ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রীর ৭ দফার ৩ দফায় কাছাকাছি সংলাপ ভাল হয়েছে ॥ ড. কামাল, সন্তুষ্ট নই ॥ ফখরুল, ফের ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বসার সুযোগ আছে ॥ কাদের

সংবিধানের বাইরে নয়

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২ নভেম্বর ২০১৮

সংবিধানের বাইরে নয়

উত্তম চক্রবর্তী/রাজন ভট্টাচার্য ॥ আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন শতভাগ অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তবে ক্ষমতাসীন দলটি ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, সংবিধানের বাইরে যাবে না আওয়ামী লীগ। সংবিধানবিরোধী কোন দাবি তাদের পক্ষে মেনে নেয়াও সম্ভব নয়। কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দলটি বলেছে, এটি সম্পূর্ণভাবেই আইন ও আদালতের বিষয়। আর এই দুটি মামলা আওয়ামী লীগ নয়, দিয়েছে তাদেরই তত্ত¡াবধায়ক সরকার। নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবির ক্ষেত্রেও দ্বিমত পোষণ করেছে আওয়ামী লীগ। তবে ঐক্যফ্রন্টের রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা তদন্ত, সভা-সমাবেশ করার অধিকার এবং নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষণ নিয়োগের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। উভয়পক্ষের আলোচনায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির মধ্যে তিনটি দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক সাড়া দিলেও তাদের অন্য চারটি যেমন নির্বাচনীকালীন সরকার, সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা এবং নির্বাচনের তফসিল পেছানের বিষয়ে কোন সমঝোতা হয়নি। তবে বৈঠক শেষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে সুস্পষ্ট মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। বৈঠক শেষে ঐক্যফ্রন্টের আহŸায়ক ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সংলাপ ভাল হয়েছে, সংলাপ শেষে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, আমরা সংলাপে সন্তুষ্ট নই। জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চাইলে দ্রæতই স্বল্প পরিসরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিন্ন কণ্ঠে বলেছেন, একদিনের আলোচনায় সবকিছুর সমাধান হয় না। সংলাপে প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আপনারা নির্বাচনে আসুন। ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন হবে। আমি ক্ষমতা ধরে রাখতে চাই না। বৈঠক শেষে রাতে বেইলি রোডের বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সাড়ে তিন ঘণ্ঠার বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমরা আমাদের অভিযোগগুলোর কথা তুলে ধরেছি। সভা-সমাবেশের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সমান সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন। সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক হয়রানির মামলাগুলোর তালিকা দিলে তিনি বিবেচনা করবেন। দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা তফসিল পিছিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বললে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবেন। তাহলে আপনারা কী করবেন? জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কর্মসূচী চালিয়ে যাব। সংলাপের বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে ড. কামাল ও মির্জা ইসলাম আলমগীর সমস্বরে বলেন, একদিনের আলোচনায় সবকিছু পাওয়া যায় না। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংবিধানের মধ্যে থেকেই আমরা কথা বলেছি। আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ শেষ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যে কোন জায়গায় যে কোন সময় আলোচনা হতে পারে। আমরা তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বলেছি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সংলাপে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ২৩ ও ঐক্যফ্রন্টের ২০ নেতা সংলাপে অংশ নেন। সংলাপ শুরুর পর সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সকলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি এটা বিচারের ভার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। দীর্ঘ নয় বছর ১০ মাস হতে চলল আমরা এই সময়ের মধ্যে দেশে কত উন্নয়ন করতে পেরেছি সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন এতে এটুকু বলতে পারি। