ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জেলহত্যার ঘটনা আজও কাঁদায় প্যাটেলকে

চার নেতার রক্তস্রোত মর্মন্তুদ স্মৃতি, পাশে থেকে দেখা

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৩ নভেম্বর ২০১৮

চার নেতার রক্তস্রোত মর্মন্তুদ স্মৃতি, পাশে থেকে দেখা

মোরসালিন মিজান ॥ জাতীয় চার নেতা হত্যার সেই যে মর্মন্তুদ কাহিনী সেই যে গা শিউরে ওঠা গল্প, গল্প তো নয়, বেদনার ইতিহাস, অনেকেই বই পড়ে জেনেছেন। টেলিভিশনগুলোতে এখন জেলহত্যা দিবসের বিশেষ আয়োজন। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কী ঘটেছিল, তা বর্ণনা করা হচ্ছে। এভাবে নানা মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের আত্মত্যাগের কথা। এবং এর পরও সাইদুর রহমান প্যাটেলের মুখ থেকে একবার শোনা চাই। চরম দুর্যোগের কালে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে একই জেলে বন্দী ছিলেন তিনি। সে সময়ের টগবগে যুবক এখন সত্তরোর্ধ। তবে শার্প মেমোরি। স্মৃতি থেকে বলেন না শুধু, অন্ধকার সময়ের অলি গলিতে আলো ফেলতে ফেলতে যান। মাঝে মাঝেই আবেগে কণ্ঠ বুজে আসে। চশমার কাঁচ মুছতে হয়। কিন্তু অতীতটা পরিষ্কার দেখেন। দেখান। ঘটনা ও ঘটনার আলোকে পূর্বাপর ব্যাখ্যা করতে পারেন। বৃহস্পতিবার সামনে বসে তার কথা শুনতে শুনতেই মনে হয়েছে, সবারই তার মুখ থেকে একবার শোনা চাই ইতিহাসটা। প্রয়োজন আছে। না, সাইদুর রহমান প্যাটেল কোন ইতিহাসবিদ নন। তার আছে একাধিক পরিচয়। তিনি একজন ফুটবলার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা সবাই জানেন, দলটির প্রস্তাবক বা প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নিজে খেলেছেন। আবার একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছেন। গেন্ডারিয়া ছিল তার মূল ঠিকানা। এলাকার মানুষজন এখনও দেখলে ছুটে আসেন। প্যাটেলের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রলীগ দিয়ে। তখন থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য, এত স্নেহ পেয়েছিলেন যে, শুনে এখনও কারও কারও ঈর্ষা হবে। তার আরকেটি পরিচয়- শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল ’৭৫-এর খুনীচক্র। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনীদের জন্য হুমকি হয়ে আসতে পারে- এমন নেতাকর্মীদের তারা গ্রেফতার শুরু করে। একই আশঙ্কা থেকে গ্রেফতার করা হয় সাইদুর রহমান প্যাটেলকে। পাঠানো হয় নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জাতীয় চার নেতাকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেই ‘নতুন জেলে’ স্থান হয় তার। আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সেখানে ছিলেন। প্যাটেল তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। যুবক বয়সে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে হত্যাকান্ডের দিন ৩ নবেম্বর পর্যন্ত জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কাটান তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সূত্রে আগে থেকেই সবার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। কারাগারে গিয়ে আরও কাছে থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়। এখন চার নেতার জীবনের শেষ দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি। এতকাল পরও জেলহত্যার আগের ঘটনা প্রবাহ, ওই রাতের নৃশংসতা, পরের নানা পরিবর্তন তিনি যেন মস্তিষ্কের কোষে গেঁথে রেখেছেন। নিজের গুলশানের বাসায় বসে রাজসাক্ষীর মতো বলে যান তিনি। যেন কয়েকদিন আগের ঘটনা। যেন বর্তমান! আসলে জেলহত্যার ঘটনাটি এত হৃদয় বিদারক ছিল, এত অকল্পনীয় ও আকস্মিক ছিল যে, পরবর্তী জীবনে এই দুর্বিষহ স্মৃতি থেকে বের হতে পারেননি তিনি। বের হতেও চান না। বলেন, ওই কালো অধ্যায়ের যেটুকু আমি জানি, আগামী প্রজন্মকে জানাতে চাই। এটা আমার কর্তব্য। তখন সময়টা ছিল ঘটনাবহুল। দ্রুত অনেক ঘটনা ঘটছিল। একটি ঘটনার সঙ্গে অন্যটির পরম্পরা। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ঘটনার কথা বলে আলোচনার শুরু করেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। যত শোনা যায়, ততই বাড়ে কৌত‚হল। এক পর্যায়ে মূল আলোচনা। জেলহত্যা প্রসঙ্গ। প্যাটেল একটু থামেন। উপরের দিকে তাকান। একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপর বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে ততদিনে গুছিয়ে এনেছেন। ঠিক সে সময় নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। আমার বন্ধু শেখ কামাল, ছোট্ট রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সেদিন যারা বাসায় ছিলেন, সবাইকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। অন্য সিনিয়র নেতারাও একে একে গ্রেফতার হন। আমরা একদমই কমান্ডহীন হয়ে পড়ি। প্রতিরোধের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। এর এক পর্যায়ে ১১ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি মন্ত্রী বা এমপি ছিলাম না। সাধারণ কয়েদি। তবুও জানি না কেন, আমাকে ডিভিশন সুবিধা দেয়া হয়। এ কারণে বর্ষীয়ান নেতাদের জীবনের শেষ সময়ের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম আমি। তিনি বলেন, এখন যেটি কারা স্মৃতি জাদুঘর, সেখানে ৩ নম্বর কক্ষে রাখা হয় আমাকে। কক্ষটিতে প্রবেশের পরই প্রথম জানতে পারি এখানে আছেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীও। চোখের সামনে দেখতে পাই তাঁকে। আমার বেডের ঠিক উল্টো দিকে মনসুর আলী সাহেবের বেড। বেড বলতে কাঠের চৌকি। এ কক্ষে মোট ১৭টি কাঠের চৌকি ছিল, কয়েকটি এখন নিদর্শন হিসেবে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বাকি চৌকিগুলোতে কারা থাকতেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব। কর্নারে বঙ্গবন্ধুর বোনের হাজব্যান্ড সৈয়দ হোসেন সাহেব। মতিঝিলের এমপি শামীম মিসির। জোহা সাহেব, শামীম ওসমানের বাবা। রংপুরের আজহার এমপি। শ্রমিক নেতা কাজী মোজাম্মেল। আমির হোসেন আমু ভাই। সব মিলিয়ে ১৭। অন্য কক্ষগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেগুলোতেও যাওয়া আসা ছিল আমাদের। ২ নম্বর কক্ষে ছিলেন কামরুজ্জামান সাহেব। একই কক্ষে অন্যদের মধ্যে ছিলেন হাশিম উদ্দিন হায়দার পাহাড়ী। বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা মহিউদ্দিন ভাই। সচিব আসাদুজ্জামান ছিলেন। একেবারে জুনিয়রদের মধ্যে ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ১ নম্বর কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন সাহেব। এ কক্ষে অন্যদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুছ মাখন। আশাবুল হক এমপি। আনোয়ার জং এমপি, মুরাদ জংয়ের বাবা। দেলওয়ার এমপি, এ্যাডভোকেট দেলওয়ার সাহেব। কোরবান আলী সাহেব। শেখ আব্দুল আজিজ। মোট ৮ জন। তিনি বলেন, শহীদ জাতীয় চার নেতার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। একই কক্ষে থাকায় মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে বেশি সময় কেটেছে। আর বাইরে বের হলে দেখা হতো অন্য তিন নেতার সঙ্গে। প্রতিদিন সকাল হলেই জেলের তালা খুলে দেয়া হতো। আমরা হাঁটতে বের হতাম। তখন জাতীয় নেতাদের সঙ্গে কখনও সরাসরি আমার সঙ্গে কথা হতো। কখনও অন্যদের সঙ্গে কথা বলতেন তারা। আমি পাশে দাঁড়িয়ে শুনতাম। কী কথা হতো আপনাদের মধ্যে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হারানোর ব্যথা কেউ সইতে পারছিলেন না। সে জায়গা থেকেই বেশি কথা হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, রাতে ঘুম হতো না আমাদের। একদিন দেড়টা দুইটার দিকে চোখ লেগে আসছে, ঠিক তখন কারও বিলাপ শুনে সেদিকে তাকালাম। দেখি, মনসুর আলী সাহেব মশারির ভেতরে বসা। সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক সুরে তিনি বলছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে তোরা মেরে ফেলালি? তোরা রাসেলকেও মেরে ফেলালি?’ একা একাই বলে যাচ্ছিলেন। পরে প্রায়শই এমন বিলাপ কানে এসেছে বলে জানান তিনি। এম মনসুর আলীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিন মনসুর আলী সাহেব জেলগেটে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ফিরেছেন। আমরা তখন হাঁটাহাঁটি করছিলাম। হঠাৎ কাজের আফজাল নামের কাজের ছেলেটি এসে বলল, স্যার আপনাকে ডাকছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই আমি। মনসুর সাহেব বাসা থেকে পাঠানো কলা সমুচা খেতে দিলেন আমাকে। কেক দিলেন। কাঁধে হাত দিয়ে অস্বাভাবিক আদরের সুরে বলেন, তোকে বঙ্গবন্ধু খুব আদর করতেন, আমি জানি। জেল থেকে বের হলে আমার কাছ থেকেও এমন আদর পাবি। তার মানে, জেল থেকে বের হওয়ার আশা তখনও ছিল? উত্তরে প্যাটেল বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা আশা ছিল। ক্রমে তা নিঃশেষ হতে থাকে। বন্দীদের জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের একটি তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, তখন জানতে পারি, জেলগেটে এসে জেলার আমিনুর রহমান সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করছে খুনী ডালিম, নূর, হুদা মাজেদরা। এ তো ভাল সঙ্কেত নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর সাহেবই ওই জেলারকে চাকরি দিয়েছিলেন। আমি পরে বিষয়টি তাকে জানাই। উত্তরে উনি বলেন, প্যাটেল, দেখেছিস কী? আমি চাকরি দিয়েছি ঠিকই, ও মনিবদের খুশি করার জন্য এমন কাজই করবে যা হিস্টোরি হয়ে থাকবে। তার মানে তিনি খারাপ কিছুর আশঙ্কা করছিলেন। বাকিরা? উত্তরে প্যাটেল বলেন, যত দিন যাচ্ছিল ততই নেতাদের মধ্যে চেঞ্জ দেখছিলাম আমি। ক্রমে ভেঙ্গে পড়ছিলেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে একটি মর্মান্তিক একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, কামরুজ্জামান সাহেবকে একটা ফলস কেস দিয়ে কোর্টে নিয়ে গেল একদিন। কীভাবে নিয়ে গেল জানেন? হ্যান্ডকাফ পরিয়ে। চিন্তা করেন, যারা এই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন...। কথা শেষ করতে পারেন না। চোখ ছলছল করে ওঠে তাঁর। বলেন, উনি (কামরুজ্জামান) কোর্ট থেকে ব্যাক করে ৩ নম্বর কক্ষের সামনে একটা চেয়ারে বসলেন। বসে, বিলিভ মি, বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলেন। ওই যে হ্যান্ডকাফ পরিয়েছে না, উনি নিতে পারেননি। আব্দুস সামাদ আজাদসহ সবাই ছুটে এসে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কাজ হলো না। প্যাটেল বলেন, আমি খুব ভাল চা বানাতাম। কামরুজ্জামান সাহেব আমার চা পছন্দ করতেন। উনার একটা কাপ ছিল, স্পেশাল। বাসা থেকে আনা। তাঁর কাজের লোক কাপটা নিয়ে আসতো আমার কাছে। আমি কাপ ভর্তি করে পাঠাতাম। তিনি খেয়ে বলতেন, ফার্স্ট ক্লাস চা। কোর্ট থেকে ফেরার পরও আমি তাকে চা করে দিই। কিন্তু তিনি এত নার্ভাস ছিলেন যে, দু’হাত সমানে কাঁপছিল। দেখতে দেখতে চা পড়ে কাপ অর্ধেক হয়ে গেল। মুখ খুলে প্রথম কথাটি বললেন তিনি। বললেন, ওরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে না। সাইদুর রহমান প্যাটেলের কথা হতো তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও। বঙ্গতাজ জেলের সামনে সুন্দর ফুলবাগান করেছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই নেতার সঙ্গে কথা হতো। কী কথা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাজউদ্দিন সাহেব সব সময়ই সাহস দিতেন আমাদের। কেন জানি না, আমাদের বলতেন, ডিসেম্বরে জেল থেকে সবাই বের হয়ে যাবে। কিন্তু হত্যাকান্ডের দুদিন আগে মনে মনে বার্তা পেয়ে গিয়েছিলেন তাজউদ্দীনও। সে কথা বলতে গিয়ে আবারও আবেগে কণ্ঠ জড়িয়ে আসে সাইদুর রহমান প্যাটেলের। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন সাহেব ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নে একদমই বিশ্বাস করতেন না। একদিন হাঁটার পথে তাকে সালাম দিলাম। দাঁড়ালেন তিনি। কথা শুনতে মুহূর্তেই চলে এলেন আরও পাঁচ সাতজন। নাভির ওপর একটি হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে মুখ কিছুটা ঢেকে কথা বলতেন তাজউদ্দীন। এদিনও তাই হলো। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, এতদিন তো স্বপ্ন দেখতাম বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকছেন। গতকাল দেখলাম আমি ৩২ নম্বরে ঢুকেছি। বঙ্গবন্ধু অমনি আমাকে হাতে ধরে গাড়িতে তুলে নিলেন। বললেন, চল টুঙ্গিপাড়ায় যাই! প্যাটেল যোগ করেন, এই প্রথম মনে হলো তাজউদ্দীন আহমদ স্বপ্নে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে প্যাটেল বলেন, ভীষণ ভদ্রলোক ছিলেন। অত্যন্ত কম কথা বলতেন। বেঁচে থাকা নিয়ে তিনিও তাঁর আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। সাইদুর রহমান প্যাটেলের ভাষ্য মতে, এভাবে টেনশন ছড়িয়ে পড়ছিল। জেলহত্যার এক বা দুদিন আগে মাঝরাতে ফ্লোরে কম্বল বিছিয়ে বসেছিলেন তারা। হঠাৎ দেখা গেল মেজর ডালিম জেলারসহ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে নিউ জেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে আবারও তারা খারাপ কিছুর আশঙ্কা করেন। প্যাটেল বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা। অভিজ্ঞতা থেকে বোঝলাম, এরা রেকি করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেউ কেউ ইট লাঠিসোটা ইত্যাদি হাতের কাছে এনে রাখার কথাও বললেন। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য। যারা দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনা করার শেষ চেষ্টা করতে পারতেন তারা আর সুযোগ পেলেন না। রক্তাক্ত ৩ নবেম্বরের স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে প্যাটেল বললেন, ২ নবেম্বরের রাত ৩ নবেম্বরে পৌঁছতেই শেষ হয়ে গেল সব। ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় তার চোখ বড় হয়ে কিছুটা যেন সামনের দিকে চলে আসছিল। তিনি বলছিলেন, আমরা ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠলো। ননস্টপ বাজছে কাঁসার ঘণ্টা। তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ৩টা ১৭ মিনিট। সিপাহিকে ডেকে জানার চেষ্টা করছিলাম, কী হচ্ছে? এরই মাঝে কানে আসে লোহার গেট খোলার শব্দ। কোন গেটটি খোলা হচ্ছে আমাদের এখান থেকে বোঝা যায় না। কিছুক্ষণ পর জানতে পারি, ২ নম্বর গেট খুলে কামরুজ্জামান সাহেবকে বের করে নিয়ে গেছে। ওই রুমে থাকা অন্যদে বন্দীদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের রুমে। এর মধ্যেই মনসুর সাহেবকে নিতে আমাদের কক্ষে চলে এলো কয়েকজন। তিনি তখনও মশারির ভেতরে। ডিআইজি আওয়াল এসে সালাম দিয়ে বললো, স্যার, সেনাবাহিনীর লোকেরা এসেছে। আপনাকে একটু ১ নম্বরে যেতে হবে। ঘটনা অনুমান করেই হয়ত মনসুর আলী সাহেব চট করে বিছানা থেকে ওঠে অজু করলেন। একটা পাঞ্জাবি পরলেন গায়ে। হাতে তসবিহ। দুঃখ করে প্যাটেল বলেন, নেতার কোমর জাপটে ধরে একরকম টানা হেচড়া শুরু করে দেয় হাবিলদার নায়েব আলী। আমি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মনসুর