ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যমুনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাস্টার সার্ভিস

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩ নভেম্বর ২০১৮

 যমুনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মাস্টার সার্ভিস

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে গাবসারা ইউনিয়নের পুরোটা, অর্জুনা ইউনিয়নের অর্ধেক, গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের চার ভাগের এক ভাগ যমুনা নদীর চরে। শুকনা মৌসুমে কোথাও কোথাও পায়ে হেঁটে যাওয়া গেলেও বর্ষা মৌসুমে নৌকাই একমাত্র ভরসা। এ সময় চরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ছোট-বড় একশর বেশি নৌকা চলে। সবগুলোই গোবিন্দাসী ঘাট থেকে যাতায়াত করে। আর এ ঘাট থেকেই চলে ‘মাস্টার সার্ভিস’। নৌকায় যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের স্কুলগুলোর শিক্ষকদের আনা- নেয়ার জন্য বাহনের নাম ‘মাস্টার সার্ভিস’। আত্মীয়ের বাড়ি নিকরাইল যাব। সকাল সাড়ে ৭টায় ঘাটে হাজির হয়েছিলাম। দোকানিরা চায়ের পাতিল চুলায় বসিয়েছেন। ঘাটে ৫০টির বেশি নৌকা বাঁধা ছিল। চরে কোন নৌকা যাবে জানতে চাইলে দোকানি আক্কাছ আলী বললেন, ‘৯টার আগে নৌকা ছাড়বে না। তবে স্কুল মাস্টারদের জন্য একটা নৌকা ছাড়বে ৮টায়। ওইটা ওই কালা সড়কের পাশ থেকে।’ কালা সড়ক হলো যমুনার ভাঙন প্রতিরোধক বাঁধ। যেতে যেতে আরেকজনকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখলাম। নাম জানলাম, আব্দুল খালেক। বাসুদেবকোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মাস্টার সার্ভিসের নিয়মিত যাত্রী। সিঁড়ি থাকায় নৌকায় উঠতে কাদা মাড়াতে হয় না শিক্ষকদের। জুতা রাখার আলাদা জায়গাও আছে নৌকায়। সকাল ৮টা বাজতেই চালক ইঞ্জিন চালু করল। চালকের নাম জহুরুল। সবাই তাকে পাইলট বলে ডাকে। সব মিলিয়ে ৪০-৪৫ জন শিক্ষক উঠেছেন নৌকায়। নৌকা যাত্রা করল উত্তর-পশ্চিম দিকে। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে স্কুলে উপস্থিত থাকতে হয়। অথচ ৯টার আগে নৌকা ছাড়ে না গোবিন্দাসী থেকে। আবার ৪টার পর স্কুল থেকে ফেরার সময়ও নৌকা পাওয়া যেত না। তাই শুধু শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য আমরা তিন-চারজন শিক্ষক উদ্যোগ নিয়ে ৩২ হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরনো নৌকা কিনি। বিগত ২০০৭ সালের ঘটনা। প্রথম প্রথম ১৩ জন শিক্ষক যাতায়াত করতাম। পিন্টু মিঞা নামে স্থানীয় একজন ছিলেন নৌকার চালক। অল্পদিনের মধ্যেই নৌকাটি জনপ্রিয় হলো। লোকমুখে নামটিও ছড়িয়ে পড়ল মাস্টার সার্ভিস। বাসুদেবকোল, চর বিহারি ও গোবিন্দপুর বাজার এ তিনটি ঘাটে শিক্ষকরা নামেন। এই তিনটি স্থান থেকে শিক্ষকরা হেঁটে বা অন্য নৌকায় করে নিজ নিজ স্কুলে যান। এক বছর যাওয়ার পরই নৌকাটি পুরনো হয়ে যাওয়ায় বাতিল করতে হয়। এরপর সুলতান মিঞা নামে একজন তাঁর নিজের নৌকা দিয়ে সার্ভিসটি কিছুদিন চালু রাখেন। তারপর ২০০৯ সাল থেকে হাসান ও জহুরুল দুই ভাই তাঁদের নৌকা দিয়ে মাস্টার সার্ভিস নতুন করে পুরোদমে চালু করেন। বলছিলেন, ভদ্র শিমুল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এস এম লিংকন রায়হান। আরও জানলাম, সার্ভিসটি চালু রাখার জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি আছে। প্রতিবছর নতুন কমিটি হয়। কমিটির এখনকার সাধারণ সম্পাদক ও গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ মোল্লা জানালেন, চরাঞ্চলের প্রায় ২০টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি উচ্চ বিদ্যালয় ও পাঁচটি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষকরা এতে নিয়মিত যাতায়াত করেন। পরিচালনা কমিটির সভাপতি আছাতুন্নেছা দাখিল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদ ম-ল বললেন, মাস্টার সার্ভিসে যাতায়াতের জন্য ৬০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যেই সদস্যরা আমার কাছে টাকা দিয়ে দেন, আমি তা চালককে দিই। শুশুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ফাহিমা আক্তার বললেন, সার্ভিসটি হয়ে আমাদের বেশ উপকার হয়েছে। আমরা নিশ্চিন্তে কর্মস্থলে যেতে পারছি। মাস্টার সার্ভিসের চালক জহুরুল মিঞা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন, স্যারেরা জ্ঞানী ও সম্মানী লোক। নৌকা দিয়ে তাদের আনা-নেওয়া করতে ভাল লাগে। শুধু রোজগারের জন্য নয়, ভাল মানুষের সেবা করতে পারছি, এটাও বড় কথা। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও উন্নয়ন) আশরাফুল মমিন খান বলেন, নৌকার বিষয়ে সরকারীভাবে কোন বরাদ্দ নেই। স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন তহবিল থেকে নৌকার ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। তবে অন্যদের ভাতা থাকলেও চরাঞ্চলে চাকরিরতদের জন্য কোন সরকারী ভাতা নেই বলে জানালেন জেলা প্রশাসন। -ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে
×