ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার বোঝা মগবাজার ফ্লাইওভারকে সিটি কর্পোরেশন বুঝে নিতে চায় না

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩ নভেম্বর ২০১৮

ঢাকার বোঝা মগবাজার ফ্লাইওভারকে সিটি কর্পোরেশন বুঝে নিতে চায় না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক (সমন্বিত) ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের জন্য গত ২২ অক্টোবর একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। কমিটিকে ৫ নবেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এরপর থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশন। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে থাকা ফ্লাইওভারটি নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে। তবে ফ্লাইওভারটি বুঝে নিতে এখনও আপত্তি আছে দুই সিটি কর্পোরেশনের। সংস্থা দুটি বলছে, ফ্লাইওভারে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান না করে ফ্লাইওভার বুঝে নেয়া উচিত হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্মাণ শেষে এরই মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। সংস্থাটি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুই সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে। পরে মন্ত্রণালয় এ জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন) মাহবুব হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো-ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন প্রধান প্রকৌশলী, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক। কমিটিকে আগামী ৫ নবেম্বরের মধ্যে ফ্লাইওভারটি দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তের পর দ্রুত ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে বৈঠক করেছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পর এ ত্রুটি খুঁজতে ডিএসসিসি আন্তঃবিভাগীয় সাতটি কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে বিদ্যুত বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, সম্পত্তি বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। কমিটিগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, পুরো ফ্লাইওভার পরিদর্শন করে এর মধ্যে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে তা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন আকারে সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করা। এর আগে গত ২৩ জুলাই ডিএসসিসির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোঃ বিলালের সভাপতিত্বে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার জানান, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্প ২০১৭ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়। কীভাবে ফ্লাইওভারটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে, এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলীদের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব নথিও দেয়া হয়েছে তাদের। সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব জানান, মগবাজার-মৌচাক ও মালিবাগ এলাকায় দীর্ঘ যানজট নিরসনে এ ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়। তাই ফ্লাইওভারটি সুশৃঙ্খল পরিচালনা করার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। সভায় সভাপতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন বলেন, এলজিইডি থেকে মগবাজার- মৌচাক ফ্লাইওভারটি জনসাধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জনস্বার্থ বিবেচনায় দেশী-বিদেশী অর্থায়নে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করেছে, যা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে নগরবাসী এর সুফল ভোগ করছে। এটির সুষ্ঠু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন দায়িত্ব নিক। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, মগবাজার- মৌচাক ফ্লাইওভারটির কাজ ২০১৭ সালে শেষ হলেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু ওই সময় থেকে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ গত মাসে ফ্লাইওভারটি হস্তান্তরের জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, কমিটিকে ৫ নবেম্বরের মধ্যে ফ্লাইওভারটি হস্তান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কমিটির কাজ চলছে। যেসব সমস্যা ছিল তা সমাধান হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাছে এটি হস্তান্তর করা হবে। প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী ফ্লাইওভারটি এখনও দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। এজন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও নানা জটিলতায় তা পিছিয়ে পড়েছে। সিটি কর্পোরেশন বলছে, ফ্লাইওভারে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এ জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ত্রুটিগুলো চিহ্নত করতে কয়েকটি কমিটিও গঠন করে। তবে, এসব কমিটির রিপোর্ট এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কমিটিগুলোর রিপোর্ট পাওয়ার আগে ফ্লাইওভারটি বুঝে নেয়া সম্ভব নয়। তবে, কমিটির রিপোর্ট চূড়ান্ত না হলেও বিষয়টি নিয়ে ৩১ অক্টোবর ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবারও এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই সিটির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা বলেন, নক্সা অনুমোদনের পর থেকেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নিয়ে নানা ত্রুটি দেখা দেয়। এর মধ্যে ফ্লাইওভারে ট্রাফিক সিগন্যাল, বৈদ্যুতিক বাতি নষ্ট, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, বামদিকে স্টিয়ারিং, যানজট লেগে থাকা, ওঠা-নামার র‌্যাম্প জটিলতাসহ নামার লুপে যানজট লেগেই থাকে। বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। তারা ফ্লাইওভারটিকে ঢাকার ‘বোঝা’ আখ্যা দিয়েছেন। এই ‘বোঝা’র দায়িত্ব নিতে চায় না কোন সিটি কর্পোরেশনই। এছাড়া দিনদিন আরও ত্রুটি ধরা পড়ছে। ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও জনবলের প্রয়োজন রয়েছে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে এসব সমস্যা সমাধান করে দিতে হবে। ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। কমিটি আগামী ৫ নবেম্বরের মধ্যে ফ্লাইওভারটি দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইওভারের উপর ও নিচে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করছি। অনেক সময় দেখা যায়, ফ্লাইওভারের উপর ধুলাবালিসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। ধুলায় পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সেগুলো অপসারণ করার জন্য কর্মী প্রয়োজন। এছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। আমরা সে বিষয়ে সুপারিশ করেছি। পুরো বিষয়টি নিয়ে বুধবার প্রধান প্রকৌশলীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আমাদের ডেকে বলেছেন এর দায়িত্ব নেয়ার জন্য, আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের দাবি থাকবে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে তা সেরে দেয়ার। এরপরও যদি না দেয়া হয়, আমরা দায়িত্ব নিয়ে সেগুলো সেরে নেব। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিন স্তরবিশিষ্ট চার লেনের এই ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর প্রতি মিটারে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ করা হয়েছে তিন ভাগে। প্রথম অংশ সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত। এই অংশটি ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্লাইওভারটি উদ্বোধন করেন। এটির দ্বিতীয় অংশ হলো বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক-রাজারবাগ পর্যন্ত। এই অংশটি যান চলাচলের জন্য গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ফ্লাইওভারটির তৃতীয় অংশ রামপুরা-চৌধুরীপাড়া-মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর অংশ ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
×