ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ২ নভেম্বর ২০১৮

কবিতা

আবুল হাশেমের ডায়েরি থেকে [প্রীতিভাজন- কবি মোকলেস মুকুল] মাকিদ হায়দার হাশেম বাড়ি থাকে না, পালিয়ে বেড়ায় স্ত্রীর অত্যাচারে। স্ত্রী ফিল্মে নামতে চেয়েছিলো প্রস্তাবে ফেরায়নি গ্রীবা আবুল হাশেম। স্ত্রী নিউমার্কেটে গেলেই সোনার দোকানগুলো ডাকতে থাকে এদিকে আসুন আপা, আমরা দাঁড়িয়ে আছি পরশু সকাল থেকে। শামীমা কিছু না বুঝেই অর্ডার দিয়ে আসেন ঊনপঞ্চাশ, পঞ্চাশ ভরি ওজনের সীতাহার। একুশ বাইশ, জোড়া কানপাশা। লাল, নীল কোমরের বিছা। দু’পায়ের হাজার নূপুর। তার আরও আছে হাজার চাহিদা এক. নিয়মিত যাবেন তিনি সুইমিংপুলে সাঁতার শিখতে। দুই. সপ্তাহের পাঁচদিন তাকে যেতে দিতে হবে জিমন্যাস্টিকে। তিন. আজকেই কিনে দিতে হবে চাইনিজ সাইকেল। চার. বিশ্বভ্রমণে যাবেন তিনি ‘ফাস্ট কাজিনের বিয়ে’ পাঁচ. মাঝে, মাঝে নাচবেন তিনি যাত্রামঞ্চে। ছয়. হোটেলে না ঘুমিয়ে শামীমা ঘুমাবে সাইকেলের ক্যারিয়ারে। সাত. সবশেষ ইচ্ছে তার উড়ে যাবে যে কোন দিক, মধ্যপ্রাচ্যে এর পরেও আমি আবুল হাশেম, কি করে বাড়ি থাকি, আপনিই বলুন? ** হেমন্তের সন্ধ্যায় সোহরাব পাশা হেমন্ত ফুরিয়ে যায় মৃত জোছনার কুয়াশায় প্রাচীন মেঘেরা ভিড় করে মৌন সন্ধ্যার কার্নিশে রাত্রির ভূমিকা লেখা সন্ধ্যা নুয়ে পড়ে রেস্তোঁরার বিষণœ টেবিলে, পার্কের নির্জন বেঞ্চে বৃক্ষেরা ঝিমোয় হলুদ পাতার নিচে দৌড়োতে পারে না বৃক্ষ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো হয় ছোট হয় পৃথিবীর সবটুকু অন্ধকার নেভাতে পারে না সন্ধ্যার মলিন ঠোঁটের বিন¤্র আলো যেভাবে নেভে না তোমার ছায়ার অশেষ আঁধার তুমুল আলোর নিচে। ** রুমাদির সঙ্গে কলকাতায় মারুফ রায়হান রুমাদি ঢাকায় এলেন আর আমার পা ভাঙলো ভাঙা মন জোড়া লাগলো বটে পরোক্ষ কৌতুকরসে তবে ক্রাচে ভর দিয়ে কি আর তেপ্পান্ন গলি চষে ফেরা যায় তাই ছাদবারান্দায় গানের জলসা গড়ে দিলেন ঠাকুর আমরা গানে মাতলাম, কেউ কেউ পানেও কেউ বা গানের বক্ষে কানটাকে শুইয়ে আঁখি মুদলেন আর আমাদের রুমাদি ওড়ালেন অদৃশ্য রুমাল ক্রাচ ছুড়ে ফেলেই ছুটলাম কলকাতায় এইবার ঠিক আমাদের ওড়ার সাধ পূর্ণ হবে রুমাদির মতো এমন উভচর পাখি আর একটাও দেখিনি কিনা শ্রাবণপেরুনো পাটুলির মাটি থেকে তখন অবাক পাটালির গন্ধ ভাদ্র ভদ্রোচিত বর্ষণে আমাদের খানিকটা ভেজালো তারপর আকাশপ্রদীপ খুলে দিল কবিতা ও সুরসন্ধ্যা আমরা সুরা পান করলাম হাসিখুশি কিছু কবিতার আমরা সুর পুরে নিলাম অতুলপ্রসাদের, আর কোন্ ফাঁকে জাদুকরের মতো রুমাদি তার অলৌকিক ভা-ার থেকে বের করতে লাগলেন একের পর এক পুষ্পমাল্য বরমাল্য পুষ্পিত চুম্বন নক্ষত্রঅক্ষর