ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সংসদীয় নেটওয়ার্ক ॥ বালি-২০১৮

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৬ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সংসদীয় নেটওয়ার্ক ॥ বালি-২০১৮

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সংসদীয় বলয় বা নেটওয়ার্ক ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নেটওয়ার্ক এই দুই আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার সদস্য দেশসমূহের আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে তাদের সংসদ সদস্যগণকে স্ব স্ব ভূমিকায় সুশাসন, উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সংস্থাদ্বয়ের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আলোচনা করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি অসরকারী প্রতিষ্ঠান। সদস্য দেশসমূহের সংসদ সদস্যগণ তাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুই আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার কর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিত্ব বাড়ানোয় অবদান রাখেন। একই সঙ্গে তারা এই নেটওয়ার্কের মোড়কে তাদের স্ব স্ব দেশে এই দুটি সংস্থার কর্ম ও লক্ষ্য সম্পর্কে অবগতি ও সচেতনতা বাড়ান এবং যখন ও যেখানে প্রয়োজন সেখানে স্ব স্ব দেশের আর্থিক বিষয়ক আইনাবলী প্রণয়ন ও সংস্কার করেন। এর সদর দফতর প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত। এর অর্থায়নে সমকালে ভূমিকা রাখছে এই দুই সংস্থার সদস্য দেশ বেলজিয়াম, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এর বাইরে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এই প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম বা প্রকল্পভিত্তিক অনুদান দিয়ে থাকে। আমি ৩ বছর ধরে এই সংসদীয় নেটওয়ার্কের সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের কাছে ব্যক্তিগত বিবেচনার বৃত্তে বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ প্রতিভাত করতে সচেষ্ট থেকেছি। ২০১৬ ও ২০১৭ তে এই নেটওয়ার্কের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর সদর দফতরে সংস্থাদ্বয়ের বার্ষিক সম্মেলনের ৩দিন আগ থেকে। এই বছরের মার্চ মাসে আমি এই নেটওয়ার্কের সদস্য হিসেবে ইউরোপ ও আফ্রিকার সহযোগী সাংসদগণসহ ভিয়েতনাম সফর করে তৃণমূল পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর কার্যাবলীর প্রয়োগ ও ফলাফল প্রত্যক্ষ করেছিলাম। এই বছর এই নেটওয়ার্কের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, সেখানে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বার্ষিক সম্মেলনের ৩ দিন আগ থেকে। এই নেটওয়ার্কের সমকালীন সভাপতি হলেন যুক্তরাজ্যের সাংসদ জেরেমী লিফ্রয়। তাঁর মতে, এরূপ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ আজকের পৃথিবীর স্থিতিশীলতার জন্য অতীব প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে তাঁর বিবেচনায় এই নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণকারী সাংসদগণকে অস্থিতিশীল দেশ এবং এদের উন্নয়ন ও সংস্কারের বিষয়ে এ দুই সংস্থার ঈপ্সিত ভূমিকার দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত দিতে হয়। বাহরাইনের সাংসদ রেধা ফারাজের মতে, এই দুই সংস্থার সদস্য দেশসমূহের সংসদ সদস্যের মধ্যে অংশীদারিত্ব স্থাপন এবং মতামত বিনিময় করা প্রয়োজন। এই বছর এই সম্মেলনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল মানব মূলধনে বিনিয়োগ। বালিতে অনুষ্ঠিত এবারের সম্মেলনে ২৫ সদস্য দেশ হতে ৭০ জন সাংসদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সম্মেলনে উপস্থিত সাংসদগণ কিভাবে তাদের স্ব স্ব দেশে মানব মূলধন সৃজন ও সম্প্রসারণে তরুণদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, লিঙ্গ সমতামূলক কার্যক্রম ও শাসন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন, তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। বিশ্বব্যাংকের তরফ হতে এই সম্মেলনে উন্নয়নের অন্যতম পরিমাপয়ী সূচক হিসেবে এই বছর এই প্রথমবার মানব মূলধন সূচক প্রকাশ করা হয়। এই নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণকারী সাংসদদের মধ্যে ২৮.