ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদরোগ হাসপাতালে যেন রোগীর মিছিল ॥ চার শ’ বেডের হাসপাতালে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৩ নভেম্বর ২০১৮

  হৃদরোগ হাসপাতালে যেন রোগীর মিছিল ॥ চার শ’ বেডের হাসপাতালে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি

নিখিল মানখিন ॥ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যেন রোগীর মিছিল! হাসপাতালের প্রতিটি শয্যা, শয্যা ছাপিয়ে বারান্দা, করিডোর থেকে শুরু করে সিঁড়ি পর্যন্ত রোগীর লাইন। মেঝেতে অতিরিক্ত শয্যা দেয়ার পরও রোগীর ভিড় সামলাতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ দ্রুত সেবা দিয়ে তাদের রিলিজও দিচ্ছেন। এরপরও রোগীর চাপ হাসপাতালে। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে হয়। ৪১৪ শয্যার এ হাসপাতালে সব সময় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকেন। আর বহির্বিভাগে আসেন দৈনিক সহস্রাধিক রোগী। অতিরিক্ত রোগী থাকার কারণে অনেক সময় সেবার গুণগতমান শতভাগ নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়। এরপরও হৃদরোগে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষের একমাত্র ভরসা এই সরকারী বিশেষায়িত হাসপাতাল। গত ২৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হাসপাতালের ভার্টিক্যাল এক্সটেনশনের (উর্ধমুখী) সম্প্রসারণ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের সব রকম সেবার পরিধি কয়েকগুণ বাড়ছে। সরেজমিন ঘুরে হাসপাতালটির এই চিত্র পাওয়া গেছে। হাসপাতালের দোতলার পিসিসিইউ ওয়ার্ডে গত ২৯ অক্টোবর ভর্তি হন রামপুরা বনশ্রীর সাজেদা খাতুন (৪৩)। তার ছেলে মোঃ রফিক গত বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, তার মা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত। এর আগেও এই হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন তিনি। ভর্তির প্রথম দিন শয্যা খালি না থাকায় মেঝেতে কাটিয়েছেন, কিন্তু সেবা পেয়েছেন। পরদিন রোগী রিলিজ হলে তার মা সিট পান। একটু দুর্ভোগ পোহাতে হলেও বিনামূল্যে ভাল চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন বলে জানান মোঃ রফিক। হাসপাতালের মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন টাঙ্গাইলের বেলাল হোসেন (৫৩)। তিনি জানান, হার্ট এ্যাটাকের পর স্থানীয় হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে চিকিৎসকরা এই হাসপাতালে রেফার করেন। এখানে আসার পর তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে জানান বেলাল হোসেন। এভাবে মেঝেতে বিছানা পেতে থাকা ১৩ রোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ। কারও বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। তারা জানিয়েছেন, মেঝেতে থেকেও তারা স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হাসপাতালের বাথরুম-টয়লেট অপরিচ্ছন্ন। হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কেন এত ভিড় এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে দেশে হৃদরোগের জন্য চালু থাকা সেবাকেন্দ্র চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে কার্ডিওলজিস্ট পাওয়া গেলেও মফস্বল শহরে তা নেই। দক্ষ চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি সঙ্কটের কারণে দেশের জেলা সদরের সরকারী হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগ সেবা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। আটটি সরকারী মেডিক্যালে অল্প পরিসরে হৃদরোগের সেবা দেয়া হচ্ছে। করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) এবং লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে সেখান থেকে তারা রোগীদের ঢাকায় রেফার করতে বাধ্য হন। ফলে ভিড় বাড়ছে সরকারী এই হাসপাতালে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। প্রতিটি ওয়ার্ড ও বারান্দায় ভর্তি হওয়া রোগীদের বিছানা। নির্ধারিত বেডের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় ওয়ার্ডগুলোর বারান্দায় বিছানা সাজাতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, বর্তমানে এ হাসপাতালে অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ৪১৪টি। কিন্তু প্রতিদিন গড়ে ৯৫০ থেকে এক হাজার রোগী ভর্তি থাকে। এছাড়া বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক রোগী সেবা নেয়। তবে হাসপাতালের পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় এসব রোগীকে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেবা নিতে হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে হাসপাতালের ভার্টিক্যাল এক্সটেনশনের (উর্ধমুখী) নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন কর্তৃপক্ষ। এ কাজ শেষ হলে হাসপাতালে সেবা গ্রহীতাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আফজালুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের বর্তমান প্রশাসনের পরিচালনায় বেড়েছে এই হাসপাতালের সেবার গুণগত মান। হৃদরোগ চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে। হৃদরোগ চিকিৎসায় দেশের একমাত্র সরকারী বিশেষায়িত হাসপাতালের সাধারণ শয্যা, কেবিন, আইসিইউ, সিসিইউ, ক্যাথল্যাব এবং ওটি কমপ্লেক্স সুবিধা দুই থেকে তিনগুণ বাড়ছে। এসবের পাশাপাশি চিকিৎসকের সংখ্যা ও লোকবল বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে এ হাসপাতালে সর্বনিম্ন ব্যয়ে সাধারণ হৃদরোগীরা আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পাবে। হাসপাতালকে একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোন রোগী যেন অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় এখান থেকে ফিরে না যায় সে ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। হাসপাতালের কেনাকাটায় যেন কোন অনিয়ম না হয় সেজন্য সিএমএসডির মাধ্যমে সব যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। পরিচালক আরও বলেন, হাসপাতালের উন্নয়নে কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করিনি। আশা করি দেশের মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে এ হাসপাতালকে গড়ে তুলতে সক্ষম হব। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি হাসপাতালের পরিচালক পদে যোগদান করার পর থেকে হাসপাতালের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সিসিইউ-১ ও সিসিইউ-২ এর রোগীদের সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের স্ট্রেপটোকাইনেজ ইনজেকশন বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে। এতে অসংখ্য গরিব হৃদরোগীর জীবন বেঁচে যাচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি সব রোগীকে প্রথম দু’দিন চারটি করে বিনা মূল্যে এনেক্সোপাইরিন ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অবকাঠামো উন্নয়ন, রোগীদের সাহায্য করার জন্য হেল্পডেস্ক চালু এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। ভিজিটরদের জন্য ভিজিটর আইডি কার্ড চালু ও অভিযোগ বাক্স বসানো হয়েছে। হৃদরোগীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে নন ইনভেসিভ কার্ডিওলজি বিভাগ চালু করা হয়েছে। ক্যাথল্যাবে এফএফআর ও আইভাস মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য স্টেন্ট, বাল্ব ও অক্সিজেনেটর কেনা হয়েছে। হাসপাতালের সামগ্রিক সেবার বিষয়ে তথ্যবহুল ফরম চালু করা হয়েছে। এছাড়া ওপেন হার্ট সার্জারি রোগীদের সেবা বাড়াতে নতুন ও আধুনিক হার্টলাং মেশিন স্থাপনের কাজ চলছে। ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য বিদ্যমান ছয়টি ওটির মধ্যে তিনটি সচল ছিল। ইতোমধ্যে একটি হার্টলাং মেশিন মেরামত করে ওটি চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও তিনটি হার্টলাং মেশিন কেনা হয়েছে। এসব মেশিন স্থাপনের পর ছয়টি ওটিতেই একসঙ্গে বেশি সংখ্যক রোগীকে ওপেন হার্ট সার্জারি সেবা দেয়া সম্ভব হবে। আরও বেশি সংখ্যক কার্ডিওলজি রোগীদের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্টি করার জন্য নতুন মেশিন কেনার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জরুরী বিভাগের আধুনিকায়নে নতুন দুটি ইকো মেশিন, দুটি ইসিজি মেশিন, ১০টি অবজারভেশন বেড স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি দুই শিফটে ছয়জন চিকিৎসক এবং ৩৩ জন নার্সের ডিউটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া জটিল হৃদরোগীদের চিকিৎসায় অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রোফিজিওলজি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী চিকিৎসকদের সুবিধার্থে ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। জানা গেছে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১৪ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ভবনের কাজ শেষ হলে কনসালটেন্ট রুম, ক্যাথল্যাব, সিসিইউ, পিসিসিইউ, কেবিন ওটি, আইসিইউ, কার্ডিয়াক সার্জারি পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড এবং কার্ডিওলোজি পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড চালু করা হবে।
×