সম্বিৎ ফিরলে নিচে তাকিয়ে দেখি ভাসছি হাওয়াসাম্পানে আর আমাদের পায়ের নিচে কলকাতার প্রাচীন আকাশ রুমাদির মায়াবী হাসির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝলমল করে উঠছে... ** মানুষ একাকী হেঁটে যায় আহমদ জামাল জাফরী মানুষ একাকী হেঁটে যায় অন্ধকারে- ঘুমের সমাধিস্থলে আকাশের প্রজ্জ্বোল নক্ষত্র রাজি ঢাকা পড়ে উন্মীলিত মেঘের ইন্দ্রজালে। প্রত্যুষের জানালাগুলো উড়ে যায় দূরগামী চোখ হয়ে নৈঃশব্দের বিভোর অন্ধকারে জেগে ওঠে হিরক মুকুট শেকড়ের বিস্তার নিয়ে আসে ফুলের উদ্ভাস, অলৌকিক আঙ্গুলের স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সমাহিত অন্ধকার। অনির্বাণ পথগুলো অনন্তর ফিরে আসে সমুদ্রে হেঁটে যাওয়া জাগর ঢেওয়ের মতো। অনুপম-স্বপ্নের পরমার্থ দিন ছায়া-রৌদ্রে-মাঠে কাছে ও দূরে ছড়িয়ে থাকে পৃথিবীর পথে পথে শিলালিপি হয়ে। পথে লেগে থাকা সোনালি ধুলোর মতো বসে থাকে ন¤্র মনস্তাপ, এ জীবন ছুঁয়ে যায় আলোর অলৌকিক-মোহর চিরজাগরুক সমুদ্রের সংগীতের মতো বিস্তৃত ডানায় ঘিরে থাকে বাতাসের গান, সমাহিত ধূসর অন্ধকারে দিগন্ত বিস্তারি প্রত্যূষের সূর্য-স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে অনির্বাণ-শিখা। ** কাছে এসো তাজউদ্দীন বাদল আশরাফ ক্রাক ডাউন ... তোমার উপর নির্দেশ ছিল পিছু না ফেরার ওদিকে পৌঁছে গেছে- ‘দিস মে বি মাই লাস্ট মেসেজ ...’ প্রিয়তমা জোহরা সন্তানের হাত ধরে বিমূঢ় তাকিয়ে ছিল তোমার চোখে চোখ রেখে, তুমি বলেছিলে- চললাম তোমরা মিশে যেও জনতার মাঝে... অতঃপর প্রিয়তমা স্ত্রীকে আলিঙ্গন না করে বাড়ালে পা রণাঙ্গনে! দীর্ঘ নয় মাস তুমি কাটালে নিরাভরণ, অথচ মহীয়সী ইন্দিরার সমুুখে দ্ব্যর্থহীন জানালে-মুজিব আছেন আমাদের সাথে ... অতঃপর অবিরাম প্রতিরোধ যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ দ্রোহের উত্তাপে অধীর নজরুল-মনসুর কামরুজ্জামান আর তুমি এক সঙ্গে হয়ে গেলে ইতিহাস- অবাক নক্ষত্ররাজি ছুটে আসে তাই মুজিব নগরের আঙিনায়... যদিও হিসেবের অধিক মূল্যে সংহত হলো আমাদের বিজয় গাথা! দিনে দিনে সন্তর্পণে বে-হিসেবী হয়ে ওঠে অন্য এক ধারাপাত- অষ্টাপদীর কর্কশ বুননে ঢেকে যায় চাঁদ, নামে কালরাত পঁচাত্তর পনরো আগস্টের হাহাকার ... হায়! নিহত পিতার শোকে সকাতর দিন রাত, তুমিও নির্বাক ঘাতকের হাতে অন্তরীণ, অসহায় ... নিরাধার এক ভোরে স্বর্গনিবাসী বাঙালীর পিতা ডেকে যায় চুপিসারে - কাছে এসো, কাছে এসো তাজউদ্দীন তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না কিছুই আমার! ** এই শহরে তোমার কেউ ছিল না শিউল মনজুর এক. মনে রেখো এই শহরে তোমার কেউ নেই, কেউ ছিল না। পিচ্ছিল কাদাপথ মাড়িয়ে