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হওয়া সংলাপ চলে সোয়া দশটা পর্যন্ত। রাত সাড়ে দশটার পর থেকে সংলাপে অংশ নেয়া নেতারা গণভবন থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকেন। সংলাপকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের চোখ ছিল গণভবনের দিকে। সন্ধ্যা থেকেই উৎসুক জনতা গণভবনের সামনে ভিড় জমাতে থাকেন। সাত দফা দাবি ও নয়টি লক্ষ্য চিঠিতে ঐক্যফ্রন্ট উল্লেখ করলেও সরকারের দেয়া সংবিধান মোতাবেক আলোচনার শর্তেই সংলাপে সম্মত হন ফ্রন্ট নেতারা। সংলাপ শেষে ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে বিস্তারিত কিছু বলেননি। তিনি এক কথায় বলেছেন, বৈঠক ভাল হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, সংলাপ শেষে দু’পক্ষের মুখে হাসি দেখা গেছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতা মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, সংলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে কিছুই বলতে পারব না। বলার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ চাপ আছে একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বলার বিষয়টা ভেবে বলতে হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। এক কথায় তিনি বলেছেন, আলোচনায় সন্তুষ্ট নই। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আলোচনা ভাল হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা চাইলে আবারও তাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে। আলোচনা বন্ধ হয়নি। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আইন ও আদালতের বিষয়। তাদের সেই কথাটিই বলা হয়েছে। জাসদের মঈনউদ্দীন খান বাদল বলেন, এটি একটি পজেটিভ স্টার্ট। প্রধানমন্ত্রী ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, খালেজা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সংলাপে বারবার ঐক্যফ্রন্টের নেতারা কথা বলেছেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা আদালতের বিষয়। তফসিল স্থগিত চেয়ে ঐক্যফ্রন্টের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। সাংবিধানিক বিষয়ে তাঁর কথা বলার এখতিয়ার নেই। এটা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে। অপর আরেক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, আপনারা নির্বাচনে আসুন। ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন হবে। আমি ক্ষমতা ধরে রাখতে চাই না। বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আলোচনা শেষে কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আলোচনায় বেশ কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানান তিনি। কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে তারা কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটা আদালতের বিষয়। নির্বাচনের তফসিল স্থগিত চেয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। ইসির সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে আমাদের করার কিছু নেই। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে আসবে কিনা এমন প্রশ্নে কাদের বলেন, সেটা তাদের জিজ্ঞাস করুন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে তাদের অনেকেই সন্তুষ্ট হয়েছেন আমি বিশ্বাস করি। আশাকরি তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরবেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, অত্যন্ত খোলামেলা পরিবেশে সাড়ে তিন ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা যে যা বলতে চেয়েছেন সবার কথা প্রধানমন্ত্রী অখণ্ড মনযোগ দিয়ে শুনেছেন। একেকজন ৩-৪ বার করেও কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের বারবার বক্তব্যে অধৈর্য হননি। তাদের বক্তব্যে বাধাও দেননি। আলোচনায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বক্তব্য রেখেছেন। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা কিছু অভিযোগ করেছেন জানিয়ে কাদের বলেন, ভদ্র ও শালিনতার মধ্য দিয়ে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কিছু কিছু বিষয়ে দু’পক্ষই একমত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেছেন, সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। তারা যেখানে ইচ্ছা সমাবেশ করতে পারবেন। রাস্তা বন্ধ না করে যে কোন মাঠে সমাবেশ করুন। প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে একটা কর্নার করে দেয়া হবে। ঐক্যফ্রন্টের অপর দাবি বিদেশী পর্যবেক্ষক নিয়োগেও বিষয়েও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কাদের বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি আধুনিক প্রযুক্তি। নির্বাচন কমিশন এবার স্বল্প পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেছে। রাজনৈতিক মামলা হামলা বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা সুনির্দিষ্ট একটি তালিকা আমার কাছে পাঠান। আমি তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করে দেখব। খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটা আইন ও আদালতের বিষয়। যে দুটি মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন দুটি মামলাই বিগত তত্ত¡াবধায়ক সরকার দিয়েছে, আমরা দেইনি। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তো বিএনপিরই লোক ছিল। অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে কামাল হোসেন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন আপনি যেসব কথা বলেছেন তার অনেক কিছুই আগে জানতাম না। পুনরায় সংলাপ হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন তার দরজা সব সময় খোলা। যদি ছোট পরিসরে আবার বসতে চান তাহলে আমার দরজা উন্মুক্ত। তারা যদি মনে করে আবারও অবশ্যই আলোচনায় আসতে পারবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি জানিয়ে কাদের বলেন, সংবিধানের বাইরে আমাদের যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। সংলাপ শেষে কামাল হোসেন সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বিএনপিসহ অন্য তিন দলের পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি। তবে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আলোচনায় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা খুশি হয়েছেন। সূত্রে জানা গেছে, তফসিল পেছানো, খালেদা মুক্তি, নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি বিষয়ে সরাসরি নাকোচ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিতর্কিত ২০০১ সালের নির্বাচন ছাড়া কোন সময় সেনাবাহিনীকে মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়নি। এখন কেন চাচ্ছেন। কি এমন হয়েছে। তবে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ফের আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। যেভাবে শুরু প্রতীক্ষার সংলাপ ॥ প্রধানমন্ত্রীর ৬টা ৫৭ মিনিটে গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে প্রবেশ করেন। আসন গ্রহণ করার পর তিনি উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে সালাম দেন। এরপর ৭টায় বহুল কাক্সিক্ষত সংলাপ শুরু হয়। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা একে একে গণভবনে প্রবেশ করেন। এ সময় সংলাপে অংশ নিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও গণভবনে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এর আগে বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে ড. কামালের বেইলি রোডের বাসা থেকে রওনা দেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। তার আগে ড. কামালের বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন তাঁরা। বৈঠকে সংলাপে যুক্তফ্রন্টের অবস্থান কি হবে এ নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া তাদের দাবি দাওয়া থেকে কতটুকু ছাড় দেয়া সম্ভব বা কতটুকু সরকারের থেকে আদায় করা যাবে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মোট ১০টি গাড়িতে করে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা শান্তিনগর হয়ে গণভবনের উদ্দেশে রওনা হন। প্রথমেই ছিল ড. কামালের গাড়ি, এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতাদের গাড়ি। হাসতে হাসতে কামাল হোসেনকে গণভবনে প্রবেশ করতে দেখা যায়। যদিও ফ্রন্টের দাবি দাওয়া প্রসঙ্গে আগেই ইঙ্গিত দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। নির্বাচন কমিশন ও আদালতের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের করণীয় কিছু নেই বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। বুধবার কামাল হোসেন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির ইস্যুতে বলেছিলেন, দলের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ বড়। তাই সংলাপে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বিরোধী জোটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংলাপকে কেন্দ্র করে দেশবাসীর চোখ ছিল গণভবনে দিকে। সবাই টেলিভিশন সেটের সামনে বসে সংলাপের সর্বশেষ খবর নেয়ার চেষ্টা করেন। রাজনীতির মাঠেও দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় সংলাপ ইস্যু। সঙ্গত কারণেই সংলাপ নিয়ে সবার মধ্যে ছিল বেশ আগ্রহ, উত্তেজনা। ড. কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বে সংলাপের সফলতার নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যত রাজনীতি। এ নিয়েও রাজনীতির ময়দানে ছিল নানা কথা। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপের সফলতা মানেই অন্য দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ সফল হবে এমন ধারণাও অনেকের মধ্যে। যার ধারাবাহিকতায় আজ শুক্রবার বিকল্পধারার সঙ্গে ও ৫ নবেম্বর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ হওয়ার কথা আছে। তবে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি ও নয় দফা লক্ষ্য উল্লেখ করে সংলাপের চিঠি দেয়া হলেও সংবিধান সম্মত আলোচনা হবে সরকারের দেয়া এমন শর্ত মেনেই সংলাপে যোগ দেয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট। সংলাপের শুরুতে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের ছবি নিতে সুযোগ দেয়া