৮% আফ্রিকার সাহারা অঞ্চল, ৮.৪% ইউরোপ ও কেন্দ্রীয় এশিয়া, ১৩.১৭% মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা, ৫.৩৯% পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ৯.৩২% লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান এবং ৬.৩২% দক্ষিণ এশিয়া থেকে এসেছিলেন। আর ২৮.৬৩% এসেছিলেন দাতা দেশসমূহ থেকে। সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং অংশগ্রহণকারী ও সাংসদদের সঙ্গে প্রদত্ত ভাষণের পটে আলোচনা করেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ড. জিম কিম এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টাইন লাগার্ডে। লাগার্ডের মতে, সাংসদরা এই সংস্থার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য যোগ্যতম, কেননা তারা তাদের দেশের জনগণের প্রতিনিধি। তিউনিশিয়া সংসদের সদস্য ওলফা শুকরী শেরিফের মতে, সাংসদের বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর প্রকল্প ও কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সাংসদরা তাদের স্ব স্ব দেশে এসব প্রকল্প ও কার্যক্রম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুমোদন করে থাকেন। নেটওয়ার্কের সভাপতি জেরেমী লিফ্রয় তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে কেবলমাত্র মানব মূলধনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে সদস্য দেশসমূহ জাতিসংঘ কর্তৃক ২০৩০ সালের জন্য নির্ধারিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিশ্চয় অর্জন করতে সক্ষম হতে পারবে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সংসদীয় নেটওয়ার্কের এই সম্মেলনে মুখ্য আলোচনায় এ লক্ষ্য অর্জন এবং এই অর্জনের পথে দৃষ্ট ব্যত্যয় ও সীমাবদ্ধতা কাটানোর উপায় হিসেবে প্রযুক্তিক বিবর্তন এবং যথার্থ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংসদ ও বিশেষজ্ঞদের উপস্থাপনা ও আলোচনা আগে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত জি-২০ এ অন্তর্ভুক্ত বিত্তশালী ও প্রগতিশীল দেশসমূহের সম্মেলনে তাদের অভিজ্ঞতা ও সুপারিশমালার পটে উপস্থাপিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সাংসদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেন যে সমকালে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে শ্লথ গতি, আন্তর্জাতিক পরিম-লে ক্রমাগত দেনা বেড়ে যাওয়া, দেশসমূহের দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কে অবনতি এবং সরকারের অনুকূলে জনগণের বিশ্বাসের ঘাটতি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষিতে বালিতে অনুষ্ঠিত নেটওয়ার্কের এই সম্মেলনে মূলত ৪টি করণীয় স্থিরিকৃত হয়। এক, বিস্তারিত আলোচনার আলোকে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছি যে, প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপযোগ আহরণ করতে হবে। এই লক্ষ্যে সকল দেশে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়াতে বাজার অর্থ ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ব্যবধান বা বৈষম্য কমানো এবং সকল দেশে প্রযুক্তির দিগন্ত নিরন্তর গবেষণা, সুচিন্তিত বিনিয়োগ ও ক্রমবর্ধমান উদ্ভাবনশীলতা দিয়ে প্রসারিত করতে হবে। দুই, প্রযুক্তিক পরিবর্তন ও বিবর্তন কালে সাধারণ জনগণকে ক্রান্তিকাল ভিত্তিক সমর্থন ও সহায়তা দিতে এবং এই প্রক্রিয়ায় আয় বণ্টন বিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই প্রেক্ষিতে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রমিকদের অভিগম্যতা প্রসারিত করতে, পরিবর্তনশীল কর্মক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে, আয়ের সুষম বণ্টনের পথে দৃষ্ট ব্যত্যয় দূর করতে এবং সকলকে সামনে ও ওপরে ওঠার সমান সুযোগ দিতে হবে। তিন, টেকসই যথাযথ বা সক্ষম কর ব্যবস্থায় উত্তরণ অর্জন করতে হবে; এরূপ কর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিয় প্রবৃদ্ধি ও নিপুণতর কর-সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিতকরণ লক্ষ্যানুগ হবে। এবং চার, রাষ্ট্রের ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের সিদ্ধান্তায়ন প্রক্রিয়া ও পর্যায়ে সর্বোত্তম তথ্য ও উপত্তাদির সরবরাহ এবং বিবেচনার পরিধি বিস্তৃত করতে হবে। এ না হলে বিবর্তনশীল পরিম-লে যথা ঈপ্সিত প্রশাসনিক ও সন্দিপনীয় পদক্ষেপ নেয়া সহজ হবে না। উপরোক্ত সকল বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপনে বিভিন্ন দেশের সাংসদবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই আলোচনায় অন্যদের মধ্যে সাংসদ ইউনুস করিম (দক্ষিণ আফ্রিকা), শামসুল ইসকান্দার আকিন (মালয়েশিয়া), ক্লড বিগেল (সুইজারল্যান্ড), কেশব কুমার কেতকার (ভারত), জেরেমী লিফরয় (যুক্তরাজ্য), বামবাং সুয়েসাটো প্রিজনো (ইন্দোনেশিয়া), ওলফা শেরিফ (তিউনিশিয়া), ডেবোরা ওয়েটজেল (বিশ্বব্যাংক) ও রোডা ব্রাউন (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা সবাই সমকালীন প্রেক্ষিতে সকল দেশের জন্য সার্বিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে মানব মূলধন সৃষ্টির প্রতি অধিকতর মনোযোগ দিতে সুপারিশ করেন। বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টা লিনা জিওরগ্রীভা নারীদের সামাজিক কর্মকা-ে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রসারণে কতিপয় দেশ ও সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আইন ও প্রথা সংস্কারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন যে, কোন কাজ করা তখন পর্যন্ত অসম্ভব থাকে, যখন তা হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ না করা হয়। সেজন্য তার সরব অনুশাসন- এ কাজ এখনই করতে এগিয়ে আসুন- আমাদের সকলের কানে উদ্দীপনার উপকরণ হিসেবে ধ্বনিত হয়। আমি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণে প্রযুক্তি ও অর্থ-সম্পদের প্রবাহ সীমান্তবিহীন বা মুক্ত এবং উন্নত পৃথিবীর বাজার উন্নয়নশীলদের জন্য অবারিত করার প্রয়োজন তুলে ধরি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ড. জিম কিম মানব মূলধন বিস্তৃত করার লক্ষ্যে সকল দেশের সরকারী বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ সিঙ্গাপুরের মতো বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন যে, গড় হিসেবে উন্নয়নশীল দেশসমূহে মাথাপিছু আয় বাড়া সত্ত্বেও আয়ের মাপকাঠিতে নি¤œবিত্ত পর্যায়ে দারিদ্র্য কমেনি। মানব মূলধন উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়েনি এবং প্রযুক্তিক অগ্রগতি অন্তর্ভুক্তীয় উন্নয়নে যথাযথভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, মানব মূলধন সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল এবং এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিত্তস্বল্পদের জন্য সিদ্ধান্তায়নের রাজনৈতিক পরিসর বিস্তৃত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন যে, সমকালে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর্যায়ে বৈশ্বিক সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ হিসেবে মানব মূলধনকে বিবেচনা করতে হবে। তাঁর দ্বিধাহীন মতে, ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন, সমকালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ জাতি বা দেশ গঠনে নিশ্চিত অবয়বে ও মাত্রায় লাভ অর্জন করবে। একই লক্ষ্যে তাঁর মতে নারীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিস্তৃত করা ঈপ্সিত। তিনি বলেন যে, সবদেশে গড় আয়ু বা জীবন প্রত্যাশা বাড়ার পটে জীবন ব্যাপ্ত প্রযুক্তি পরিচায়ক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট সাংসদদিগকে অতীব দ্রুততার সঙ্গে এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, এভাবে না এগোতে পারলে বিশ্বব্যাপী এখনকার উন্নয়নশীল দেশসমূহ উন্নত দেশসমূহের আপেক্ষিকতায় পিছিয়ে পড়বে। তাঁর মতে, বিত্তশালী ও উন্নত পৃথিবীতে সার্বিক উদ্ভাবন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই প্রেক্ষিতে তাদের পর্যায়ে বিত্তস্বল্প দেশসমূহকে উন্নীত করা ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁর সঙ্গে আলোচনার শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নের