ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাতক্ষীরায় নৌকার পালে হাওয়া, শক্ত প্রতিপক্ষ হতে পারে ছদ্ম জামায়াত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ নভেম্বর ২০১৮

 সাতক্ষীরায় নৌকার পালে হাওয়া, শক্ত প্রতিপক্ষ হতে পারে ছদ্ম জামায়াত

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই মাঠে থাকা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। নৌকার হাল ধরতে প্রথমদিকে অনেক নেতা মাঠে থাকলেও এখন অনেককেই আর মাঠে সরব থাকতে দেখা যাচ্ছে না। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগ এখন অপেক্ষা করছেন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপি ও জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনে ভোটারদের আলোচনায় এসেছে। জামায়াত স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেÑ এমন প্রচার এখন সাধারণ ভোটারদের মধ্যে। প্রাথমিক প্রচারে মাঠে থাকা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখে সাতক্ষীরার চারটি আসনেই নৌকার পালে হাওয়া লেগেছেÑ মনে হলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দলীয় বিভাজন, একাধিক প্রার্থীর পৃথক পৃথক মাঠে অবস্থান দলের হাওয়াকে দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গত ৫ বছরে দলের বিভাজন থেকে সরে আসতে পারেনি। সাধারণ কর্মী, ভোটার ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মন জয় করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এমন অভিযোগ। আর অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে দলের পরিবর্তে পরিবারতন্ত্র গড়ে তোলার অভিযোগ নেতাকর্মীদের। তবে মনোয়নপ্রত্যাশী সবাই অভিন্ন কণ্ঠে বলছেন, কেন্দ্র থেকে সিগন্যাল পেয়ে সবাই মাঠে রয়েছেন। সাতক্ষীরায় মোট আসন চার। আর এই চারটি আসনে নৌকার হাল ধরতে চান বর্তমান সাংসদসহ নবীনরাও। জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন মৌসুমি একাধিক পাখি ক্ষমতাসীন দলটিতে ভিড়তে ব্যস্ত। এই মৌসুমি কোকিলদের মাঠে থাকাকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ভাল চোখে দেখছেন না। দলে একাধিক প্রার্থিতার হিড়িক, উপরন্তু জোটের শরিক দলগুলো চারটি আসনের দুটিতেই ভাগ চাইছে। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। ২৮ অক্টোবর তালায় ওয়ার্কার্স পার্টির একটি কর্মিসভায় রাশেদ খান মেনন সাতক্ষীরা ১ (তালা-লারোয়া) আসনে আগামী নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সাংসদ ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লার নাম ঘোষণা দেয়ায় এ আসন নিয়ে এখন নতুন করে সমীকরণ শুরু হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দাবি, তৃণমূলের মত নিয়ে যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে চারটি আসনই আওয়ামী লীগ ঘরে আসার সম্ভাবনা আছে। বিএনপিতেও একাধিক প্রার্থী। বিশেষ করে সাতক্ষীরার একাধিক আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের শরিক জামায়াতের টানাপোড়েন রয়েছে। সব আসন বিএনপিকে এবার ছেড়ে দিতে নারাজ জামায়াত। বিএনপিও চায় তাদের হারানো অন্তত একটি আসন পুনরুদ্ধার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ (ইনু) চায় জেলার দুটি আসন। জামায়াতও গোপনে তাদের তৎপরতা বহাল রেখেছে। জামায়াতের অনেক প্রার্থী নির্বাচনে স্বতন্ত্র অংশ নিতে কাজ করছে। সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) ॥ দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-১ আসনের বর্তমান এমপি ১৪ দল সমর্থিত ওয়ার্কার্স পার্টির দখলে। বরাবরই আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও এবার ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হচ্ছে বিএনপির সাবেক সাংসদ হাবিবুল ইসলাম হাবিব মাঠে এমন প্রচার রয়েছে। ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ এই আসনে বিজয়ী হয়। ২০০১ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচনে বিএনপি, ’৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী, ’৮৮ সালে জাতীয় পার্টি এবং ২০১৪ সালে ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করে। তবে এবার জোটের শরিক দলকে আসনটি ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন টানা ১৬ বছর ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকা সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর রহমান। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চায় তাদের দল থেকে এখানে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হোক। তবে বড় সমস্যা মহাজোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে। এখানে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মহাজোটের লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছেন দলের সভাপতির এমন ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎফুল্ল ভাব কমে গেছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় এই আসনে এখনও মাঠে সরব দেখা যাচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর রহমান ও কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপনকে। তবে এই আসনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সরদার আমজাদ হোসেন নৌকার হাল ধরার প্রত্যাশা করেন। এই আসনে মহাজোটের শরিক হিসেবে বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, জাসদের ওবায়দুস সুলতান বাবলু ও জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখত মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। সাতক্ষীরা-২ (সদর) ॥ জামায়াত ঘরানার আসন বলে পরিচিত আসনটি রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দখলে। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন বর্তমান সাংসদ মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু। তিন জনই পৃথকভাবে নৌকার প্রচার চালাচ্ছেন। প্রার্থী নির্বাচনে ভুল না হলে এবং তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দিলে আগামী নির্বাচনেও এ আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হবে বলে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দৃঢ় আশাবাদী। এই আসনে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পাঠাগার বিষয়ক সাবেক সম্পাদক আ হ ম তারেক উদ্দিন মনোনয়ন প্রত্যাশায় কেন্দ্রে লবিং করছেন বলে জানিয়েছেন। তবে এ আসনে ঐক্যফ্রন্টের শরিক জামায়াত এই আসনটি বিএনপিকে ছাড় দিতে নারাজ। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুবার নির্বাচিত হলেও ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়লাভ করে। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এ জব্বার। পরে ’১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। তবে নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকায় খুব একটা ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ’১৩ সালে জামায়াতের নারকীয় সন্ত্রাসের পর নাশকতার অভিযোগে দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখনও আত্মগোপনে। অনেকে রয়েছেন কারাগারে। বর্তমানে এখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য কোন তৎপরতা দেখা না গেলেও তারা গোপনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন প্রচার রয়েছে। এ আসনে জামায়াতের পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে তিনি হতে পারেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্ত প্রতিপক্ষ। সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-দেবহাটা-কালিগঞ্জ) ॥ তিন উপজেলার মোট ২০ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৩ আসন। ভাঙ্গাগড়ার আসনটি ২০০৮ সালে সর্বশেষ পুনর্গঠিত হয়েছে। নতুন সীমানা অনুযায়ী এই আসনে যুক্ত হয়েছে আশাশুনি উপজেলার ১১ ইউনিয়ন, দেবহাটা উপজেলার ৫ ও কালিগঞ্জ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন। এই আসনের এবারেরও শক্ত প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক। তিনি বর্তমানেও এ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন এমনটি নিশ্চিত থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ, আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) জামায়াতে হোসেন মাঠে রয়েছেন। এই আসনে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ডাঃ শহিদুল আলম বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন। জামায়াত এই আসনটি বিএনপিকে ছাড় দিতে নারাজ। জামায়াতের মুহাদ্দিস রবিউল বাশার এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন এমনটি প্রচার রয়েছে। সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর ও কালিগঞ্জের একাংশ) ॥ এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন বর্তমান সাংসদ এস এম জগলুল হায়দার। নতুন মুখ শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আতাউল হক দোলনও মাঠে নেমেছেন। এছাড়া জামায়াত ও বিএনপির রিজার্ভ ভোট মোকাবেলা করে দলের বিজয় সুনিশ্চিত করতে আগামী নির্বাচনে নতুনত্ব আনতে চায় আওয়ামী লীগ। সুন্দরবনঘেরা এ আসনের ১২ ইউনিয়নের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে কালিগঞ্জ উপজেলার ৮ ইউনিয়ন। মোট ২০ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে বর্তমান এমপি শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম জগলুল হায়দার। তবে আসনটিতে আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ রয়েছে। আসনটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন মুখ প্রত্যাশা করছেন নেতাকর্মীদের অনেকেই। তবে আসনটি ছাড় দিতে নারাজ মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি। এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে কেউ মনোনয়ন না পেলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এই আসনে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক ছাত্তার মোড়লের মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। অন্যদিকে আসনটিতে এবার শরিক জামায়াতকে ছাড় দিতে নারাজ বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নিলে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক সাংসদ কাজী আলাউদ্দিন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) থেকে এই আসনে একক প্রার্থী হিসেবে প্রচারে রয়েছেন সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী।
×