ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাজারের নাম ‘বাবুরহাট’

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৪ নভেম্বর ২০১৮

বাজারের নাম ‘বাবুরহাট’

সুমন্ত গুপ্ত বাড়ির কাছে আরশীনগরের মতো এই রাজধানী ঢাকার উত্তর-পূর্বে সদর দরজার কাছে মাধবদির বাবুরহাটে ঘটে চলেছে অভাবনীয় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। শুক্র থেকে রবিবারÑ এই তিন দিন সারাদেশের কাপড় বা বস্ত্র পাইকার-ব্যবসায়ীদের বিপণন-তীর্থ হয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের এই মোকাম। তিন শ’ বছরে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই বস্ত্র-হাটের অলিগলিতে আলো-আঁধারিতে টিনের ছাউনি দেয়া হাজার হাজার দোকানের বিস্ময়। হাজারো ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। ব্যবসায়ীদের জন্য এখানে দিন-রাতের ফারাক থাকে না। নাওয়া-খাওয়া-ঘুমের ফুরসত মেলা দায়। আর এই কাপড় কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে সারাদেশে। পাইকারি কাপড় মানেই যেন নরসিংদী। বাবুরহাটে মোকাম করার জন্য দেশের বড় বড় কাপড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে। এখানে মোকাম না করলে তাদের ব্যবসার অপূর্ণতা থেকে যায়। কথিত আছে, এই অঞ্চলের জমিদার আশু বাবু প্রথমে তিরিশের দশকে মাধবদিতে হাট বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু কোন কারণে তার ভাই কালী বাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া হলে কালী বাবু, প্রমথ বাবু ও গোপাল বাবু শেখেরচরে বাবুরহাট প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন বাবুরহাট বড় বাজার হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় এবং সেই থেকে এটিই বাবুরহাট নামে প্রসিদ্ধ হয়। আসলেই এক সময় মেঘনা নদীর পাড়ঘেঁষা এই বাজারে বিভিন্ন এলাকার বাবুরা তাদের উৎপাদিত কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য মোকাম করতেন বলে জানান এখানকার প্রবীণরা। কিন্তু এখন আর বাবুরহাট বাবুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এটি সার্বজনীন বাজারে রূপ নিয়েছে। এই বাজারকে কেন্দ্র করে নরসিংদীসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় গড়ে উঠেছে লাখো তাঁতশিল্প। আর এসব তাঁতশিল্পে উৎপাদিত হয় বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এসব কাপড় বাবুরহাটে নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় জমিদার হলধর সাহা বর্তমানে এ হাটে ৫ হাজারেরও বেশি দোকান রয়েছে। এমন কোন কাপড় নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। ৮৩ বছরের পুরনো পাইকারি এই কাপড়ের হাটে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় কোটি কোটি টাকার কাপড়। নরসিংদী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বাবুরহাট এক সময় শুধু রবিবার বসত। চাহিদা ব্যাপক থাকায় এখন সপ্তাহে দুই দিন শুক্র ও শনিবার হাট বসে। তবে ঈদ এলে সপ্তাহজুড়েই চলে কেনাবেচা। বাবুরহাটে বিক্রি হওয়া থানকাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েলকাপড়, সুতি, শাড়ি, লুঙ্গি ও থ্রি-পিস নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতশিল্পে উৎপন্ন। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত নাইট কুইন, দেশী জর্জেট, লেজার জর্জেট, জাপানী সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, কাতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাট হয়ে উঠে বৈচিত্র্যময়। আর এই হাট থেকে কাপড় কিনে ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যান। বাবুরহাটকে ঘিরে শুধু নরসিংদীর আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে লাখো তাঁতকল। শুধু নরসিংদীতেই নয়, পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জেও গড়ে উঠেছে হাজার হাজার তাঁতকল। বাবুরহাটকে সংস্কার করে শেখেরচর নামে নামকরণ করেছে স্থানীয়রা। তবে ব্যবসায়ীরা বাবুরহাট নামেই চেনেন। এখানে শুধু পাইকারি ব্যবসায়ীরাই কাপড় কেনেন তা নয়, এখানে সাধারণ ক্রেতারাও আসেন কাপড় কিনতে। বাবুরহাট মানে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রঙের গন্ধ। বেশি ক্রেতা বেশি বিক্রি। সপ্তাহের তিন দিনে বিক্রি-বাট্টা হয় অবিশ্বাস্য অঙ্কে। এক রাতেই বিক্রি হয় প্রায় চার শ’ কোটি টাকা। তিন দিনে যার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার ওপর। সেই হিসাব মেলাতে মেলাতেই ফিরে আসে নতুন সপ্তাহ। নিশুতি রাতের সুসুপ্তি যখন চরাচরজুড়ে নিথর-নিস্তব্ধতা অধিকার করে নেয় তখনও এ হাটের চারদিকে হাঁক-ডাক। দরদামের কোলাহল, কুলিদের ব্যস্ততা। দোকানের সামনে ভ্যানের দীর্ঘ সারি। হাটের গা-ঘেঁষে বড় সড়কে ট্রাকের বহর, শত শত ট্রাক। কাপড়ের বিশাল গাঁট উঠছে, নামছে। লোড নিয়ে ছুটে চলেছে দূর-অদূর গন্তব্যে। সেই ১৭১৭ সাল থেকে আজ অব্দি ব্যবসায়ের কৌলিণ্য এই হাটকে ইতোমধ্যে ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ পরিচিতি দিয়েছে ‘উইকিপিডিয়া’র পাতায়। সন্নিহিত তল্লাটের তাঁতকল থেকে তৈরি হয়ে কাপড় আসছে আর বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে আর কোন দৃশ্য নেই। একসময় কেবল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও চাদরের জন্য যে বাবুরহাটের সুখ্যাতি ছিল তার বর্ণাঢ্য এখন প্রশস্ত হয়েছে। বর্তমানে এই হাটটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তাঁতবস্ত্র বিপণন কেন্দ্র্র। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ দেশের সব প্রান্তের পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর বাবুরহাট। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীদের কোন টোল জমা, খাজনা বা চাঁদা দিতে হয় না। এখানকার ঘর মালিক সমিতির সদস্যরা সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব সরকারী কোষাগারে জমা দেন। টোল-খাজনা প্রথা না থাকায় বাবুরহাটই ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ। এছাড়া এক হাটে সব ধরনের কাপড় পাওয়া যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল। বাবুরহাটকে কেন্দ্র করে নরসিংদী ও তার সন্নিহিত নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার তাঁতকল। তাঁতশিল্পকে ঘিরে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে শতাধিক সহায়ক শিল্প প্রতিষ্ঠান। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে লাখ লাখ বেকার মানুষের।
×