হয় ক্যামেরাম্যানদের। এরপর সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয়। খবর সংগ্রহে সাংবাদিকরা গণভবনের ভেতরেই অবস্থান নেন। বলতে গেলে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য \ সংলাপের শুরুতে সবাইকে সংলাপে স্বাগত জানিয়ে সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে এই অনুষ্ঠানে এসেছেন গণভবন ও জনগণের ভবনে এক গণভবনে। আপনাদেরকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্র অব্যাহত রেখেছি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে বলে মনে করি। এছাড়া এই দেশটা আমাদের সকলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি এটা বিচারের ভার আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। দীর্ঘ নয় বছর ১০ মাস হতে চলল আমরা সরকারী এই সময়ের মধ্যে দেশে কত উন্নয়ন করতে পেরেছি সেটা নিশ্চয়ই আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন এতে এটুকু বলতে পারি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভাল আছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে, দিনবদলের যে সূচনা করেছিলাম সেই দিন বদল হচ্ছে এটাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজকে সেই স্বাধীনতার সুফল যেন, প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারে সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। সংলাপ শুরুর সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডান পাশে বসেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও মঈনউদ্দিন খান বাদল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ কয়েকজন। বাম পাশে বসেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদসহ জেষ্ঠ্য নেতারা। প্রধানমন্ত্রীর ঠিক উল্টো পাশে মুখোমুখি বসেন ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যরা। উৎসুক জনতার ভিড় ॥ সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে গণভবনে একে একে আসতে থাকেন ঐক্যফ্রন্টসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রথমে আসেন বিএনপি নেতা মঈন খান। সাতটার মধ্যেই সকল নেতা গণভবনে প্রবেশ করেন। বহুল কাক্সিক্ষত সংলাপের ফলাফল জানতে বিকেল থেকেই গণভবনের সামনে ভিড় করেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। উৎসুক জনতার ভিড়ে গোটা এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। সবার মনে একটাই প্রশ্ন ছিল- সংলাপে কি হবে। প্রকৃত অর্থে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোন বার্তা আসছে কিনা। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ছিল নানা আলোচনা আর বিশ্লেষণ। রাত যত গভীর হতে থাকে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। অনেকেই নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে সেøাগান দিতে দেখা গেছে। আবার সংলাপের সফলতা কামনা করে জয় সূচক চিহ্নও দেখিয়েছেন সব দলের নেতা কর্মীরা। নেতাদের আপ্যায়ন ॥ সংলাপের শুরুতেই ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গণভবনে আপ্যায়ন করা হয়। যদিও বুধবার থেকেই ফ্রন্ট নেতারা আপ্যায়নে শরিক না হওয়ার কথা বারবার বলে আসছিলেন। গণভবন সূত্রে জানা গেছে, সংলাপের শুরুতেই নেতাদের শরবত দেয়া হয়। তারপর বিস্কুট, কাজু বাদাম, ফল পরিবেশন করা হয় নেতাদের। সবাই হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয় উভয় পক্ষের নেতাদের মধ্যে। সংলাপ শুরুর পর প্রমথ আপ্যায়ন করা হয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। এরপর আয়োজন করা হয় রাতের খাবার। ১৭ পদের খাবার দিয়ে ফ্রন্টের নেতাদের আপ্যায়ন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের বিশেষ পছন্দের খাবার চিজ কেকও মেন্যুতে রাখা হয়। গণভবন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, খাবারের মেন্যুতে আরও ছিল পিয়ারু সরদারের মোরগ পোলাও, চিতল মাছের কোপ্তা, রুই মাছের দো-পিয়াজো, চিকেন ইরানী কাবাব, বাটার নান, মাটন রেজালা, বিফ শিক কাবাব, মাল্টা, আনারস, জলপাই ও তরমুজের ফ্রেশ জুস, চিংড়ি ছাড়া টক-মিষ্টি স্বাদের কর্ন স্যুপ, চিংড়ি ছাড়া মিক্সড নুডলস, মিক্সড সবজি, সাদা ভাত, টক ও মিষ্টি উভয় ধরনের দই, মিক্সড সালাদ, কোক ক্যান এবং চা ও কফি। আওয়ামী লীগের ২৩ সদস্য ॥ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে যোগ দেন। এর মধ্যে ১৪ দলের শরিক নেতারাও রয়েছেন। সংলাপে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফরউল্যাহ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডাঃ দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং আইন সম্পাদক শ. ম. রেজাউল করিম সংলাপে অংশ নেন। ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জাসদ আরেক অংশের কার্যকরী সভাপতি মঈনুদ্দিন খান বাদল সংলাপে অংশ নেন। ঐক্যফ্রন্টের ২২ প্রতিনিধি ॥ ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আগে থেকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৬ জনের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়ার কথা চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল। সর্বশেষ ফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপে অংশ নেন ২০ জন। তবে বৃহস্পতিবার ফ্রন্টের পক্ষ থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু আরও পাঁচ জনের নামের তালিকা দুপুরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের হাতে তুলে দেন। তবে নাম থাকলেও সংলাপে আসনেনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে ফ্রন্টের নেতারা একে একে গণভবনে আসতে থাকেন। যদিও বারবারই কামাল হোসেন সংলাপের বিষয়ে আশাবাদী। বুধবার তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দলের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ বড়। আমি মনে করি সংলাপ ভাল কিছু বয়ে আনবে। কামাল হোসেনের কথায় রাজনীতি আরও আশা জেগেছে। ফ্রন্টের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ড. কামাল হোসেন। এছাড়াও প্রতিনিধি দলে ছিলেন, বিএনপি থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। নাগরিক ঐক্য থেকে, মাহমুদুর রহমান মান্না ও এসএম আকরাম। গণফোরাম থেকে মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী। জেএসডি থেকে আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক রতন, তানিয়া রব। ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মনসুর, আ ব ম মোস্তফা আমিন ও স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। নতুন আরও যুক্ত হওয়া পাঁচ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খান, জগলুল হায়দার আফ্রিক ও গণফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ও ম শফিক উল্লাহ। একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থেই নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের কথা বলে আসছেন ড. কামাল হোসেন। প্রথমে কথা ছিল বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে যোগ দেবে কামাল হোসেনের দল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টকে নিয়ে তিনি গঠন করলেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। এক পর্যায়ে বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ১৩ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে এক হয়ে গঠন করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। যদিও জামায়াত ছাড়তে তিনি বারবার বিএনপিকে শর্ত দিয়েছিলেন। একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচীতে বলেছিলেন, জামায়াত না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোন ঐক্য নয়। অথচ শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে ২০ দলে রেখেই বিএনপির সঙ্গে কামাল হোসেনের ঐক্য হয়। ঐক্য গড়ার পর থেকেই বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা অভিন্ন সুরে সরকারের কাছে সংলাপের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই সংলাপের প্রস্তাব নাকোচ করা হয়েছিল। হঠাৎ করেই রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করে। রবিবার ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপ চেয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর চিঠি দেয়া হয়। সোমবার বিকেলে ফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায়। সন্ধ্যায় বৈঠক করে সংলাপে অংশগ্রহণকারী ১৬ নেতার নাম ঠিক করেন ফ্রন্ট নেতারা। এর মধ্য দিয়ে দ্রæত দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে থাকে। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবি ও নয় দফা লক্ষ্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সংবিধানের মধ্যে থেকে আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিরোধী দলগুলোকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, এছাড়াও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা। বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার বিষয়সহ ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় আরও বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নয় দফা লক্ষ্য। এসব বিষয় সামনে রেখেই আলোচনা হয়েছে। অসাংবিধানিকভাবে কেউ ক্ষমতার পালাবদল করতে চাইলে প্রতিহত করা হবে- কাদের ॥ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করে অসাংবিধানিকভাবে কেউ ক্ষমতার পালাবদল করতে চাইলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করবে আওয়ামী লীগ।’ বৃহস্পতিবার বিকেলে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে সহযোগী সংগঠন এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের সঙ্গে যৌথ সভা শেষে তিনি এ সব কথা বলেন। সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপে ১৬ জনের প্রতিনিধি দল থাকার কথা থাকলেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছে আরও ৫ জন বাড়বে। তাদের সংখ্যা নিয়ে কোন কথা হবে না, তা আগেও বলে দিয়েছি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি সবার জন্য একই উল্লেখ করে কাদের বলেন, ‘আমরা আচরণবিধি মেনে চলব এবং অন্যকে অনুরোধ করব নির্বাচন কমিশনের নিয়ম কানুন মেনে চলার। নির্বাচন বানচাল করার জন্য চক্রান্ত বা উস্কানিমূলক কোন প্রকার কর্মকাণ্ড দেখা দিলে তাদের সকল চক্রান্তের জবাব দেবে জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ‘১৪ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপ আগামী ৪ নবেম্বর রাত ৮টায় গণভবনে অনুষ্ঠিত হবে। আজ শুক্রবার বিকল্পধারার সঙ্গে সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। ৫ নবেম্বর তারিখ জাতীয় পার্টির ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সংলাপ হবে। সিপিবি, বাম ঐক্যফ্রন্ট সংলাপের জন্য ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সময়টা খুব চ্যালেঞ্জিং উল্লেখ করে কাদের বলেন, সংলাপ হওয়ার আগে হতাশা প্রকাশের যুক্তি নেই। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমরা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত। সারাদেশে নির্বাচন উপলক্ষে ফেস্টিভ মুড বিরাজ করছে।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বিএনপির চাপের মুখে সংলাপ করছি এমন কোন পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে না। নির্বাচনের সময় যে পরিস্থিতি অন্যান্য দেশে সৃষ্টি হয় তার চেয়ে আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় সদস্য এ বি এম রিয়াজুল কবির কাওছার, মারুফা আক্তার পপিসহ অনেকে। একযুগ পর দেখা ॥ দীর্ঘ একযুগ পর মুখোমুখি হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। এ ছাড়া ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে রাজধানীর মিরপুর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কামাল হোসেনের মতবিরোধ দেখা দেয়। তিনি ১৯৯২ সালে দলের সম্মেলনের আগে দেশ থেকে চলে যান। এরপর ফিরে এসে গণফোরাম গঠন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট গঠিত হয়। শুরুতে ১৪ দলের শরিক ছিল গণফোরাম। আওয়ামী লীগ থেকে চলে যাওয়ার পর ওই সময়ে ১৪ দলের সভায় শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের দেখা হয়। ২০০৬ সালে রাজধানীর পল্টন ময়দানে ১৪ দলের সমাবেশে একই মঞ্চে বক্তব্য রেখেছিলেন শেখ হাসিনা ও ড. কামাল হোসেন। পরে আবার মতবিরোধ দেখা দিলে ১৪ দল ছেড়ে যায় গণফোরাম। এরপর শেখ হাসিনা ও কামাল হোসেনকে আর মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি। ১২ বছর পর বৃহস্পতিবার সংলাপের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ও কামাল হোসেন মুখোমুখি হলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন। ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চে ওঠার আগে ‘জাতির পিতা শেখ মুজিব লও লও সালাম’ এই ¯েøাগানদাতা ছিলেন রব। সেদিনই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলা হয়। ছাত্রলীগের ব্যানারে আ স ম আবদুর রব ডাকসুর প্রথম নির্বাচিত ভিপি। স্বাধীনতার পর আ স ম রব নতুন দল জাসদ গঠন করেছিলেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন। ১৯৯২ সালে জনতা মুক্তি পার্টি বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে বাদ পড়েন মান্না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের ব্যানারে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। নৌকা নিয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন সুলতান মনসুর। ২০০৯ সালের গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নাগরিক ঐক্যের নেতা এস এম আকরাম ১৯৯৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের আহŸায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করেছেন আইনজীবী হিসেবে। জাতির পিতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। আর সংগঠনের সহ-সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রবের স্ত্রী তানিয়া রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মোমবাতি হাতে মানববন্ধন ॥ গণভবনের ভেতরে যখন সংলাপ ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সংলাপ চলছিল তখন বাইরে মানববন্ধন করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা। তারা ব্যানার নিয়ে গণভবনের উল্টো পাশের সড়কে ফুটপাতে মানববন্ধন করেন। সংলাপ অর্থবহ করার লক্ষ্যেই এই আয়োজন বলছেন মানবন্ধনে অংশ নেয়া প্রত্যেকেই। তাদের প্রত্যেকের গলায় ছিল প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা ছিল, সঙ্কট সমাধানে সংলাপ প্রয়োজন। সংবিধান মানুষের স্বার্থে। তখন বিপরীত পাশে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জাতীয় যুব প্রক্রিয়ার নেতাকর্মীদের হাতে মোমবাতি ও ব্যানার নিয়ে ফুটপাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
×