ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

বিএনপির ভবিষ্যত কোন্ পথে!

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৭ নভেম্বর ২০১৮

বিএনপির ভবিষ্যত কোন্ পথে!

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতির দিক থেকে অন্য সকল রাজনৈতিক দলের চেয়ে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি এখনও দৃশ্যমান নয়। অথচ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে বিএনপির প্রস্তুতিটাই ভাল থাকার কথা ছিল। কারণ, তাদের কাঁধে সরকার পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব নেই। তারা এদিক থেকে অনেকটা নির্ভার। বিএনপি যে এখনও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল একথা সবাই শিকার করবেন। তাদের মাঠের জনসমর্থন বলি আর ভোটের রাজনীতিতে অবস্থান বলি সেটাও উল্লেখ করার মতো। বর্তমান সরকার দুই মেয়াদে দেশ শাসনের দশ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে। আর বিএনপি প্রায় এক যুগ রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বিএনপির যতই জনসমর্থন, সুযোগ আর সম্ভাবনা থাকুক না কেন এই মুহূর্তে যে, এক মহাসঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে একথা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে স্বীকার করেন। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সময় নানা সঙ্কটে পড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্কট কাটিয়ে আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এবারের যে সঙ্কট এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা সময়ই বলে দেবে। প্রতিষ্ঠালগ্নেই প্রশ্ন উঠেছিল আসলে দলটি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল রাষ্ট্র শক্তির সহায়তায় নানা মত নানা পথের একদল মানুষকে নিয়ে। আবার ১৯৮১ সালে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে একদল বিদ্রোহী সেনা সদস্যের হাতে নিহত হওয়ার পর আবারও অনেকের মনে দলটির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন জাগে যে, জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতিতে দলটি হয়তো টিকে থাকতে পারবে না। পরবর্তীতে এরশাদের সময় জেনারেল জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া যখন দলটির হাল ধরেন তখনও অনেকে ভেবেছিলেন, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারা একজন বিধবা নারীর নেতৃত্বে দলটির পরিণতি অচিরেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা খণ্ডিত ন্যাপের (ভাসানী) একাংশের যে পরিণতি হয়েছিল, দলটি বোধহয় তেমন পরিণতিই ভোগ করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই বেগম জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এবং এরশাদ সরকারের পতনের পর সরকার গঠন করে। ফলে এ দুই মেয়াদের সরকারের মধ্যে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি গণআন্দোলনের ফলে অনেকটা এরশাদ সরকারের মতো ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলেও বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্নটি আর তেমন করে সামনে আসেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপির অস্তিত্বের প্রশ্নটি আবার সামনে চলে এসেছে। বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিষয়টি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ফলে। অনেকেরই সে সময় ধারণা জন্মেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার যেমন গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল তেমন পরিণতি হয়তো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও বরণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পর দ্বিতীয় ধাপে কিছুদিনের জন্য জামায়াতনির্ভর পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস ছাড়া বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন পেট্রোল বোমানির্ভর সন্ত্রাস আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অল্প সময়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার এ ব্যর্থতা থেকেই বিএনপি নামক এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় দাগে ফারাক জাতির সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। দু’দলের এ ফারাকের পাশাপাশি দ্বিতীয়বারের মতো পেট্রোল বোমানির্ভর সন্ত্রাস ব্যর্থ হওয়ার পর ‘সাইন বোর্ড’ সর্বস্ব ছোট দলগুলোর মতো বিএনপির কার্যক্রম চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় দলটির রাজনৈতিক পূর্বসূরি মুসলিম লীগের মতো একই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে কি-না– এ প্রশ্নটি আবার নতুন করে সামনে চলে আসে। অস্তিত্বের প্রশ্নটি বর্তমানে আরও বেশি সামনে চলে এসেছে সাম্প্রতিক দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সাজা হওয়ার মধ্য দিয়ে। গঠনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতার কারণে অচিরেই দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তাঁরা বাদ পড়ে যান কিনা; জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কিনা এরকম নানান প্রশ্ন। এরই মধ্যে ক’দিন আগে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি সেই প্লাটফর্মে গিয়ে যোগ দিয়েছে। ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্বেই তাঁরা এখন চালিত হচ্ছে। এমন কি ড. কামালের নেতৃত্বে তাঁরা গত ১ নবেম্বর প্রথমবার ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে একটি রাজনৈতিক সংলাপেও অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রতিক কর্মকা-ে মনে হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে কিনা? বিএনপির মতো একটি বিশাল রাজনৈতিক দল কামাল হোসেনের গণফোরামের মতো একটি প্যাডসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের নিকট আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গে অবশ্য প্যাডসর্বস্ব এক নেতার দল জেএসডি এবং নাগরিক ঐক্যও আছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এই জোটের শীর্ষ নেতৃত্বে কামাল হোসেনের নাম কেন উচ্চারিত হচ্ছে? উচ্চারিত হওয়ার কথাতো বিএনপির কোন শীর্ষ নেতার নাম। কারণ, একথা দিনের আলোর মতো পরিস্কার যেÑ অবস্থানগত দিক দিয়ে ঐ সমস্ত প্যাডসর্বস্ব দলের চেয়ে বিএনপির অবস্থান শত শত গুণ উপরে। ঐক্যফ্রন্টের এখনকার বডি লেঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্নাই সরকারবিরোধী প্রধান নেতা। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, মওদুদ আহমদরা যখন নীরবে প্যাডসর্বস্ব দলগুলোর নেতাদের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করলেন তখন সত্যিই বিএনপির নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এক খবরে প্রকাশ যে গণফোরাম ৩০, জেএসডি ৩০, নাগরিক ঐক্য ৩০ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ১০ সব মিলিয়ে এই প্যাডসর্বস্ব দলগুলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপির নিকট ১০০ আসন চাওয়ার পরিকল্পনা করছে। যে দলগুলোর প্রধান নেতাটিই নির্বাচিত হতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এই দলগুলোর পাঁচজন করে নেতার নাম দেশের মানুষ সঠিকভাবে বলতে পারবে বলে মনে হয় না। অথচ তারা চায় ১০০ আসন! বিএনপির দুর্বলতার সুযোগেই এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যেন বিএনপি খড়কুটো যাই সামনে পায় সেটিকে ধরেই বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু খড়কুটো ধরে কী বাঁচা যায়? আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিএনপির অন্দরমহলে নানা মেরুকরণ চলছে। দলটির নির্বাচন প্রস্তুতি যে মোটেই নেই সেটিও পরিষ্কার। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েও দলের মধ্যে মতভেদ আছে। একটি পক্ষ বর্তমান সরকারের অধীনে কোনভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় না। আবার একটি পক্ষ যেমন করেই হোক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। এমনকি যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় তারা প্রয়োজনে দল ত্যাগেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে এমন খবরও বাতাসে ভাসছে। কারণ এই পক্ষটি ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে ভুল করছে সেই ভুলে আর পা দিতে রাজি নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন যে বিএনপি যদি এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তা হলে দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব এক ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে। সব মিলিয়ে দলটির নেতা কর্মীরা ভিতরে ভিতরে এক চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সুযোগ এসেছে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াবার। সরকার গঠন করতে পারবে না এই ধারণাকে সামনে নিয়ে হলেও বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। বিএনপি নেতৃত্ব ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিবে। এখন অপেক্ষার পালা যে বিএনপি আসলে টিকে থাকবে নাকি কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে। বিষয়টি আমরা সময়ের কাছেই ছেড়ে দিতে চাই। লেখক : উপস্থাপক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা [email protected]
×