ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

শিশুরাই প্রোগ্রামিংয়ের ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৫ নভেম্বর ২০১৮

 শিশুরাই প্রোগ্রামিংয়ের ভবিষ্যত

অবশেষে একটি অসাধারণ কাজের ঐতিহাসিক মাইলফলক স্পর্শ করা গেল। আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুদের প্রোগ্রামার বানানোর মহৎ কর্মযজ্ঞের সূচনা হলো। গত ৩০ অক্টোবর তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বিসিসি মিলনায়তনে প্রথম জাতীয় শিশু-কিশোর প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সিআরআই-এর সহযোগিতায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ আয়োজিত এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটিতে আমি ছাড়াও বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক, সচিব জুয়েনা আজিজ, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক পার্থপ্রতিম দে, স্পন্সরদের প্রতিনিধি, সিআরআই-এর প্রতিনিধি, পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু-কিশোর, তাদের বাবা-মা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপস্থিত ছিলেন। দেশব্যাপী আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা বস্তুত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, গাছের গোড়ায় পানি ঢালাটাই সঠিক পন্থা। প্রোগ্রামার বানানোর প্রচলিত ধারণায় বিশ্ববিদ্যালয় বা স্নাতক স্তরে প্রোগ্রামিং শেখানোর চাইতে শৈশব থেকে প্রোগ্রামিং শেখানোটাই শ্রেষ্ঠতম উপায়। ৩০ অক্টোবর পুরস্কার বিতরণের আগে গত ৮ জুন শেখ হাসিনা যুবকেন্দ্রে শিশুদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্ব সমাপ্ত হয়। স্বপ্ন ও সূচনা : কম্পিউটারের সঙ্গে শিশুদের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রথম সাফল্যজনক কর্মসূচী আমি নিয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে। সেই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার গাজীপুরের ছায়াবীথিতে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও তার স্ত্রী বেগম সেলিনা মল্লিক। ২০০০ সালের প্রথম দিন থেকে সেই স্কুলটি চালু হয়। এরপর ২০০১ থেকে ক্রমান্বয়ে ৩২টি আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুলের মাধ্যমে আমি শিশুদের সঙ্গে কম্পিউটারের সম্পর্ক গড়ে তোলার লড়াই করে আসছি। আমার স্কুলের ধারণা নিয়ে আরও অনেকে শিশুদের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তখন থেকেই ভাবছিলাম শিশুরা কি কেবল কম্পিউটার ব্যবহার করতেই শিখবে? তারা কি শৈশবেই প্রোগ্রামার হতে পারে না? সেই ভাবনা থেকে বের হতে পারি যখন আমার নিজের ঘরে শিশু প্রোগ্রামার গড়ে ওঠে। আমি দেখলাম আমার ছেলে বিজয় জব্বার স্ক্র্যাচ শিখছে এবং দারুণভাবে আনন্দিত মনে হচ্ছে ওকে। ২০০৮ সালে নিজের ঘরে বসে বিজয়কে দেখেছি শৈশবেই অতি চমৎকারভাবে স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করতে। আমার এই সন্তানকে দিয়েই আমি অনুভব করতে পেরেছি যে, শৈশবের আগ্রহ থেকেই সে এখনকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়ে পারদর্শী হতে পেরেছে। যদি সেদিন তাকে প্রোগ্রামিং-এর সঙ্গে যুক্ত করতে না পারতাম বা সমস্যা সমাধানের চ্যালেঞ্জ ও সৃজনশীলতার দিকে আকৃষ্ট করতে না পারতাম তবে আজকে আমার নিজের সন্তানটির দক্ষতা আমি গর্ব করে বলতে পেতাম না। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারক বা প-িতরা এটি মানতেই চান না। তারা এখনও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বা তার ওপরে প্রোগ্রামিং শেখানোর কথা ভাবেন। শিশুরা যে অনেক বেশি সৃজনশীল, ওরা যে ভাবতে পারে, গড়তে পারে সেটিও তারা অনুভব করেন না। আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এই পশ্চাৎপদ ভাবনার শিকার। যতদিন এই বদ্ধ ধারণা থেকে বের হতে পারব না ততদিন আমরা ডিজিটাল বিপ্লবের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করতে সক্ষম হব না। বস্তুত বিজয়-এর স্ক্র্যাচ শেখার আগ্রহ দেখার পর থেকেই নানাভাবে শিশুদের স্ক্র্যাচ শেখানোর উদ্যোগ নেবার চেষ্টা করি। তবে সফলতা আসে অনেক দেরিতে। ১৬ সালে বেসিসের সভাপতি হয়ে প্রথম এই সিদ্ধান্ত নেই যে, দেশে শিশুদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করব। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ আমার এই উদ্যোগে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। গত বছর বিপিও সামিটে মন্ত্রী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ভাষণে প্রাথমিক স্তরে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানান। সেই সময়ই আমি তার সঙ্গে আলোচনা করি যে, আমরা শিশুদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করব। তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমার প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। তখন আমি বেসিসের সভাপতি। খুব সহজে এমন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করার জন্য প্রথমেই প্লাটফরম হিসেবে হাতের কাছে থাকা বেসিসকেই বাছাই করি। বেসিসের নির্বাহী কমিটি এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করার জন্য আমাকেই দায়িত্ব প্রদান করে। আমি অনুভব করি অন্য সকল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার মতো করে শিশু-কিশোর প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যাবে না। প্রথমত বড়দের প্রোগ্রামিং ভাষা ছোটদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। আমার সামনে অপসন ছিল স্ক্র্যাচ, পাইথন, বেসিক, জাভা ও রুবি থেকে শিশুদের জন্য প্রোগ্রামিং ভাষা বাছাই করা। আমি স্ক্র্যাচ ও পাইথনকে আধুনিকতম ভাষা হিসেবে বাছাই করি। পরীক্ষামূলকভাবে আমি নিশ্চিত করি যে, প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য স্ক্র্যাচ হলো সবচেয়ে উপযোগী ভাষা। অন্যদিকে পাইথন হতে পারে মাধ্যমিক স্তরের শেখার ভাষা। তবে তখনই মূল প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবতে হয়। বিষয়টি হচ্ছে যে শিশু-কিশোরদের স্ক্র্যাচ বা পাইথন প্রতিযোগিতায় আনতে হলে তাদের এই দুটি প্রোগ্রামিং ভাষা শেখাতে হবে। আমার মনে হলো শিশু-কিশোরদের শেখানোর জন্য শিক্ষকদের শেখাতে হবে। সেই লক্ষ্যেই বেসিসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গত ২৫ আগস্ট ১৭ সারাদিন ধরে আমরা ৩০ জন স্কুল শিক্ষককে এমআইটি ল্যাব উদ্ভাবিত শিশুদের প্রোগ্রামিং ভাষা স্ক্র্যাচ শেখানো শুরু করি। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ও ২২ সেপ্টেম্বর তৃতীয় ব্যাচ মিলে ৮টি ব্যাচে মোট ২৭৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অন্য আগ্রহীদের দিনব্যাপী কর্মশালার মধ্য দিয়ে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ভাষা শিশুদের কেমন করে শেখানো যায় তার আয়োজন করি। তখন আমাকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে মামুন ও মায়া শারমিন। এরপর ১৪ ডিসেম্বর ১৭ আমরা মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে স্কুল প্রোগ্রামিং শেখানোর স্কুল একটিভেশনও করতে পেরেছি। সেদিন আমরা ২২ জন শিশুকে স্ক্র্যাচ শিখিয়েছি এবং সেই স্কুলের স্ক্র্যাচ ল্যাব উদ্বোধন করেছি। এর আগে আমরা মিরপুরের সাফদার আলী স্কলার্স স্কুলে স্ক্র্যাচ ল্যাব উদ্বোধন করেছি। মিরপুর ইংলিশ ভার্সন স্কুলেও স্ক্র্যাচ ল্যাব উদ্বোধন করেছি। এরপর ৩ জানুয়ারি ১৮ আমি সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। মন্ত্রী হবার সুবাদে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি এই প্রস্তাবটি পেশ করতে