ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাঞ্জল আচার্য

মঙ্গলময় আলোক উৎসব

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৬ নভেম্বর ২০১৮

মঙ্গলময় আলোক উৎসব

‘দীপাবলী বা দেওয়ালী সারা পৃথিবীতে আলোর উৎসব হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকেন। এই উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলায়, এই দিনে মহা ধুমধামে কালীপূজা ও লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলী ও কালীপূজা একই দিনে অনুষ্ঠিত হলেও মূলত দুটি পূজারই পৃথক ইতিহাস রয়েছে। প্রথমেই আসি দীপাবলীর কথায়। ত্রেতাযুগে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জগৎবাসীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য পিতার আদেশকে শিরোধার্য করেন। পিতৃভক্তির প্রতীক শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীসহ চৌদ্দ বছর বনবাসলীলা করেন। অশুভ মহাশক্তি রাবণের সঙ্গে যুদ্ধলীলাও করেন। শ্রীরামচন্দ্রের চৌদ্দ বছরের দীর্ঘ বিরহে অযোদ্ধাবাসী কাতর হয়েছিলেন। তিনি বনবাসলীলা শেষ করে ভক্ত হনুমানের মাধ্যমে ভ্রাতা ভরতের কাছে অযোধ্যা নগরীতে ফিরে আসার বার্তা প্রেরণ করেন। অশুভ পরাশক্তিকে নাশ করার পর দামোদর মাসে (কার্তিক মাস) কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে তিনি অযোধ্যা নগরীতে তাঁর প্রাণপ্রিয় ভক্তদের মাঝে ফিরে আসবেন। তাই অযোধ্যাবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় শ্রীরামচন্দ্রকে স্বাগত জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ তিনি প্রবেশ করে ধন্য করবেন এই নগরী। শ্রীরামচন্দ্রের আগমন বার্তা পেয়ে রাজা ভরত সমগ্র নগরে উৎসবের ঘোষণা দিলে সমগ্র নগরী আলোর উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। সমস্ত অমঙ্গল-অকল্যাণ দূর হবে এই শুভ কামনায় পথে পথে, বাড়িতে বাড়িতে, গাছে গাছে সর্বত্র মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন অযোধ্যাবাসী। শ্রীরামচন্দ্র অমাবস্যার অন্ধকারে প্রত্যাবর্তন করবেন। তাই সমগ্র অযোধ্যা নগরী আলোর প্রদীপ দিয়ে সাজানো হলো, যেন তাদের প্রাণপ্রিয় শ্রীরামচন্দ্র অমাবস্যার অন্ধকার দূর করে মঙ্গলময় আলোকে নগরীতে প্রবেশ করেন। সেই থেকে এই শুভ দিনটিতে অশুভ অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে আলোর প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। এই শুভ দিনটিতে অনেক স্থানে লক্ষ্মীপূজাও অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলীর রাতে এশিয়া মহাদেশের এই অংশে বিশেষ করে কালীপূজাও মহা আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। স্কন্ধ পুরাণের বিষ্ণু খ-ে (৯.৬১) দীপাবলীর মাহাত্ম্যে বর্ণিত আছেÑ মহারাত্রী সমুৎপন্না চতুর্দশ্যাঃ মুনীশ্বরঃ। অর্থাৎ, কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর শেষ রাতে অমাবস্যা তিথি শুরু হলে দেবী মহারাত্রী (মহাকালী) আবির্ভূত হন। আর সেই কারণেই কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে শাক্ত সম্প্রদায় দেবী কালিকার পূজা করে থাকেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর বংশধরগণ সনাতন ধর্মের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পূজার প্রচলন ও জনপ্রিয় করে তোলেন। দেবী কালিকার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গুণ অনুসারে শৈব, শাক্ত, গাণপত্য ও বৈষ্ণব ধারায় ভগবানের আরাধনা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রে দেবী কালিকার বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর প্রধান কয়েকটি হলো দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী (বরদেশ্বরী), সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী প্রভৃতি। বিবিধ রূপের দেবী কালিকা বিভিন্ন মন্দিরে আবার বিভিন্ন নামে পূজিত হন। যেমনÑ ব্রহ্মময়ী, ভবতারিনী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি। এই বহুরূপের মধ্যে দক্ষিণাকালী রূপে বিগ্রহই সর্বাধিক পূজিতা হন ভক্তদের দ্বারা। দক্ষিণাকালী চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতের এক একটি হাতে রয়েছে খড়গ, রয়েছে অসুরের ছিন্ন মুন্ড, বর ও অভয় মুদ্রা। গলায় রয়েছে অসুরের মুন্ডের মালা। দেবীর গায়ের বর্ণ-কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় আলুলায়িত কেশ। রণচন্ডী মূর্তিতে তিনি অত্যাচারী অসুরদের নিধনে ব্যস্ত, দিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য। তাঁর অসুর নিধন যজ্ঞের উন্মত্ততায় পৃথিবীর মহাপ্রলয় যখন আসন্ন, তখন সকল দেবতাগণ নিরুপায় হয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হয়ে করুণভাবে প্রার্থনা করেন, যেন এ যাত্রায় পৃথিবীকে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন। তখন দেবাদিদেব মহাদেব উপায়ান্ত না দেখে দেবীর চলার পথে শুয়ে পড়েন। এদিকে দেবী তাঁর পায়ের নিচে দেবাদিদেব মহাদেবকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ রণভঙ্গ করেন এবং লজ্জিত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই ধরাধামে অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক হিসেবে দিনে মাকালীর পূজা করা হয়। তিনি জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিনী এবং মাঘ মাসে রটন্তিকালী রূপেও পূজিতা হন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মহা পরাক্রমশালী অসুর রাবণ, যা অশুভ শক্তির প্রতীক, তাঁকে বিনাশ করে এই পুণ্যলগ্নে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁর প্রিয় ভক্তদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। এই দিনেই ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মা দুর্গার বিশেষ রূপ মাকালী অত্যাচারী অসুরদের নিধন করে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন। তাই এই অশুভ শক্তি বিনাশের আনন্দই এই মঙ্গলময় আলোক উৎসব ‘দীপাবলী’। লেখক : প্রকৌশলী, ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউট অব হায়ার এ্যাডুকেশন, ইসকন, ঢাকা
×