আলী সাহেবকে বললাম, ওরা হয়ত জোর করে কোথাও আপনার স্বাক্ষর নেবে। কথা শুনে একদমই রা করলেন না তিনি। পাথর চোখ করে একটা চাহনি দিলেন, সে চাহনি আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। সাইদুর রহমান প্যাটেল বলেন, মনসুর আলী সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে গুলির শব্দ কানে আসে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠ নিজ কানে শুনেছেন বলে জানান প্যাটেল। বলেন, কী কর? কী কর? জানতে চাইছিলেন তাজউদ্দীন। উত্তর না দিয়ে শুরু হয় ব্রাশ ফায়ার। ফুল ম্যাগজিন শেষ করা হয়। খুনীরা ফিরে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে পাঁচটা গুলি ছুঁড়ে। তিনটি গুলি লোহার রডে লেগে সেখানে গভীর ক্ষত তৈরি হয়। ক্ষতগুলো এখন লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। প্যাটেল বলেন, ওই সময় কেমন যেন কেয়ামতের কথা মনে পড়ছিল। আমাদের মাথা ঠিক কাজ করছিল না। তার পরও নিজেদের সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। ভাবছিলাম, পেনিক সৃষ্টি করার জন্যও গুলাগুলি হতে পারে। হয়ত অন্য কোথাও নেতাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের ভয় দেখাতে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে এখানে ওখানে। তবে সকালের ছবিটা সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়। প্যাটেল বলেন, কেউ সাহস করে কক্ষ থেকে বের হচ্ছিলেন না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করি। জেলের সামনে সরু ড্রেন। তাকিয়ে দেখি, তাজা লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রক্তের স্রোত দেখে চিৎকার করে ওঠি আমি। ও আল্লারে, বাবারে মারে বলে কাঁদতে থাকি। বলতে থাকি- সামাদ ভাই, সামাদ ভাই, চার নেতা নেই। বাকি বন্দীরাও চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। ওই সময়টি ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেউ পারবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্যাটেল কথা প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য দেন। আঁতকে ওঠার মতো তথ্য। বলেন, পরে শুনেছি, মনসুর সাহেব গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও বেঁচে ছিলেন। দেয়ালে শরীর ছেড়ে দিয়ে পানি চাইছিলেন তিনি। খুনীরা ততক্ষণে গাড়ির কাছাকাছি। এমন সময় নরকের কীট নায়েব আলী দৌড়ে গিয়ে তাদের থামায়। খবর পেয়ে আবারও জেলে আসে খুনীরা। এবার মনসুর আলী সাহেবের রক্তে ভেসে যাওয়া শরীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচানো হয়। বাকি মরদেহগুলোতেও একইভাবে বেয়নেট চার্জ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ এই প্রতিদান দিল? প্যাটেল নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন। কিন্তু ভেঙে পড়েন না। পরিণতি নিজ চোখে দেখার পরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে একচুল না সরার শপথ নেন মনে মনে। তিনি বলেন, ক্ষমতা দখল করার পর জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে কাজ করার বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠান আমাকে। আমি জেলে থেকেই সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। এ কারণে আমাকে কিছুতেই আর মুক্তি দেয়া হবে না বলে জানতে পারি। এবং তাই হয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর জেল থেকে ছাড়া পান সাইদুর রহমান প্যাটেল। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। কিন্তু ওই যে দেশপ্রেম, ওই যে শেখ মুজিব, চার নেতা, বন্ধু শেখ কামালের স্মৃতি তাঁকে ফিরিয়ে আনে প্রিয় শহর ঢাকায়। এখন থেকে দেশে থাকবেন বলেই জানান তিনি।
×