ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংশ্লিষ্ট কেউ মাদক বিক্রি, সেবন বা বহন করলেই ব্যবস্থা

জেলে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অধিদফতরের

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩ নভেম্বর ২০১৮

 জেলে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অধিদফতরের

মশিউর রহমান খান ॥ কারাগারে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করছে কারা অধিদফতর। দেশের সব কারাগারের কর্মকর্তা কর্মচারী ও বন্দীসহ কারা সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তি মাদক বিক্রি, সেবন বা বহন করলে সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে কারাবিধি ও জেলকোড অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করছে। একই সঙ্গে মাদকের জড়িত কোন কর্মকর্তা কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে তদন্তসাপেক্ষে তা প্রমাণিত হলে তাদেরও কোন ছাড় দেয়া হবে না। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি প্রচলিত আইনেও নিয়মিত মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। সম্প্রতি কারা অধিদফতর থেকে দেশের সব কারাগারের জেল সুপার ও জেলারদের বিষয়টির প্রতি সর্বোচ্চ নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন। কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কারাগারের মাদক ঢোকার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন কারারক্ষী থেকে শুরু করে হাবিলদার, সুবেদার সার্জেন্ট, ডেপুটি জেলার, জেলার এমনকি জেল সুপারসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের নতুন করে বিশেষ নজরদারি করছে কারা অধিদফতর। এজন্য কারা গোয়েন্দাসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য যাচাইপূর্বক তাদের নিয়মিত কর্মকা-ের ওপর বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে মাদকের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চললেও বর্তমানে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। কারা সূত্র জানায়, মাদকের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন কারও তথ্য প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্ত করা, হাতেনাতে ধরতে পারলে পুলিশে ধরিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে মাদক ব্যবসা, সেবন বা পরিবহনসহ মাদক মামলার আসামিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার সঙ্গে জড়িত যে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কারাভ্যন্তরে কোন কর্মচারী-কর্মকর্তা কোন ধরনের মাদক সেবন, বহন বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে কি না তার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কারা গোয়েন্দা কতৃক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর তালিকা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সর্বোচ্চ মহলে সুপারিশ করা হবে। কারাসূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশে ১৩ কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫ জেলা কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারে প্রায় ৯০ হাজারের বেশি বন্দী আটক রয়েছেন। বর্তমানে এসব কারাগারে প্রায় ৫৫ হাজারের বেশি বন্দী শুধু মাদক মামলায় আটক রয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। যাদের বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় কারাগার ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন। কারাসূত্র মতে, আটকের পর নেশাগ্রস্ত প্রায় সব বন্দীই মাদক সেবনের জন্য প্রতিদিনই কারাগারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উপায়ে মাদক ঢোকানোর চেষ্টা করে। বর্তমানে কারাগারে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তবে বেশ কিছু বন্দী গাঁজা সেবনেও আগ্রহী। আবার রাজশাহী এলাকার কারাগারগুলোয় মাদকাসক্ত বন্দীরা গোপনে হেরোইন গ্রহণ করে। বর্তমানে কারাগারে বন্দীর বিরুদ্ধে মাদকাসক্ত বা মাদক বহনে যুক্তসহ মাদক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেল সুপারের নির্দেশে বন্দীদের ডা-াবেড়ি, আরওয়া বেড়ি পরানো, ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে সেলবাস দেয়া হয়। এছাড়া স্ট্যান্ডিং হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেয়া, সশ্রম দ-ভোগের মাধ্যমে কাজের পদাবনতি দেয়াসহ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষ কোন কোন আসামিকে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারেও স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়। কারাসূত্র জানায়, স্বাভাবিক পন্থায় কারাগারে মাদক ঢোকানো অনেক কঠিন বা অসম্ভব। মাদক সেবনকারী বা বহনকারী জুতার ভেতর থেকে শুরু করে পলিথিনে ভরে ইয়াবা খেয়ে পেটের ভেতর করে আনা, গোপনাঙ্গের ভেতরে ইয়াবা আনা, শার্ট ও লুঙ্গির ভেতর সেলাই করে বা