ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভুলে ভরা ইংলিশ ভার্সনের পাঠ্যবই

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩ নভেম্বর ২০১৮

 ভুলে ভরা ইংলিশ ভার্সনের পাঠ্যবই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে তৈরি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর দুটি বিষয়ের নাম ‘রসায়ন’ ও ‘জীববিজ্ঞান’। বাংলা মাধ্যমে এই নাম হলেও এটির ইংলিশ ভার্সন বইয়ের নাম ‘কেমিস্ট্রি’ ও ‘বায়োলজি’। বাংলা মাধ্যমে দুটি বইয়েরই প্রথম অধ্যায় বিস্তৃত অন্তত ৭ পৃষ্ঠাজুড়ে। আছে প্রয়োজনীয় অসংখ্য ছবিও। অথচ ইংলিশ ভার্সনে এই অধ্যায় শেষ করা হয়েছে মাত্র এক পৃষ্ঠায় ‘নামকাওয়াস্তে’। যেখানে নেই বাংলা মাধ্যমের মূল পাঠ্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ কোন অংশই। অথচ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় বাংলা মাধ্যম বই থেকেই। ফলে প্রতিটি পরীক্ষায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। এবার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায় থেকে প্রশ্ন এসেছে। এতে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শতভাগ পাস করলেও ফল বিপর্যয় ঘটছে ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ই মারাত্মক ভুল অনুবাদ ও চরম অসঙ্গতিপূর্ণ পাঠ্যবইয়ের জন্য চরম মাসুল দিতে হচ্ছে ইংলিশ ভার্সনের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। যাদের প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রতেও ধরা পড়ছে অসংখ্য ভুল। গত এক বছরেই এমন ভুলের ঘটনা ঘটেছে বহুপরীক্ষায়। তবে এ সঙ্কট কেবল এক স্তরেই নয়। একদিকে নেই ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষক অন্যদিকে এমন ভুলে ভরা পাঠ্যবইয়ে সঙ্কটের মুখে পড়েছে প্রথম থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ইংলিশ ভার্সনের প্রতিটি শিক্ষার্থী। সকল শ্রেণীর ইংলিশ ভার্সনের বই ছেয়ে গেছে ভুল ও অনুবাদের অসঙ্গতিতে। বইয়ের পরতে পরতে ভুল আর ভুল। প্রায় প্রতিটি বইয়েই এমন কোন অধ্যায়ে খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে বাংলা মাধ্যমের বিষয়গুলোর হুবহু ইংলিশ ভার্সন করা হয়েছে। অথচ ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভার্সনের বই নির্ভুল ও হুবহু অনুবাদ করার কথা। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের বইয়ের পাঠ্যক্রমের ভয়াবহ তফাৎ, ইংলিশ ভার্সন বইয়ের অনুবাদের ঘাপলা, ভুল আর নানা অসঙ্গতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ভার্সনের বই নির্ভুল ও হুবহু অনুবাদ করার নিয়ম। সেভাবেই হচ্ছে বলে দাবিও করে আসছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু বাস্তবে ইংরেজী ভার্সনের বইয়ে প্রচুর ভুল থাকছে। অনুবাদেও থাকছে ত্রুটি। আবার কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুবাদই হচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। সরকারী বিধান বলছে, পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বাংলা ভার্সনের বই থেকেই করা হয়। পরে বাংলা ভার্সনের প্রশ্নপত্র অনুবাদ করা হয় ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু প্রথম শ্রেণী থেকে এইচএসসি এমনকি বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও দেখা গেছে, বাংলা ভার্সনের বইয়ে আছে অথচ ইংরেজী ভার্সনের বইয়ে নেই এমন অনেক অংশ থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন হচ্ছে। ফলে ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীরা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না। গত এক বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এমন অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যা বাংলা ভার্সনে থাকলেও ইংরেজী ভার্সনের বইয়ে নেই। আবার ইংরেজী ভার্সনের কোন কোন পরীক্ষায় প্রায় অর্ধশতাধিক ভুলেরও নজির আছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে দেশের একটি নামী কলেজে ইংরেজী ভার্সনে ভর্তি হয়েছে গিলবার্ট পিটার হালদার। ইংরেজী মাধ্যমের বইয়ের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি পিটার তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, রাজধানীর একটি স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের ইংরেজী ভার্সনের ছাত্র হিসেবে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজী মাধ্যমের পাশাপাশি যে ‘ইংরেজী ভার্সন’ নামক আরেকটি মাধ্যম রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা নয়। কিন্তু এ মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অবহেলার সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। ইংরেজী ভার্সনের বই থেকে শুরু করে এসএসসির প্রশ্নপত্রে প্রতিটি স্তরেই অবহেলার শিকার হচ্ছি আমরা। অথচ বাংলা মাধ্যমের বইগুলোর সম্পূর্ণ ইংরেজী সংস্করণ হলো ইংলিশ ভার্সনের বই। প্রাথমিক থেকে প্রতিটি শ্রেণীতে কোন না কোন বই আছে যা বাংলা মাধ্যমের বই থেকে ভিন্ন। বাংলা মাধ্যমের বিশাল বিশাল চ্যাপ্টার ইংরেজী ভার্সনের অনেক বইয়ে শেষ করা হয়েছে কয়েকটি লাইনের মধ্যেই। কিন্তু পরীক্ষায় গিয়ে দেখছি প্রশ্ন এসেছে বাংলা মাধ্যমের বই থেকে। এই শিক্ষার্থী বলছে, অবহেলার শিকড় ছড়িয়েছে পাবলিক পরীক্ষাতেও। কিন্তু প্রশ্নপত্রের ভুলের জন্য কি আমরা ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা ‘অটো নম্বর’ টাই? পাই না। অবহেলা তুলে ধরতে গণমাধ্যমও তেমন ভূমিকা রাখছে না। ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষার্থী নয়? অবহেলার শিকার কেবল এই ছাত্রই নয়। এ বছর দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান নটরডেম কলেজ থেকে সর্বোচ্চ মেধার পরিচয় দিয়ে জিপিএ-৫ নিয়ে ইংরেজী ভার্সসের অসংখ্য শিক্ষার্থী বের হলেও বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অধিকাংশই ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ঠিকই ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্য পাচ্ছে। জানা গেছে, কেবল নটরডেম নয়, একই অবস্থা রাজউক উত্তরা মডেল, মতিঝিল আইডিয়াল, রেসিডেন্সিয়াল মডেল, ভিকারুন নিসা নূন, ঢাকা কলেজসহ ইংলিশ ভার্সন থাকা প্রতিটি কলেজের ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অথচ ভাল করেছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা। বাংলা মাধ্যমের বই পড়ে পরীক্ষায় সাফল্য পেলেও কেবল বইয়ের ভুলের কারণে ব্যর্থ হয়েছে ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই বলছে, পরীক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে যেসব প্রশ্ন এসেছে তার অধিকাংশই তাদের অধ্যায়ে নেই। অথচ একই অধ্যায়ে বাংলা মাধ্যমের বইয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর আছে ঠিকভাবেই। এক্ষেত্রে এনসিটিবির অনুনোদন ছাড়া বাজারে অসংখ্য ভুলে ভরা বই থাকাকেও দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা। নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের বাংলা মাধ্যমের রসায়ন প্রথমপত্র বইয়ের প্রথম অধ্যায় বিস্তৃত অন্তত ৬ থেকে ৭ পৃষ্ঠাজুড়ে। শিক্ষার্থীদের জন্য আছে বিষয়োপযোগী ছবিও। এনসিটিবির অনুমোদন নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসারে বাংলা মাধ্যমের একটি রসায়ন বই প্রকাশ করেছে লেকচার পাবলিকেশনস। বইয়ের লেখক সঞ্জিত কুমার গুহ। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটিতেই ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীরা যে কেমিস্ট্রি বই পড়ছে তার প্রকাশক এ্যাবাকাস পাবলিকেশন। বইয়ের লেখক ড. মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম ও ড. গাজী মোঃ আহসানুল কবীর। নিয়মানুসারে বাংলা মাধ্যমের বইয়ের কেবল অনুবাদ করার কথা থাকলেও বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ এ অধ্যায় ইংলিশ ভার্সনের এ বইতে শেষ করা হয়েছে এক পৃষ্ঠায়! যেখানে নেই বাংলা মাধ্যমের বইয়ের ৫ ভাগও। কোনমতে ‘নামকাওয়াস্তে’ শেষ করা হয়েছে বইটি। এ বই পড়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এসে ভাল করতে পারেনি ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। তারা প্রায় প্রত্যেকেই একই সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেছেন, বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন এলেও তা তাদের কাছে পুরোপুুরি অপরিচিত লেগেছে। কখনোই বইয়ে এসব বিষয় তারা পাননি। কিন্তু বাংলা মাধ্যমের বন্ধুরা বলেছে এগুলো হুবহু তাদের বইতে আছে। ফলে তারা পরীক্ষায় ভাল করলেও আমরা ফেল করেছি। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে পাস করেও আশানুরূপ কোন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি অনেকেই। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী রাজিব হাসান অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলছিলেন, ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা নিম্নমানের অনুবাদে বই দিয়ে পতে বাধ্য হচ্ছে বছরের পর বছর। তাড়াহুড়ো করায় প্রতিবছরই পাঠ্যবইয়ের ইংরেজী ভার্সনে ভুল থাকে। অসংখ্য বানান ভুল এবং বাক্যগঠনে অসঙ্গতিও আছে এসব বইয়ে। আবার কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুবাদই হয় না। ইংরেজী ভার্সনের বই নির্ভুল ও হুবহু অনুবাদ করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যালোচনা করেও পাওয়া গেছে নানা অসঙ্গতি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপে এনসিটিবি নিজেই। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা মাধ্যমের শিশুদের জন্য বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের সঙ্গে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে ইংলিশ ভার্সনের বইয়ের। ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ নামের অধ্যায়ে বাংলা মাধ্যমের বইয়ে যে তথ্য দেয়া আছে তার হদিস মিলছে না ইংলিশ ভার্সনের বইয়ে। বাংলা মাধ্যমের বইয়ের লেখার হবহু অনুবাদ করার কথা থাকলেও ইংলিশ ভার্সনের শিশুদের বইয়ে পুরোপুুরি বাদ দেয়া হয়েছে অধ্যায়ের অনেক তথ্যই। ঘটেছে তথ্য বিকৃতিও। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক বাংলা মাধ্যমের বইয়ে মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে সম্প্রতি ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের ইংলিশ ভার্সনের শিশুরা বলে বসে, ‘স্যার আমাদের বইয়ে যে এ বিষয় নেই’। পরে উপায় না দেখে শিক্ষক ইংলিশ ভার্সনের প্রত্যেক শিশুর বইয়েও পাতায় পাতায় হাতে লিখে দেন সঠিক তথ্যগুলো। কিন্তু এমন হাতে লিখে দেয়ার মতো অবস্থাইবা দেশের কতটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে- সেই প্রশ্ন শিশুদের অভিভাবক ও বিজ্ঞানদের। নবম দশম শ্রেণীর জীববিজ্ঞান। এটির ইংরেজী ভার্সন বই বায়োলজি। জীববিজ্ঞানের ‘গ্যাসীয় বিনিময়’ অধ্যায়ের শ্বসনতন্ত্রের অংশে গলবিলের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এখানে তিনটি পৃথক বাক্য রয়েছে। তৃতীয় বাক্যটিতে আলাজিহ্বা’র পরিচয় দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইংরেজী ভার্সনের বইয়ে তৃতীয় বাকে। অথচ এবারের এসএসসির প্রশ্নটি এসেছে তৃতীয় বাক্যটির ‘আলাজিহ্বা’ নিয়েই। ফলে ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা এর উত্তর দিতে পারেনি। একই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের শেষ দিকে মৎস্য উন্নয়ন বিষয়ে বলা হয়েছে ‘মাগুর, কমন কার্প, লইট্টা এবং তেলাপিয়া মাছে স্যামন মাছের বৃদ্ধি হরমোনের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে কৌশলগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এসব মাছের আকার প্রায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই অংশটি ইংরেজী ভার্সনের বইয়ের জন্য অনুবাদ করা হয়নি। তবে এবারের এসএসসির নৈর্ব্যক্তিক অংশের প্রশ্ন এই বাক্যটি থেকেই এসেছে। ফলে উত্তর লিখতে পারেনি পরীক্ষার্থীরা। এছাড়া এই বইয়ে ‘পরিবেশ সুরক্ষার’ ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে ‘ইন ইমপ্রুভমেন্ট অব ফিশিং’। বইটিতে বাংলা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন রজত কান্তি সোম, গুল আনার আহমেদ এবং কাজী নেয়ামুল হক। এর মধ্যে গুল আনার আহমেদ বাংলা ভার্সনের বইটিরও লেখক। এছাড়া রসায়নের ‘ক’ সেটের বাংলা ৬ নম্বর প্রশ্নের অনুবাদ ভুল হয়েছে। গত বছরও জেএসসির সৃজনশীল এ প্রশ্নপত্রের বহু নির্বাচনী (মাল্টিপল চয়েজ) অংশের