ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৪ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ-রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়

বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে রাশিয়া। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বাণিজ্য সংকট কাটাতে একমত হয়েছে দুই দেশ। যৌথভাবে আয়োজন করবে বাণিজ্যমেলা। ওয়্যার হাউস স্থাপনসহ বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিতে উদ্যোগী হয়েছে রাশিয়া। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ মানবশক্তি রফতানিতেও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ রাশিয়া সরাসরি ফ্লাইট চালু হবে। বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সিকিউরিটি প্রদানে সহায়তা দেবে রাশিয়া। সম্প্রতি মস্কোতে দুইপক্ষের মধ্যে ট্রেড, ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল কো অপারেশন বিষয়ক ইন্টার-গবর্নমেন্টাল কমিশনের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে কিছু দিনের মধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে আন্তঃব্যাংক সম্পর্কোন্নয়নে তথা ডিরেক্ট করেসপন্ডেন্ট ব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে। দু দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্য যোগাযোগে এলসি সুবিধার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। এটি চালু হলে আমদানি-রফতানি বানিজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার লেনদেন সহজে করা সম্ভব হবে। এছাড়াও বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সহায়তা, ফিসারিজ, কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ, টেলি কমিউনিকেশন, সরাসরি বিমান, সমুদ্রপথে যোগাযোগ ওয়্যার হাউস চালু এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির দ্বারও উন্মোচিত হচ্ছে। বৈঠক শেষে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ইন্টার গবর্নমেন্টাল কমিশনে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক প্রোটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের পথ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোনার বাংলা গড়তে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে রাশিয়া। রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার পয়েন্ট স্থাপনে রাশিয়ার সহযোগিতা তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই রাশিয়া বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালী মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মিত্রশক্তি হিসেবে সবরকম সহযোগিতা দেয়। ভারতের মিত্র সোভিয়েট ইউনিয়ন স্বভাবতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়। সোভিয়েট জনগণও বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, অত্যাচার, নির্যাতন মেনে নিতে পারেনি। তাই সোভিয়েট সরকার মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিক সমর্থন যুগিয়েছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দেয় স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করে। ডুবন্ত জাহাজ আর মাইনের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর অচল অবস্থায় ছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন ছাড়া খুব কম দেশেরই তখন এ জঞ্জাল পরিষ্কার করার কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য ছিল। সোভিয়েট সরকার শুধু বন্দর সচল নয়, আশুগঞ্জ বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো মেরামত করা, নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, ব্রিজ মেরামত, বন্ধ হয়ে থাকা শিল্প-কল-কারখানা চালু করা, বার্টার চুক্তির মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ে পণ্য আমদানি-রফতানি করা থেকে শুরু করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশেও আগ্রহী ভূমিকা পালন করে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে মাইন অপসারণ করতে গিয়ে রাশিয়ার ছয়জন নাবিক মারা যায়। ১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আমূল পরিবর্তন আসে। দেশ পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আশির দশকে উভয় দেশের মধ্যে কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে। নব্বইয়ের দশক থেকে রাশিয়ার সঙ্গে আবার সম্পর্কের উন্নতি হতে থাকে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়া থেকেও মিগ-২৯সহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে। বাংলাদেশ রাশিয়াতে প্রধানত নিট ও ওভেন পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও কৃষিপণ্য রফতানি করে। প্লাস্টিক, সিরামিকস্্, ওষুধ, তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য প্রভৃতি রফতানির সুযোগ থাকে। রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, অভ্যন্তরীণ বাজার বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করেছে এটি নিশ্চিত না হওয়ায় দেশটির বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধি এতদিন অবারিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব বাণিজ্যে বড় বড় প্লেয়ারদের সঙ্গে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি না হওয়ায় রাশিয়াকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হতে ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠার পরও ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। বড় বড় অর্থনীতির সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতায় পৌঁছতে হয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৬০ কোটি ডলার। এটি ২০১৬ সালের তুলনায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রফতানি ৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। যা তার আগের বছরের তুলনায় ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের আমদানি ৭৬ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য । যা তার আগের বছরের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ কম।
×