লুঙ্গিতে গোপন পকেট তৈরি করে, বাইরে থেকে খাবার আনার সময় টিফিনবক্সের ভেতরে করে কারাভ্যন্তরে মাদক সরবরাহের চেষ্টা করতে দেখা গেছে। এছাড়া বন্দীকে দেয়া শুকনো খাবারের সঙ্গেও কারাগারে মাদক পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালত ফেরত আসামিরাই কারাগারে মাদক ঢোকানোর চেষ্টা করে বেশি। আর এতে সাহায্য করে এক শ্রেণীর অসাধু কারা কর্মকর্তা কর্মচারী। কারা অধিদফতর কারাগারে মাদক প্রবেশ কঠোর হস্তে রোধ করতে কারাগারে স্থাপিত বডি স্ক্যানার বা আর্চওয়ে গেট দিয়ে বন্দীদের তল্লাশি করতে বলা হয়েছে। এছাড়া হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সব ব্যাগ পরীক্ষা ছাড়াও সন্দেহজনক সব বন্দীকে বিশেষ পদ্ধতিতে, প্রয়োজনে একাধিকবার পরীক্ষারও নির্দেশ দিয়েছে কারা অধিদফতর। এর বাইরে কারাগারে শিফটিং বদলের সময় সব কর্মচারীর বডি পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক। মূলত কারাগারে মাদক প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করতেই এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় সব কারাগারেই কমবেশি মাদক মামলার আসামি আটক থাকলেও এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী, যশোর, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, বরিশালসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় কারাগারে। মাদকাসক্ত এসব বন্দী কারাভ্যন্তরে মাদক হাতে পেতে এমন কোন চেষ্টা নেই, যা করেন না। সময় মতো মাদক সেবনের জন্য মোটা অংকের অর্থ প্রদান করতে তারা নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সঙ্গে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে মাদক হাতে পেতে চুক্তি পর্যন্ত করেন। এর ফলে নিরাপত্তারক্ষীরা বিভিন্ন কৌশলে কারাগারে মাদক প্রবেশে সহায়তা করতে দেখা যায়। গত কয়েক বছরে কারাভ্যন্তরে মাদক প্রবেশের চেষ্টাকালে কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে ও নিজে মাদক সেবন করেন এমন প্রায় শতাধিক কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের থেকে শুরু করে পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বন্ধ, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের পর চাকরি থেকে চূড়ান্ত বরখাস্তও করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে মাদক মামলায় কারা অধিদফতর থেকে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়া হলেও অনেক সময় মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অজ্ঞাত কারণে বা বিশেষ ক্ষমতাবলে এসব আসামিরা পুনরায় চাকরি বহাল হতে দেখা যায়। তবে কারা কর্তৃপক্ষ ঘোষিত বর্তমান জিরো টলারেন্স নীতি অনুযায়ী মাদক সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত কোন আসামি যাতে কোনক্রমেই ছাড় না পায় কারা মহাপরিদর্শক তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, কারাগারের ভেতরে মাদক যেন কিছুতেই ঢুকতে না পারে তার জন্য আমরা কারাগারের দায়িত্বরতদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছি। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই জিরো টলারেন্স রয়েছে আমাদের, যা আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ। দেশের সব কারাগারের যে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারী ও বন্দীসহ কারা সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তি মাদক বিক্রি, সেবন বা বহন করলে আমরা তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কারাবিধি ও জেলকোড অনুযায়ী শাস্তি দিয়েছি। একইসঙ্গে মাদকের সঙ্গে জড়িত হয়ে যে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে ও তদন্ত সাপেক্ষে তা প্রমাণিত হলে তাদেরও কোন প্রকার ছাড় দেয়া হচ্ছে না। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি প্রচলিত আইনেও নিয়মিত মামলা দায়ের করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৬৮ কারাগারে ৫০ হাজারের বেশি বন্দী মাদক সংশ্লিষ্ট মামলায় আটক রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবেন কারাগারে বসেই মাদক সেবন করতে। আদালত থেকে আসা নতুন ও পুরনো বন্দীরা এমনকি তাদের আত্মীয়রাও বিভিন্ন সময়ে নানা উপায়ে বন্দীকে দিয়ে কারাভ্যন্তরে মাদক ঢোকানোর চেষ্টা করে। এছাড়া কারাভ্যন্তরে কিছুসংখ্যক দুষ্টু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্দীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মাদক প্রবেশের কাজ করে। আমরা তাদের হাতেনাতে ধরার পর তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। এছাড়া কারাগারের ভেতর মাদক ঢোকানোর চেষ্টার দায়ে বন্দীর স্বজনসহ অনেককে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। এছাড়া মাদকের সঙ্গে যে কোন শ্রেণীর কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত আছে কি না তা দেখতে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
×