প্রশ্নে একাধিক ভুল ধরা পড়ে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ইংরেজী ভার্সনের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সাহানা আফরোজ বলেিছলেন, ইংরেজী ভার্সন পাঠ্যবইয়ে ভুলের কথা এখন সর্বজনবিদিত। নিম্নমানের অনুবাদ, তাড়াহুড়ো করায় প্রতিবছরই পাঠ্যবইয়ের ইংরেজী ভার্সনে ভুল থাকে। অসংখ্য বানান ভুল এবং বাক্যগঠনে অসঙ্গতির প্রমাণ মিলেছে প্রতিবছরই। অথচ যারা এসব অনুবাদ করেন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। প্রশ্নপত্রের এসব ভুলের জন্য ইংরেজী ভার্সনের শিক্ষার্থীরা তো ‘অটোনম্বর’ পাবে না। কর্তৃপক্ষের ভুলে কেন শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রশ্ন ভুক্তভোগী এ অভিভাবকের। কেবল ভুল আর ভুল! এদিকে পাঠ্যবইয়ের ভুলের সঙ্গে ইংলিশ ভার্সনের প্রশ্নের ভুল গত এক বছরেই ঘটেছে বহুবার, যা ব্যাপক সমালোচনারও জন্ম দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায়েই প্রশ্নপত্রের ভুলের শিকার হচ্ছে ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। নিম্নমানের বই থেকে প্রশ্ন করা, ইংলিশ ভার্সনে সৃজনশীল প্রশ্ন করার মতো শিক্ষকের অভাবসহ নানা সঙ্কটের খেসারত দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। গত বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর এক প্রশ্নপত্রেই ছিল অর্ধশতাধিক ভুল! ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি’ পরীক্ষার এক প্রশ্নপত্রে অর্ধশতাধিক ভুল ধরা পড়ার পর এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল শিক্ষা প্রশাসনে। প্রশ্নপত্রটির পঞ্চাশটি নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মধ্যে চল্লিশতেই ভাষা ও ব্যাকরণগত ভুল ছিল। এগুলোসহ পুরো প্রশ্নপত্রে ভুলের সংখ্যা ছিল অর্ধশতাধিক। ঘটনা নিয়ে এক অভিভাবকের ফেসবুকে দেয়া অভিব্যক্তি ছিল, ‘আমি প্রশ্নপত্রটি দেখেছি, ভুল ছাড়া কোন বাক্য চোখে পড়েনি। আমি শকড- এই প্রশ্নগুলো যে বা যারা করেন, আমি মনে করি না, তারা শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।’ অসংখ্য ভুলের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল এমন, ‘What would happen if no the Mujibnagar govt. was formed?’ অথচ শুদ্ধ বাক্যটি হবে ‘What would happen if the Mujibnagar govt. was not formed?’। বহুনির্বাচনীটির উত্তরেও বাক্যের ব্যাকরণেও ভুল পাওয়া যায়, উত্তরে বলা হয়েছে- It wouldn : be possible to train of freedom fighter, এখানে of এর স্থলে to হবে। ২নং প্রশ্নে বলা হয় ‘Why Bangladesh to import a lot of vegetable oil?’, এই প্রশ্নটিতে to’ বসার কথা নয়। আরেকটি এর উত্তরেও ভুল বাক্য রয়েছে। বলা হয়েছ, ‘Because, Production is lwo than demand.’, সঠিক বাক্যটি হবে ‘Because, Production is lower than demand.’। ৩নং প্রশ্নে বলা হয়েছে ‘Why was built 177 secret room at Sompur Bihar in Paharpur?’ এই পুরো বাক্যটিই ভুল। জাকারিয়া হাবিব নামে একজন হতাশ হয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২০০ বছর ইংরেজী শেখার পর পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের ইংলিশ ভার্সনের প্রশ্নপত্রের এই দৈন্য দশা!!! এই পরীক্ষার প্রশ্ন প্রস্তুতকারী, নিরীক্ষক সর্বোপরি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন!!! কারণ সবাই মিলে অনেক পরিশ্রম না করলে একটা মাত্র প্রশ্নপত্রে এতগুলো ভুল করা সম্ভব নয়। সবার কাছে বোধগম্য হবে না, তাই প্রশ্নের মানের বিষয়টা আলোচনার বাইরেই রাখলাম। ন্যূনতম ইংরেজীর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও ভুলগুলো বুঝতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর দায়িত্ব নেবে কে? ভুল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তার জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমিকে দায়ী করেছিলেন সিলেটের জেলা সরকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, প্রশ্ন জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি তৈরি করে থাকে। আমরা যে প্রশ্ন পাই, সেটাই কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করি। প্রশ্নে