ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকালে ভোটের পালে লাগে হাওয়া

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৫ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচনকালে ভোটের পালে লাগে হাওয়া

নদীর ধর্মই হচ্ছে বয়ে যাওয়া। কুলুকুলু শব্দের তরঙ্গে নাচতে নাচতে ছুটে চলা তার সাগরের পানে। নদী কখনও থাকে শান্ত। কখনও উত্তাল। ঢেউয়ের পরে ঢেউ ছড়িয়ে তার পথচলা অবিরাম চলে। বাধা পেলে বদলে যায় গতিপথ। থেমে থাকা যেহেতু তার স্বভাব নয়, তাই ছুটে চলে সে। ভাঙ্গা-গড়ার খেলাও খেলে। রাজনীতিরও অবস্থা অনুরূপ। জনগণের কাছে ঘুরে ফিরে তাকে আসতেই হয়। চলার পথে বাধা পেলে বিকল্প পথ বেছে নেয় কখনও কখনও। কখনও থাকে শান্ত, কখনও অশান্ত। দল ভাঙ্গা দল গড়াও তার স্বভাবজাত। এক নদী যেমন আরেক নদীতে মেশে, তেমনি এক দল আরও দল নিয়ে গড়ে তোলে জোট বা ফ্রন্ট। জনগণের সেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতি চর্চার বিষয়টি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সেই রাজনীতি আবার গণবিরোধীও হয়ে ওঠে। নদী পারাপারের জন্য নৌকোসহ নৌযান ব্যবহৃত হয় যেমন, তেমনি গড়ে ওঠে সেতু। রাজনীতিতেও এক ধরনের সেতু গড়ে ওঠে। এক দলের সঙ্গে অন্য দলের কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যেও থাকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সেতু। এক জনপদের সঙ্গে অন্য জনপদের যোগাযোগ গড়ে তোলার এই সেতু মিলিত হওয়ারও এক নিদর্শন। রাজনৈতিক মানুষকেও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য গড়ে তুলতে হয় সংযোগ সেতু। চলার পথ মসৃণ করার জন্য পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহমর্মিতার হাত বাড়াতেই হয়। বিরোধিতা শান্তি বিঘœ করে, হানাহানির পথ করে প্রশস্ত, ধ্বংসকে আনে ডেকে পতনের সিঁড়ি নিচে নামতে থাকে। এসব থেকে দূরত্ব দূরে থেকে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের ভাষায় কথা বলার মধ্যেই আছে বাস্তবতার দিকদর্শন। জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শ ও লক্ষ্য পেশ করার মাধ্যমে জনগণমন অধিনায়ক হওয়ার দিগন্ত হয় উন্মোচিত। মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা, অপরিহার্যতা তুলে ধরা গেলে, মানুষ নিশ্চয় কাছে টেনে নেবে, বুকে মেলাবে বুক। জনগণই নির্বাচিত করেন কে হবেন তার প্রতিনিধি। কে হবেন তার নেতা। ভোটের মাধ্যমেই এই নির্বাচন হয়ে আসছে। কিন্তু এই ভোট নিয়ে চলে নানা টালবাহানা। ভোটের রাজনীতি অনেক সময় হয়ে যায় বিপদসঙ্কুল। বিপথে চালিত হয় অনেকেই। ভোট নিয়ে তাই থাকে সংশয়, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। হানাহানি, সংঘর্ষ, হাঙ্গামারও অন্ত থাকে না। এদেশে নির্বাচন আয়োজন খুব সহজসাধ্য নয়। যদিও দেশবাসী নির্বাচনকে দেখে উৎসব হিসেবে। কিন্তু সেই উৎসবেও ভাটা পড়ে। শক্তিমত্তার প্রদর্শন যখন চলে, তখন ভোটে অংশগ্রহণ দুষ্কর হয়ে পড়ে। দুর্বৃত্তদের দাপট তীব্র হয়ে যখন ওঠে, তখন ভোট পরিণত হয় প্রহসনে। এসব কাজে রাজনৈতিক দলগুলোরই থাকে মুখ্য ভূমিকা। যে কোন মূল্যে বিজয় অর্জনের জন্য হীনপথ বেছে নিতে কসুর করে না তখন। ভোটার দলনের নির্মম দৃশ্যগুলো হয়ে যায় পীড়াদায়ক। এ দেশের জনগণ নির্বাচন ভীতিতে কাটিয়েছে সামরিক শাসনকালে, এমনকি গণতান্ত্রিক আমলেও। ক্রমশ সেসব অপসৃয়মান হয়ে আসছে। মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য বাহুবলের বিপরীতে সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হওয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে ভোটদানের জন্য দেশবাসী অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম এমনকি প্রাণদানও করেছে। সেসব ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আর দেরি নেই। ভোটের চাঁদ আকাশে উঁকি দিচ্ছে। তার আলোকচ্ছটা ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। দিকে দিগন্তে নির্বাচনের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। জনগণের দরবারে ভোট প্রার্থীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সভা-সমাবেশের অন্ত নেই গ্রামগঞ্জ, শহর নগর বন্দরজুড়ে। সবার লক্ষ্য ভোটারের মন জয় করা। এই মন জয়ের পথও পদ্ধতি সবার একরকম নয়। অর্থ, উপঢৌকনের ব্যবহারে কম যায় না অনেক প্রার্থী। যদিও তা আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। প্রতিশ্রুতির বহর বাড়ছে। নানা আশা-আশ্বাস জনগণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করানোর চলছে নানা কসরত। যে জনগণকে একদা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে দেখা গেছে কোন কোন প্রার্থীকে, সেই জনগণকে বুকে নিতে এখন উদগ্রীব তারা। ভাই বন্ধু, স্বজন বলে কাছে টেনে নিতে নেই দ্বিধা। ভোটার আর প্রার্থী যেন তখন কত আপনজন হয়ে যায়। ভোটারের মন গলানোর মধ্যেই বুঝি নিহিত রয়েছে বিজয়ের পতাকাকে অর্জন করা। নির্বাচনের আকাশজুড়ে কালো মেঘও ভাসে কখনও কখনও। ভোটকেন্দ্র দখলের মহড়া থেকে পুরোপুরি দখল, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো, ভোটপ্রদানে বাধাদানের দৃশ্য জনগণ আর দেখতে চায় না। তারা চায় না বলেই ভুয়া ভোটার আর জালভোট প্রদানের চিত্র ক্রমশ লুপ্তপ্রায়। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আর দেরি নেই। তফসিল ঘোষণার সময় সমাগত। নির্বাচন কমিশন এ সপ্তাহেই ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচনের দিনক্ষণ, আচরণবিধি। এ সপ্তাহেই জাতির উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে ভাষণ দেবেন, তাতেই তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষে হতে পারে নির্বাচন। দশম সংসদের প্রথম বৈঠক বসে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথবা পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। বিধান অনুযায়ী গত ৩০ অক্টোবর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ক্ষণগণনা। আজ সোমবার ৫ নবেম্বর সাত দিন হবে। চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন। ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তফসিল বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করেছে। ইতিবাচক সেই বৈঠকের ফল। নির্বাচন গণতন্ত্রেরই একটি অংশ। গণতন্ত্রের অর্থ হলো জনগণের মতামত অনুযায়ী দেশ শাসন। সরকার যদি মনে করে আমরা তো পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। সুতরাং পাঁচ বছর আমাদের কাজকর্মের হিসাব চাইতে পারবে না। আমরা যা খুশি করব। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ভোট প্রার্থী হিসেবে দেশবাসীর কাছে কি কবুল করেছিলেন তা বলে না। এসব এ দেশবাসী দেখেছে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে। ক্ষমতায় গিয়ে এ যাবতকালের তাদের কাজ একটি গ্রাম্য প্রবাদের সঙ্গে তুলনীয়। সেটি এইÑ ‘তুই মোর কোলের পোলাটি ধর, আমি তোর পান্তাভাত খেয়ে নেই।’ এসবই অতীতের কথা। বর্তমানকাল প্রযুক্তির কাল। এনালগ যুগ শেষ। কিন্তু ভোট হবে মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতে, যা অনেক দলই চায় না। নির্বাচন কমিশন ইভিএম মেশিন পদ্ধতিতে নির্বাচনে আগ্রহী। কিন্তু বিরোধী দলগুলো তা মানতে নারাজ। তারা সন্দেহ করে এই মেশিনে ভোট জালিয়াতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তথাপি ইসি কয়েকটি কেন্দ্রে এই মেশিন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইভিএম মেশিনে স্বচ্ছ, অবাধ নির্বাচন যেমন সম্ভব, তেমনি দ্রুত ভোট গণনাওÑ তাই ইসি ইভিএম মেশিন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল বিভাগীয় সদরসহ কয়েকটি জেলায়। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে প্রার্থী ও ভোটারদের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ বাড়ছে। ইতোমধ্যে সংলাপ পর্বও চলছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সংলাপের দিকে সকলেরই দৃষ্টি এখন। সংলাপকারীরা সংলাপে এসে নিজেদের বক্তব্য ভালভাবে তুলে ধরতে না পেরে বেরিয়ে এসে বলছেন, আন্দোলন করবেন। অথচ গত পাঁচ বছরে তারা কোন আন্দোলন গড়তে পারেননি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে সমঝোতার সংলাপে বসেছিলেন কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিএনপিসহ আরও দুটি দল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামধারণকারী এই ফ্রন্টের নেতারা গণভবনে শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের ৭ দফা দাবি তুলে ধরে। সেসব নিয়ে আলোচনাকালে সংবিধানসম্মত উপায়ে সমাধানের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। সরকার পক্ষ হতে তিনটি দাবি তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয়া হয়। অপর দাবিগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংলাপে শেখ হাসিনা ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ১৪ দলের যে বৈঠক হয়, তাতে যুক্তফ্রন্ট আশ্বস্ত হয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ভোটে চান। সুন্দর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সংলাপে তারা খুশি। তারা যে সাত দফা দাবি পেশ করেছেন, সেসব নিয়ে সংলাপে আলোচনা হয়েছে। সংলাপে সবাই সন্তুষ্ট হলেও বিএনপি প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে স্বস্তিবোধ যে করেছে তা স্পষ্ট। তাদের সমস্যা খালেদার মুক্তি। প্রমাণিত দুর্নীতির দায়ে বেগম জিয়া ও তার পুত্রের কারাদ- হয়েছে। কোন রাজনৈতিক কারণে নয়। অথচ তাকে রাজবন্দী হিসেবে অভিহিত করে বিএনপি মুক্তি দাবি করছে। আদালতে জোরালো অবস্থান নিতে না পারা বিএনপি ডক্টর কামালের ওপরে ভরসা করে যে রাজনীতি করছেন, তা নির্বাচন পর্যন্ত যদি অব্যাহত থাকে তবে ভোটে তারা ভাল আসন পেতে পারেন। দেশের রাজনীতিতে এখন সাদা পেঁজা তুলোর মতো স্বচ্ছ মেঘের আবরণ দেখা যায়। কোথাও কোন সঙ্কট নেই। সঙ্কট শুধু বিএনপি-জামায়াত জোটের মধ্যে। জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে। তাকে নিষিদ্ধের দাবি করা হচ্ছে। আর বিএনপি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। নির্বাচন বর্জন করার অবস্থা বিএনপির নেই। সংলাপ ব্যর্থ হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিলেও বিএনপির পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবস্থা আর নেই। কামাল হোসেনের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তাকে পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরপরই দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়া হাওয়া বইতে থাকবে। সারাদেশ নির্বাচনী উৎসবে যোগ দিতে ধাবিত হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচন হোক শঙ্কামুক্ত দেশবাসী তাই চায়।
×