পথে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জুয়েলিকের অযৌক্তিক ও একচ্ছত্রিক সিদ্ধান্ত ঐ সংস্থার ইতিহাসে উন্নয়ন পরিপন্থী বলে আমি উল্লেখ করি। ড. কিম এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে এরকম সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংক আর নেবে না বলে উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষ্টিনা লাগার্ডে ড. কিমের সকল কথা সমর্থন করে বাণিজ্য যুদ্ধ পরিহার করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা প্রযুক্ত করার জন্য জোর সুপারিশ উপস্থাপন করেন। তিনি এ ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন যে, সমকালীন এসব সমস্যা দূর করে এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন হবে যথার্থ তথ্য ও উপাত্ত আহরণ, প্রযুক্তি উন্নয়নের কাঠামো সৃজন, উদ্ভাবনশীল বিনিয়োগ সমর্থন করা ও প্রসারিত করার জন্য অর্থায়নের সুযোগ ও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এবং শ্রমিকের যথাযথ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান। এই প্রক্রিয়ায় তিনি নারী ও বালিকাদের প্রতিকূলে বৈষম্য দূর করে নারী পুরুষ সবাইকে সমগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত ও অনুসৃত নারী শিক্ষা ও ভূমিকা সম্প্রসারণে নেয়া কার্যক্রম ইতিবাচক এবং উন্নয়নশীল সব দেশে অনুসরণীয় বলে উল্লেখ করেন। ইন্দোনেশিয়ার অর্থমন্ত্রী মূলবাণী ইন্দাবতী সুশাসনের ভিত্তিতে ব্যক্তি উদ্যম প্রসারণের ওপর জোর দেন। তিনি এই ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অবস্থান সমর্থন করে বলেন যে, সমৃদ্ধির ভিত্তি হলো মানব মূলধন সৃজনে সকল দেশের অধিকতর বিনিয়োগকরণ। সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে এই নেটওয়ার্কের এশিয়া পরিচ্ছেদ বা উপ-বলয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উপবলয়ের কেন্দ্র আমার প্রস্তাব অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মালয়েশিয়ার শামসুল ইসকান্দার আকিন এই সিদ্ধান্তকে সকল মালয়েশিয়ানদের তরফ থেকে স্বাগত জানান। এই কেন্দ্রে সময়ান্তরিক সভা বা সম্মেলনের মাধ্যমে নেটওয়ার্কের এশিয়ান সদস্যগণ এই এলাকায় গ্রহণীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম বিশ্বব্যাংক ও আই এম এফ এর সঙ্গে সম্পর্কের আলোকে বস্তুনিষ্ঠভাবে শনাক্ত ও গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সরকারকে উদ্ভাবনশীল ও গণতান্ত্রিক পরামর্শ এবং অনুশাসন দিতে পারবে বলে সবাই মত প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের জন্য এরূপ উপবলয় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা ও কার্যশীল করা হয়েছে। সম্মেলন শেষে উপানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় আমরা উপস্থিত সকল সাংসদ অনুধাবন করেছি যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দুই শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান- বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কেবলমাত্র বিত্তশালী দেশসমূহের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করার সূত্রের বাইরে উন্নয়নশীল দেশসমূহের সমস্যা সমাধানে অধিকতর আগ্রহ ও নিষ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসার মূলমন্ত্র গ্রহণ করতে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে এবং সহায়তা প্রত্যাশী বিত্তস্বল্প দেশের ওপর বিত্তবানের এসব দেশে সাহায্যের শর্ত হিসেবে কঠিন ও বাস্তবতা বর্জিত কার্যক্রম আরোপণ না করে তাদের ভিন্নতর আর্থ-রাজনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ ও জনকল্যাণমূলক উন্নয়নে অংশীদার হয়ে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সহযোগিতা ফলপ্রসূভাবে বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছে। আমাদের বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরিচালন নীতিতে এরূপ পরিবর্তন এই দুই আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অধিকতর কার্যক্ষম করবে বলে প্রতিভাত হয়েছে। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী
×