ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বায়েজিদ দৌলা বিপু

অভিমত ॥ সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৬ নভেম্বর ২০১৮

অভিমত ॥ সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আনুমানিক ১৮, ৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং আহত হয় ৪০০,০০০/- মানুষ। এর ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) প্রায় ২% ক্ষতি হয়। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী মূলত সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থাসমূহের লাগামহীন দুর্নীতি, পরিবহন মালিক-রাজনীতিকদের ক্ষমতার অপব্যবহার, চালক-পথচারীর বেপরোয়া দায়িত্বহীন আচরণ, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলাভঙ্গসহ নানাবিধ কারণ। তদুপরি, আইনী বিধি-বিধানের যথার্থ প্রয়োগ না থাকার ফলে সড়ক পরিবহন সেক্টরে বিরাজ করছে এক দুঃসহ নৈরাজ্য। সড়ক পরিবহনের নৈরাজ্যকর স্বরূপ অনেকটা বিভীষিকার মতো। বাসস্টপ থাকা সত্ত্বেও বাস দাঁড়িয়ে পড়ছে রাস্তার মাঝখানে। যাত্রীরাও ওঠানামা করছে। পেছন থেকে ছুটে আসা ছোটবড় বাহনগুলো এঁকেবেঁকে বাসকে অতিক্রম করছে। ঝুঁকিপূর্ণ অসতর্ক যাত্রীকে বাঁচাতে হঠাৎ ব্রেক কষছে অথবা দিক পরিবর্তন করছে। যাত্রী নামার আগেই অপেক্ষমাণ যাত্রীরা জোর করে ঠেলে উঠছে। ভেতরের যাত্রীরা গন্তব্যে নামার জন্য লড়াই করছে। দরজায় চলছে এক মল্লযুদ্ধ। চলন্ত বাসে উঠতে কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ লাফ দিয়ে উঠছে, আবার কেউ-বা বাসের হাতল ধরে ঝুলছে। এই পরিবহন নৈরাজ্য বিস্তৃত নগরজুড়ে। নৈরাজ্য তৈরিতে অসচেতন স্বেচ্ছাচারী পথচারীদের দায়ও কম নয়। কাঁটাতারের বেড়া, উঁচু ডিভাইডার টপকে লাফ দিয়ে তারা পার হবেন, কিন্তু ফুটওভারব্রিজে উঠবেন না বা উঠতে চান না। অতো উঁচু দিয়ে যাতায়াত শারীরিকভাবে অসমর্থদের জন্য কষ্টসাধ্য। এটি মেনে নেয়া যায় এবং তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প উদ্ভাবন হতে পারে। কিন্তু জোয়ানরা গায়ের জোরে নিয়ম ভাঙবেন, এটি আদিম বন্য আচরণ। তা বদলাতে হবে। তবে অপরিচ্ছনতার অভিযোগে নিরাপদ পারাপারের এই প্রযুক্তি এড়িয়ে চলতে চাইলে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া, একটি উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রায় অব্যবহৃত থাকায় সেতুগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে ছিন্নমূল মানুষেরা ভাসমান বাসস্থান বানিয়ে ফেলেন। আবার উঁচু সেতুগুলো নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেও মাদকসেবীরা ব্যবহার করে থাকে। আন্ডারপাসের সংখ্যা তুলনায় কম থাকলেও সেগুলোর ব্যবহারও যথার্থ নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জেব্রাক্রসিং খুব চোখে পড়ে না। রাস্তাজুড়ে মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য দুঃসহ। তাদের এলোমেলো আচরণ ট্রাফিক গতি ও পথচারীদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। মহামান্য হাইকের্টের আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে সড়ক ছেড়ে তারা উঠে পড়ে পথচারীদের ওপর। আবার, দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেতে পথচারীরা নেমে পড়েন সড়কে। বড় বাস ও মিনিবাসগুলোর দিকে নজর পড়লে শিউরে উঠতে হয়। ক্ষতবিক্ষত অবয়বের বাসগুলোর মধ্যে রাস্তায় চলে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দানবের মতো বেপরোয়াভাবে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। বাসচালকদের এই দানবীয় প্রতিযোগিতা ও উন্মাদ আচরণের সাম্প্রতিক শিকার দুই শিক্ষার্থী মিম ও রাজীব। তাদের অনাকাক্সিক্ষত মর্মান্তিক মৃত্যুতে স্কুল শিক্ষার্থীদের সতত প্রতিবাদ সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর আন্দোলনে রূপ নিলেও বিএনপি-জামায়াত ওই আন্দোলনটিকে সরকার পতনের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাদের দায়িত্বহীন রাজনৈতিক আচরণের ফলে মৃত্যু ঘটে একটি ইতিবাচক সামাজিক আন্দোলনের। তবে, শিক্ষার্থীদের নয় দফা দাবি মেনে নিয়ে সরকার নতুন ‘পরিবহন আইন ২০১৮‘ ঘোষণা করে। নতুন পরিবহন আইনকে মালিকরা স্বাগত জানালেও, প্রকৃতপক্ষে তাদের অসহযোগিতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি সড়ক বাস্তবতার আশানুরূপ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই সংঘটিত হচ্ছে শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত অপরাধ। আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে ‘মাসোহারা‘, উল্টোপথে চলা, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো, ঘুষ-দুর্নীতি ও দায়িত্ব অবহেলাসহ নানা ধরনের রীতিবহির্ভূত আচার-আচরণ পরিবহন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্যোগকে শিথিল করে ফেলেছে। বাস্তবিক অর্থে, নিয়ম ভাঙ্গার যে সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে সেটি মজ্জাগত হয়ে গেছে। ফলে চালকরা কাউকেই পরোয়া করেন না, আইনকে তো নয়ই। মহাসড়কে যে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান, পাল্লা দিয়ে একে অপরকে ওভারটেক করেন তাতে শুধু অন্য বাহনগুলোই নয়, পথচারীরা নয়, যাত্রীরা পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। চালকদের এই অনিয়ন্ত্রিত আচরণ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেকে এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িও রেহাই পায়নি। চালকদের এই আচরণ দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা একটি পরিবহন সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ, যার মূল সুবিস্তৃত ও অনেক গভীরে বিন্যস্ত এবং একটি রাজনৈতিক অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই অর্থনীতিতে পুঁজির জোগান দেয় একটি সমন্বিত প্রবহমান ‘চাঁদাবাজির স্রোত’ যা থেকে তৃষ্ণা মেটায় মালিক-শ্রমিক, পুলিশ রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট অপরাধ জগত। স্রোতের নিরাপত্তা, পরিবর্ধন ও পরিচর্যা নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীদের সমন্বিত সিন্ডিকেট। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক উদ্যোগ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সড়ক দুর্ঘটনারোধ করতে ২৪ জুন মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছয় দফা নির্দেশনা দেন। এক. ড্রাইভার ও হেলপারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে; দুই. লং ডিস্ট্যান্স (দূরপাল্লা) ড্রাইভিংয়ে বিকল্প ড্রাইভার রাখতে হবে, যাতে একজন ড্রাইভারকে একটানা পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে না হয়; তিন. সড়কের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে সার্ভিস সেন্টার ও বিশ্রামাগার নির্মাণ করতে হবে; চার. অনিয়মতান্ত্রিভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। পাঁচ. সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; এবং ছয়. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে। লেখক : রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক [email protected]
×