যেতে যেতে তুমি বহুবার পতিত হয়েছো নগ্ন সড়কের ভগ্নভূমিতে। কেউ দেয়নি মমতার হাত বাড়িয়ে, ধীরে ধীরে নিজেই উঠেছো দাঁড়িয়ে। তোমার নির্মিত সিঁড়ি নিয়ে অনেকেই উপহাস করেছে দূর থেকে, এখনো করে তৃপ্ত চিত্তে। আমি শুধু দিনান্তের রাফখাতায় এঁকে রাখি তাদের এবড়ো থেবড়ো মুখের করুণ রেখাচিত্র। আমি শুধু বিধাতার শক্তি নিয়ে নিজের জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করি, কাউকে ডাকি না; দূরের পথে একা একা হেঁটে যাই। তখন কেউ যেন মৃদুপায়ে কাছে আসে, মৃদুস্বরে মনের আঙিনায় বলে যায়, প্রজাপতি মনে রেখো; মনে রেখো এই শহরে তোমার কেউ নেই, কেউ ছিল না! দুই. মনে রেখো এই শহরে তোমার কেউ নেই, কেউ ছিল না। রূপঝলসানো নগরের মোহে স্বপ্ন রচনা করে বাদুড়ের মতো ঝুলতে ঝুলতে কাটিয়েছো দিন-রাত। ভেবেছো, এখানেই গড়ে নেবে সোনালি খামার। ভেবেছো, এখানেই খুঁজে নেবে তোমার গৌরবের দিন। না সোনালি খামার, না গৌরবের দিন, কিছুই পেলে না। সময়ে অসময়ে তোমাকে তাড়া করেছে, বন পোড়ানো মন পোড়ানো বুনো দস্যুর দল। তুমি তাড়া খেয়ে ঘোর অন্ধকারে একা একা ঘুরেছো এপথে ওপথে! কেউ ডাকে নি উষ্ণবুকের আলিঙ্গনে। তুমি কুয়াশাচ্ছন্ন বেদনার পাহাড় ডিঙিয়ে নীরব আশ্রয়ের খোঁজে যখন ছুটে গেছো দূরে; নদীর অববাহিকা প্রাঙ্গণে, তখন একটি শিস্ দেয়া পাখি গভীর আচ্ছন্নতায় মিহিসুরে বলে গেলো, প্রজাপতি মনে রেখো; মনে রেখো এই শহরে তোমার কেউ নেই, কেউ ছিল না! ** পাহাড় সভ্যতার প্যাপিরাস সুমন শাম্স টোডা নারী ও দ্রাবিড় পুরুষের কণ্ঠস্বর জলভাসি হয়ে এলো বেতারের স্টিউডারে... তারপর, প্রতœজীবের মতো দেবে যাওয়া মানুষগুলোকে বিমূর্ত হায়ারোগ্লিফিক মনে হতে লাগলো মাটির দেয়ালিকায়। নিরাপত্তা কর্মীরা উদ্ধার করতে পারেনি ওদের মৃতভাষা! কেননা, তা অবোধ্য ছিল তাদের জন্য। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অন্যত্র পুনর্বাসনে ডাকা হলে কোনো সংকেত এলো না ওদের কাছ থেকে! কেবল শব্দ এলো, প্রবল পাহাড় ধ্বসের... প্রপিতামহের ম্যাড়া কিংবা আদিম টোটেম গাছে লেখা হয়ে গেলো শেকড় মানুষগুলোর পাদদৈশিক ইশতেহার, পাহাড় সভ্যতার প্যাপিরাস! তবুও ওরা পাহাড় বুকে বেঁচেই থাকে... ** আকাশ মরে গেছে তীব্র অনুরাগে শাহরুবা চৌধুরী আকাশ মরে গেছে আজ রাতে, একান্তে প্রহসনের পূর্ণিমা যখন দারুণ পৌষময়। রক্তে আগুন, আকাশের আরো আগে মরে যায় প্রেম আকাশ মরে যায় রাতে, প্রেম মরে দিব্যকান্তি প্রভাতে। আমাদের তুমুল প্রেম কান্না হয়ে ডানা ঝাপটায় উদ্বেলিত বাতাসে আকাশ মরে যাওয়ার আগে কিংবা পরে তীব্র অনুরাগে, বেদনায়। কাব্য করি, গল্পকথা,আকাশের সাজানো সংসার মুক্তো হয়ে ঘুরে জল, নিতান্ত অনধিকার যার।
×