পারি। তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এই বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন। এমনকি তিনি নিজে শিশুদের পুরস্কৃত করবেন বলেও আমাকে জানান। এরপরই আমি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে বলি। আমি একটু স্মরণ করতে চাই যে, এর আগে যতবারই শিশুদের প্রোগ্রামিং নিয়ে কথা বলেছি ততবারই হতাশাজনক জবাব পেয়েছি। স্ক্র্যাচ শেখানোর উপকরণও আমি পাচ্ছিলাম না। বেসিসে যখন শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলাম তখনও শিক্ষা উপকরণ ছিল না। তবুও আমার মাঝে হতাশা কাজ করেনি। বরং ১৭ সালে ছেলেটা যখন তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক হয়ে ঘরে ফিরে তখন তাকেই বলি স্ক্র্যাচ বিষয়ে শিক্ষা উপকরণ তৈরি করার জন্য। আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় যে, ছেলে বিজয় জব্বার সেই কাজটি সম্পন্ন করেছে। ইতোমধ্যেই বিজয় স্ক্র্যাচ বিষয়ক ইংরেজী বইটি প্রকাশ করতে পেরেছে। বাংলা বইটিও লেখা শেষ হয়েছে। সহসাই সেটিও প্রকাশিত হবে। স্ক্রাচ প্রোগ্রামিং ভাষা : প্রথমেই আমি আপনাদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং ভাষার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যাদের আগ্রহ আছে তারা স্ক্র্যাচ বিষয়ে ইন্টারনেটে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। ওখানে বলা আছে- The Scratch project, initiated in 2003, has received generous support from the National Science Foundation (grants 0325828, 1002713, 1027848, 1019396), Intel Foundation, Microsoft, MacArthur Foundation, LEGO Foundation, Code-to-Learn Foundation, Google, Dell, Fastly, Inversoft, and MIT Media Lab research consortia. (https://scratch.mit.edu/about/) ২০০৩ সালে সূচনা হলেও স্ক্র্যাচ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় ২০০৭ সাল থেকে। আমি আগেই বলেছি যে, আমার ছেলে বিজয়কে ২০০৮ সাল থেকেই স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করতে শুরু করতে দেখেছি। এমনকি এরপর যখন সে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়েছে তখনও তার প্রিয় বিষয় ছিল স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করা। এই দশ বছরে বস্তুত এই প্রোগ্রামটি বিশ্বকে জয় করেছে। এমআইটি ল্যাবের সাইটে বলা হয়েছে, With Scratch, you can program your own interactive stories, games, and animations — and share your creations with others in the online community. Scratch helps young people learn to think creatively, reason systematically, and work collaboratively— essential skills for life in the 21st century. Scratch is a project of the Lifelong Kindergarten Group at the MIT Media Lab. It is provided free of charge. প্রথমে নিজে এমআইটি ল্যাব উদ্ভাবিত স্ক্র্যাচ নামক এই প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজটি পরীক্ষা করে দেখি। ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সের শিশুর জন্য খুব সহজে প্রোগ্রামিং ধারণা পাবার জন্য এটি একটি অতি চমৎকার প্রোগ্রামিং ভাষা। এমআইটির মন্তব্য হচ্ছে, Scratch is designed especially for ages 8 to 16, but is used by people of all ages. Millions of people are creating Scratch projects in a wide variety of settings, including homes, schools, museums, libraries, and community centers. এক দশকে এই ভাষাটি দিয়ে লাখ লাখ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে, যা শিশুদের সৃজনশীলতাকে বিশ্বজুড়ে উন্মোচিত করেছে। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক ই-মেইল ঃ [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×