ভুল আছে কী নেই, সেটা দেখা আমাদের দায়িত্বের ভেতর পড়ে না। প্রাথমিকের মতো না হলেও পরীক্ষার ইংরেজী ভার্সনের প্রশ্নপত্রে অসংখ্য বানান ভুল এবং বাক্যগঠনে অসঙ্গতির প্রমাণ সামনে চলে আসে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি পরীক্ষায়ও। জেএসসি পরীক্ষার গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নে দশটি ভুল বানান পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকটি বাক্যেও ছিল গঠনগত অসঙ্গতি। সৃজনশীল এ প্রশ্নপত্রের বহু নির্বচনী (মাল্টিপল চয়েস) অংশের ১২ নম্বর প্রশ্নে ‘Overies’ বানানটি ভুল লেখা হয়েছে। এর শুদ্ধ বানান হবে ‘Ovaries’। আবার ঠিক এর পরের প্রশ্নেই নির্বচনী ‘deficit’ বানানটি ভুল করে লেখা হয়েছে ‘dificit’। ১৯ নম্বর প্রশ্নে ‘Baking’-কে ভুল বানানে লেখা হয়েছে ‘Backing’। কি বলছেন বিশেষজ্ঞ, অভিযুক্ত প্রকাশক ও এনসিটিবি? সরকারের অনুমোদন ছাড়া বেআইনীভাবে বিকৃত বই বাজারে ছাড়লেও এসব নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথাই নেই এ্যাবাকাস পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী জামাল হোসেনের। সরকার অনুমোদিত বই ও তার প্রকাশনার বইয়ের দিনরাত তফাতের প্রমাণ তুলে ধরলে তিনি প্রথমে বলে বসেন, হুবহু অনুবাদ হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এরপর নিয়মে বিষয়টি তুলে ধরা হলে বলেন, এটা তেমন কি? বিষয় তো একই আছে। অবৈধভাবে বই প্রকাশের শাস্তি সম্পর্কে জানানো হলে তিনি বলেন, এনসিটিবিই বলে সহায়ক বই প্রকাশ করা যাবে? কোথাও এমন নির্দেশনা আছে এনসিটিবির? প্রমাণ দেখতে চাইলে এ প্রকাশক বলেন, আমার কাছে নেই। এনসিটিবির সাবেক প্রধান সম্পাদক ও লেখক অধ্যাপক আবদুল মান্নান ইংলিশ ভার্সন বইয়ে অনুবাদের ভুলসহ নানা অসঙ্গতির কথা স্বীকার করে বলছিলেন, আসলে ইংলিশ ভার্সনের বইয়ের এ সমস্যাটি আজকের নয় এ সমস্যাটির কথা আগেও বহুবার সামনে এসেছে। ইংলিশ ভার্সন বইয়ের মান ভাল হওয়া উচিত ছিল এতদিনে। তবে এটাও সত্যি যে আমাদের দেশে উন্নত দেশগুলোর মতো ভাল মানের টেক্সটবুক ডেভেলপার নেই। পাঠ্যবই তৈরির জন্য সত্যিকারের দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ শ্রেণী গড়ে উঠেনি উন্নত দেশগুলোর মতো। যেমন ধরুন শিশুশ্রেণীর একটি বই প্রণয়নের জন্য যারা কাজ করছেন তারা শিশুদের বোঝার উপযোগী শব্দ ব্যবহার করে লিখছেন না। তারা লিখছেন নিজেদের উপযোগী ভাষা, শব্দ। কিন্তু শব্দ, বাক্যটি শিশুরা আয়ত্ব করতে পারবেন কিনা তা ভাবা হয় না। অবশ্য এনসিটিবির বর্তমান প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সন্তোষ কুমার ঢালী জনকণ্ঠকে বলছিলেন, আপনি যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কথা (জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে এনসিটিবির কাছে ইংলিশ ভার্সনের বইয়ের কিছু নমুনা সরবরাহ করা হয়েছে) আমাদের জানিয়েছেন তা আমরা পর্যালোচনা করেছি। উর্ধতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি দেখছে। আসলে আমি এ দায়িত্বে এসেছি মাত্র কয়েকদিন হলো। এনসিটিবির এসব সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ হচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যেই ইংলিশ ভার্সনের বইয়ের সব ধরনের সমস্যার সমাধান হবে। আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ইতোমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেছে। আমরা কথা দিতে পারি ’২০ সালে যে বই শিক্ষার্থীরা পাবে সেখানে কোন সমস্যা থাকবে না। অন্যদিকে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ও সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামূল হক রতন সিদ্দিকী। তারা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য অনুসারে আমরা কাজ করছি। অবশ্যই আমরা আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেব। তবে একই সঙ্গে বাজারে থাকা অনুমোদনহীন সরকারী কোন বই না পড়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ জানাব। একই সঙ্গে এনসিটিবির অনুমোদন ছাড়া কোন বই পাঠ্য তালিকায় রাখার বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও সতর্ক করছি আমরা।
×