ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দস্যুমুক্ত সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৪ নভেম্বর ২০১৮

দস্যুমুক্ত সুন্দরবন

সুন্দরবনের বিপদ ছিল জলদস্যু এবং আপদ ছিল বনদস্যু। এই উভয়বিধ দস্যুদের হিংস্রতা নিয়ে বহু কাহিনী চালু আছে। একদিন সব ধরনের দস্যুতার অবসান ঘটবে- এমনটা প্রত্যাশা থাকলেও সত্যি সত্যি তা বাস্তবরূপ নেবে- এ যেন ছিল মহাবিস্ময় এবং প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। সুদীর্ঘকাল যাবত সুন্দরবন কেন্দ্রিক ছয়টি দস্যুবাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে ও বনজীবী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রতিবছর জলদস্যু বাহিনীর শীর্ষ নেতাসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য নিহত হলেও এসব বাহিনীকে পুরোপুরি নিবৃত্ত করা যাচ্ছিল না। বর্তমান সরকার দক্ষতার সঙ্গে সুপরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সুন্দরবনে বিশেষ মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার বাওয়ালি নৌকা নিয়ে গোলপাতা সংগ্রহ করেন। এ জন্য দস্যু দলকে নৌকাপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা দিয়ে আগাম টোকেন সংগ্রহ করে বনে প্রবেশ করতে হতো। মৌয়ালদের কাছ থেকেও একই হারে চাঁদা নেয়া হতো। এসবই এখন অতীত। সর্বশেষ ছয়টি বাহিনীর ৫৪ বনদস্যু ৫৮ আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রায় সাড়ে তিন হাজার গুলি জমা দিয়ে বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সুন্দরবন দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করেন। বর্তমান সরকারের একটি বিশেষ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে দস্যুমুক্ত কার্যক্রম। প্রায় ১০ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বিশ্বের একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করায় বনজীবী, জেলে-বাওয়ালী, ট্রলার মালিক, আড়তদারসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। আত্মসমর্পণকারী বনদস্যু ও তাদের পরিবারবর্গ স্বস্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, এখন জেলে-বাওয়ালিরা শঙ্কাহীন চিত্তে সুন্দরবনে যেতে পারবেন। মৎস্যজীবীরা নিরাপদে সমুদ্রে ইলিশ আহরণ করবেন। পাশাপাশি বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষা পাবে। সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অত্যন্ত বাস্তবমুখী ও জনকল্যাণমূলক। তিনি বলেন, ‘বনদস্যুরা এখন আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। তারা অস্বাভাবিক জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। তাদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি এখন সরকার দেখছে। আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া তারা যে কাজ করতে আগ্রহী তাদের সেসব কাজে সহায়তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। র‌্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনও তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে সার্বিক সহায়তা করবে।’ প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের মধ্যে, যাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়া যেসব মামলা রয়েছে, সেসব মামলা আইনী পদ্ধতিতে প্রত্যাহার করতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। এছাড়াও আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের মধ্যে যাদের ঘর নেই তাদের ঘর এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জন্য প্রত্যেক দস্যুকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ এক লাখ টাকা, র‌্যাবের পক্ষ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকাসহ শীতবস্ত্র ও একটি করে মোবাইল সেট দেয়া হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ হত্যা কিংবা অস্ত্রের মুখে সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। এমন একটি ঘৃণিত ও ভয়ঙ্কর পেশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজে সফলতা পাওয়া সহজ ছিল না। আগামীতে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও নিয়মিত করতে হবে যাতে করে আর একজন ব্যক্তিও দস্যুতার মতো হিংস্র পেশায় যোগ দিতে না পারে। তবে এটাও বলা দরকার যে, সমাজে মানুষের আয়-বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব বিদ্যমান থাকলে নতুন দস্যুদলের আবির্ভাবের আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই সর্বতোভাবে মানবকল্যাণকামী সমাজই আমাদের কাম্য।
×