ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই উৎসব সামনে রেখে অধীর আগ্রহ তারুণ্যের

বিশ্বসাহিত্যের রূপরস মাটিসংলগ্ন সুর, লোকদর্শন

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৭ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বসাহিত্যের রূপরস মাটিসংলগ্ন সুর, লোকদর্শন

মোরসালিন মিজান ॥ আসলেই তর সইছে না। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন যারা, অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা নাম নিবন্ধনে ব্যস্ত। আর সঙ্গীতপিপাসুরা শুনতে চান মাটি ঘেঁষা সুর। হ্যাঁ, শহুরে উপস্থাপনা। ফিউশন। তবুও ফোকের বৈশিষ্ট্য আছে। আছে বলে আছেন শ্রোতারাও। লোকসঙ্গীতে গণমানুষের যে আবেগ, যে প্রাণ আকুল করা সুর, যে দর্শন, তারুণ্যকে নতুন করে টানছে। ফলে ‘লিট ফেস্ট’ বা ‘ফোক ফেস্ট’ কালচারকে আর অন্যের বলে অবহেলা করা যাচ্ছে না। আয়োজনগুলোর মধ্য দিয়ে প্রতিবছরই কিছু না কিছু প্রাপ্তি যোগ হচ্ছে। অপেক্ষা করে থাকা এ কারণেই। তবে এ আলোচনার শুরুটা করতে হবে বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল ফেস্টিভ্যালের কথা বলে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ঢাকাবাসীকে প্রথমবারের মতো অভূতপূর্ব এ উৎসব উপহার দিয়েছিল। বিশাল খোলা মাঠে সারারাত ধরে চলবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। পৃথিবী বিখ্যাত ওস্তাদরা আসবেন। বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীরা গাইবেন। বাজাবেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মঞ্চে হবে শাস্ত্রীয় নৃত্যও। এবং কী আশ্চর্য! তা-ই হলো। সবই গ্রহণ করলেন ঢাকার সঙ্গীতপ্রেমীরা। আজ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব শুধু আয়োজকদের নয়, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। তবে ইতোমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছেন যে, এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে না বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। একেবারেই হচ্ছে না- তা নয়। অপেক্ষা একটু দীর্ঘ হলো। উৎসব চলে গেল ফেব্রুয়ারিতে। আয়োজকদের পক্ষে লুভা নাহিদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ক্লাসিক্যাল ফেস্টিভ্যাল আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হবে। ৭ থেকে ১১ তারিখের মধ্যে আয়োজনের সম্ভাবনা বেশি। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে। ভেন্যু হিসেবে আয়োজকরদের প্রথম পছন্দ আর্মি স্টেডিয়াম। এটি এবার ফেরত পাওয়ার আশা করছেন তারা। না পাওয়া গেলে অন্য ভেন্যুর কথা ভাবা হবে বলে জানান তিনি। স্মরণ করা যেতে পারে, শুরুর পর থেকে নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হচ্ছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। বিরুদ্ধ সময়েও এর কোন ছন্দপতন ঘটেনি। ২০১৪ সালের কথাই ধরা যাক, রাজনীতির নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে গৃহবন্দী করার ষড়যন্ত্র। ঠিক তখন প্রতিবাদী সুর তুলল বেঙ্গল ফেস্টিভ্যাল। আর এর ঠিক দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। ভিনদেশী অতিথিদের নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার খবর মুহূর্তেই সারা দুনিয়ায় রটে যায়। বিদেশীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সে সময়ও বাইরের বহু শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসব। গত বছর দেখা দেয় ভেন্যু জটিলতা। আর্মি স্টেডিয়াম স্বীকৃত ভেন্যু হলেও, সেটি পাওয়া যায় না। পরে ধানম-ির আবাহনী মাঠে উৎসব আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবার আর সেটি হলো না। তবে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভাল। রাজধানীবাসী তাই অপেক্ষা করে আছেন। অপেক্ষার মধ্যেই আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হচ্ছে ঢাকা লিট ফেস্ট। ২০১১ সালে হে ফেস্টিভ্যাল নামে শুরু। দীর্ঘ সময় বিদেশে কাটানো ড. কাজী আনিস আহমেদের সূচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে সে সময় যৌক্তিক কিছু সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল আয়োজকদের। পরবর্তীতে ২০১৫ সাল থেকে এটি আজকের রূপে ফেরে। নাম হয় ঢাকা লিট ফেস্ট। নতুন সূচনার পর তরুণ প্রজন্মের পাশাপাশি কট্টর সমালোচকদেরও কাছে টানতে পেরেছে। এখন ফেস্টিভ্যালটির মূল পৃষ্ঠপোষক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বাংলা একাডেমির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে অনেক। তাদের আগ্রহ বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে এখানে লিট ফেস্ট আয়োজন করা হয়। এরই মাঝে সেজে উঠেছে পুরো প্রাঙ্গণ। আয়োজকরা জানান, উৎসবে বিশ্বের ২৫ দেশ থেকে দুই শতাধিক অতিথি আসছেন। এদের মধ্যে থাকছেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। চিন্তাবিদ। স্বনামধন্য বক্তা ও পারফর্মার। তিন দিনব্যাপী আয়োজনে থাকছে আলোচনা। পারফর্মেন্স। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। আনপ্লাগড মিউজিক কনসার্টসহ নানা কিছু। শতাধিক সেশন রাখা হবে এবারের উৎসবে। এবার আমন্ত্রিতদের মধ্য রয়েছেন- পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ এ্যাডাম জনসন। ভারতের জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক ও কলামিস্ট মোহাম্মদ হানিফ। ব্রিটিশ উপন্যাসিক ফিলিপ হেনশের। বুকার বিজয়ী ব্রিটিশ উপন্যাসিক জেমস মিক। লন্ডন ন্যাশনাল একাডেমি অব রাইটিংয়ের পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক রিচার্ড বিয়ার্ড। ভারতীয় লেখিকা জয়শ্রী মিশর, হিমাঞ্জলি শংক, মিতালি বোস পারকিন্স। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এশিয়ার প্রধান হুগো রেস্টল, মার্কিন সাংবাদিক প্যাট্রিক উইন, লেখক ও সাংবাদিক নিশিদ হাজারি। জানা যায়, এবার লিট ফেস্টে নারী ইস্যুটি বিশেষ বিবেচনা পাবে। বাইরে থেকে যোগ দেবেন ছয় নারী কবি। রোহিঙ্গা নারীদের কথা হবে। থাকবে নারী বাউল শিল্পীদের পরিবেশনা। প্রদর্শিত হবে নন্দিতা দাশের ছবি ‘মান্টো।’ লেখক সাদাত মান্টোকে নিয়ে ভারতে নির্মিত ছবি। প্রিমিয়ার হবে ঢাকায়। ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার ঘোষণা করা হবে ‘জেমকন সাহিত্য পুরস্কার।’ সেই সঙ্গে নতুন যোগ হচ্ছে ক্যাম্ব্রিজ শর্ট স্টোরি প্রাইজ। আয়োজকদের পক্ষে সাদাফ সাজ একটি তথ্য দিয়ে বলেন, গত ৮ বছরে ৫০ দেশের ৩৩০ অতিথি এসেছেন ঢাকা লিট ফেস্টে। ড. কাজী আনিস আহমেদ বলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যকে পাশাপাশি তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা। একটি আদান-প্রদানের জায়গা হয়েছে। এর সুফল বাংলাদেশ পাবে বলে মনে করেন তিনি। আয়োজকরা জানান, https:/ww /w.dhakalitfest.com/register/ এই লিঙ্কে গিয়ে নাম নিবন্ধন করা যাবে। উৎসবের শেষ দিন শনিবার পর্যন্ত চলবে নিবন্ধন কার্যক্রম। ঢাকা লিট ফেস্টের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ নবেম্বর শুরু হয়ে যাবে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট-২০১৮। ২০১৫ সাল থেকে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ। নেপথ্যের মানুষটি অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু। ভেন্যু বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম। এখানে তিন দিনের আয়োজন চলবে ১৭ নবেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় শুরু। শেষ হবে রাত ১২টায়। বাংলাদেশের শিল্পীরা থাকবেন যথারীতি। এর বাইরে অন্য সাত দেশ থেকে আসবেন ১৭৪ শিল্পী। বিভিন্ন দেশের মাটি সংলগ্ন সুর বাজবে। তুলে ধরা হবে লোকদর্শন। উৎসবে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে গাইবেন লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজ, বাউল আব্দুল হাই দেওয়ান, বাউল কবির শাহ। গাইবেন অর্ণব। পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে থাকবে নকশিকাঁথা, স্বরব্যাঞ্জো ও নৃত্য সংগঠন ভাবনা। একই মঞ্চে গাইবেন ভারত, পাকিস্তান, বাহরাইন, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড এবং স্পেনের শিল্পী ও দল। এ উৎসবে প্রবেশের জন্যও নাম নিবন্ধন করতে হবে। মঙ্গবার থেকে অনলাইনে নিবন্ধন শুরু হয়ে গেছে। ফোক ফেস্টের ওয়েবসাইট www. dhakainternationalfolkfest.com এ গিয়ে নিবন্ধন করা যাচ্ছে। ১০ নবেম্বর পর্যন্ত চলবে নিবন্ধন। এসবের বাইরে ছোট বড় আরও কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। শীতকালে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। পরিবেশ প্রকৃতি হয়ে ওঠে উপভোগ্য। এসব কারণেই নবেম্বর ডিসেম্বর উৎসব অনুষ্ঠানে বেশি মাতে ঢাকা। দর্শক শ্রোতাও অভ্যস্থ। অপেক্ষা করে থাকেন। অপেক্ষা যেন শেষ হতে চায় না।
×