ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গনে ‘নতুন ব্র্যান্ড’

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৪ নভেম্বর ২০১৮

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গনে ‘নতুন ব্র্যান্ড’

ড. মীজানুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে। তাঁর দায়িত্ব পালনকালেই মূলত পুরনো কলেজের কালচার ছেড়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ড. মীজানুর রহমান তাঁর মেধা ও দক্ষতায় ইতোমধ্যে ছাত্র-শিক্ষকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে। ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: অদম্য তের বছর’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে সম্প্রতি ১৪ বছরে পদার্পণ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। এ উপলক্ষে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- রাহুল শর্মা ক্যাম্পাস: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ বছরে পা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী? ড. মীজানুর রহমান : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রেই এই বিদ্যাপীঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা করা হয়, তখন অবকাঠামো বা অন্যান্য বিষয় চিন্তা না করেই মূলত তা করা হয়। তৎকালীন কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা এখানে ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। কলেজের শিক্ষকরা চলে যাওয়ার পরই মূলত ২০১১ সালেই নতুন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। সেই অর্থে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কিন্তু ১৪ বছর নয়। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মেধাবী শিক্ষক, শিক্ষার মান ইত্যাদি কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকদের দ্বিতীয় আকর্ষণে পরিণত হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কলেজের যে কালচার ছিল তা পরিবর্তন করতে পেরেছি। কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মূল পার্থক্য হলোÑ কলেজ কেবল জ্ঞান বিতরণ করে আর বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান আহরণ এবং বিতরণ দুটোই করে। এখানে গবেষণায় ব্যাপক জোর দেয়া হচ্ছে। এখানকার বহু শিক্ষার্থী এবং প্রায় সকল শিক্ষক কোন না কোনভাবে গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একাডেমিক দিক থেকেও গত কয়েক বছরে বিসিএস, জুডিশিয়াল সার্ভিস, ব্যাংক রিক্রুটমেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনেক ভাল। বর্তমানে চাকরির বাজারে তাদের অবস্থান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সবাই অনাবাসিক। এখানে রয়েছে ক্লাসরুম ও ল্যাবরেটরির স্বল্পতা, গবেষণাগার ও বইয়ের সঙ্কট। কারণ, এটা আগে ছিল কলেজ। পরে এটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও কোন রকমের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়নি। গত ৪/৫ বছরের মধ্যে ছাত্রীদের জন্য ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ তৈরি এবং কয়েকটি ভবনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে পেরেছি। এতে ছাত্রীদের আবাসন সঙ্কটের খানিকটা সমাধান হবে এবং ক্লাসরুমের সঙ্কটও তুলনামূলকভাবে কমবে। ক্যাম্পাস: উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনি কোন্ বিষয়গুলোতে সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন? ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য হওয়ার পরেই আমার বক্তব্য ছিল, তাড়াহুড়ো করে সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ারও সুযোগ নেই। আমি প্রথমেই লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলাম শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি করাকে। যা ইতোমধ্যে করতে পেরেছি। নতুন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে এর কোন কোনটায় ভাইস-চ্যান্সেলর ছাড়া আর কোন অধ্যাপক নেই। আবার কোন কোনটিতে দুই/তিন জন অধ্যাপক আছে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে ১০০ জন অধ্যাপক রয়েছে। এদের মধ্যে ৯৮ জনের পিএইচডি ডিগ্রি আছে। বর্তমানে ১৫০ জন শিক্ষক আছেন যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষারত। এই শিক্ষকরা যখন ফিরে আসবেন তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি জ্ঞানভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হবে। আমার ভাললাগাটা এখানেই যে, আমি দেশের মেধাবী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের এখানে আকর্ষণ করতে পেরেছি। মানুষ একসময় মনে করত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো জগন্নাথ কলেজই। গত ছয় বছরের চেষ্টায় সেই ধারণাটা ভাঙ্গতে সক্ষম হয়েছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষাঙ্গনে ‘নতুন ব্র্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এছাড়াও গত কয়েক বছরে বেশ কিছু যুগপোযোগী নতুন বিভাগ চালু করি, যেমন- চারুকলা বিভাগ, নাটকলা বিভাগ, সংগীত বিভাগ, লোক প্রশাসন বিভাগ, ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। এছাড়াও শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। ক্যাম্পাস: স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিতে এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিল করে বর্ণনামূলক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে বলুন? ড. মীজানুর রহমান : বাংলাদেশের সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আমরাই প্রথম লিখিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছি। এ পরীক্ষা সম্পূর্ণ বর্ণনামূলক। প্রযুুক্তির সুবিধা নিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রেও নানা অসুদোপায় অবলম্বনে ঘটনা ঘটছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস টেস্ট থেকে শুরু করে সকল পরীক্ষাই এখন থেকে আর এমসিকিউ পদ্ধতিতে হচ্ছে না। ক্যাম্পাস: আপনি দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন? ড. মীজানুর রহমান : এখানে বড় সঙ্কট ছিল শিক্ষক স্বল্পতা। দায়িত্ব গ্রহণের পর ছাত্র-শিক্ষকের যে অনুপাত আগে ছিল তা অনেক কমিয়ে এনেছি। এখানে তীব্র পরিবহন সঙ্কট ছিল। ইতোমধ্যে ২০টি নতুন বাস পরিবহন পুলে সংযোজন করা হয়েছে আরও ৪টি বাস এই মাসেই যোগ হবে। এছাড়াও এখানে সেশনজটও এখন জিরো পর্যায়ে। কোন কোন বিভাগে চার বছরের কোর্স তিন বছর আট মাসেই শেষ হচ্ছে। ক্যাম্পাস: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন সম্পর্কে কিছু বলুন? ড. মীজানুর রহমান : গত অক্টোবর মাসে কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটির ১১৭তম সভায় ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার তেঘরিয়া ইউনিয়ের পশ্চিমতি মৌজায় প্রায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। এছাড়া গত ৯ অক্টোবর একনেক সভায় ভূমি অধিগ্রহণ এবং উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উক্ত প্রকল্প অনুমোদন করেন। যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষাখাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এত জায়গা ও টাকা স্বাধীনতা উত্তরকালে কোন সরকার বরাদ্দ দেয়নি। এই প্রকল্পটা হলো অন্তর্বর্তীকালীন প্রকল্প। এটা আসলে মূল প্রকল্প তৈরি করার জন্য একটি প্রকল্প। ক্যাম্পাস : আপনার সাফল্য তো জানলাম, এবার অপূর্ণতা সম্পর্কে জানতে চাই? ড. মীজানুর রহমান : এখানে ভাল ক্যান্টিন নেই, আবাসন ব্যবস্থা নেই, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই নেই- এগুলো উপাচার্য হিসেবে আমাকে খুব পীড়া দেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জায়গাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কাগজপত্রে নেই, শুধু দখলে আছে। এখন আমরা সরকারের কাছ থেকে ২০০ একর জায়গা নামে বরাদ্দ পেয়েছি। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি জমির মালিক হলো। এই কাজটুকু অন্তত করে দিয়ে গেলাম। ফলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পেল তার আপন ঠিকানা। এটাই আমার তৃপ্তি। ক্যাম্পাস : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আপনার আগামীর ভাবনা? ড. মীজানুর রহমান : ১০ বছর পর এই প্রতিষ্ঠানটি একটি পূর্ণাঙ্গ ও আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এমনটাই প্রত্যাশা আমার।
×