫৩৪৩ ও শেড-৫৫৮) মৃত হোসেন আলীর পুত্র আজিজুল হক (৫০), তার স্ত্রী তৈয়বা বেগম (৪০) ও ছেলে হোসেন জোহার (১৬)। আজিজুল হক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সোর্স হিসেবে কাজ করতেন বলে প্রচার রয়েছে। নয়াপাড়া ক্যাম্প পুলিশের দায়িত্বরত সহকারী উপ-পরিদর্শক মোঃ গোলাম আজম জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পে ডাকাতের গোলাগুলির খবরে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখান থেকে একই পরিবারের ৩ রোহিঙ্গাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। ক্যাম্প পুলিশ জানায়, সোমবার সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা শীর্ষ ডাকাত নুরুল আলম ও মোহাম্মদ সাদেকের নেতৃত্বে অস্ত্রধারীরা নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আই ব্লকের বাসিন্দা আজিজুল হকের কক্ষে হানা দেয়। এ সময় ওই কক্ষে থাকা লোকজন চিৎকার দিলে অস্ত্রধারীরা তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে একই পরিবারের তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ-পাশের লোকজন এগিয়ে আসছে দেখে হামলাকারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা ফাঁকা গুলি করে ভীতি সঞ্চার করে পাহাড়ের দিকে ঢুকে পড়ে। পরে স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধদের উদ্ধার করে ক্যাম্পের ভেতরে স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তাদের একেক জনের শরীরে দুই-তিনটি করে গুলি লাগার চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের মতে, গুলিবিদ্ধ আজিজুল হক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছিল। আর বেশ কিছুদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা জিয়া নামে এক অপরাধীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরে দিয়েছিল আজিজ। এ অভিযোগে সোমবারের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রার প্রাক্কালে ১৪ রোহিঙ্গা উদ্ধার ॥ এদিকে, প্রত্যাবাসনের পূর্বে উখিয়া টেকনাফের ৩০ আশ্রয় শিবিরে নানামুখী অপপ্রচার ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় দালালের মাধ্যমে ১৪ রোহিঙ্গা ইঞ্জিনবোটযোগে মালয়েশিয়ায় যাত্রার প্রাক্কালে ধরা পড়েছে বিজিবির হাতে। বিজিবি এদের উদ্ধার করেছে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ গোলারচর দক্ষিণপাড়া সাগর তীর থেকে। পরে এদের নিজ নিজ আশ্রয় ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
×