ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একখণ্ড স্নিগ্ধ আকাশ

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ২ নভেম্বর ২০১৮

একখণ্ড স্নিগ্ধ আকাশ

রুশ তাত্ত্বিক বাখতিন মনে করতেন জিজ্ঞাসা এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে প্রবহমান। একটি জগত থেকে ক্রমাগত উঠে আসে অনেক জগতের আদল এবং এক জীবনের অন্তরালে অজস্র জীবনের সম্ভাবনা। প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা, অস্তিত্ব কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সমাপ্তি বলে কোন চূড়ান্ত বিন্দুও নেই। প্রতিটি উচ্চারণই সামাজিক এবং অনিবার্যভাবে সম্ভাব্যতার দিকে ধাবিত প্রচ্ছন্ন মানুষের স্মৃতিসত্তায়। তার মতে অস্তিত্ব আসলে সংগঠন, অস্তিত্বের মতো ভাষাও সংগঠন ছাড়া ব্যক্ত হতে পারে না। বাখতিনের চিন্তা অনুসরণ করে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই তা হলো সাহিত্যে কিংবা জীবনে কারও আত্মগত অভিজ্ঞতা কখনও সম্পূর্ণ, চূড়ান্ত ও সার্বিক তৃপ্তিতে সম্পন্ন হয় না, সত্তার কোন উপস্থাপনাই সত্যের সমগ্রতাকে তুলে ধরে না। বাখতিন এভাবে একই স্বরের ভেতরে বহুস্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন এবং বহুস্বরকে একই স্বরের অন্তর্বর্তী করেছেন। শিল্প সাহিত্যে একজন লেখক বা কবি যে স্বর প্রক্ষেপণ করেন প্রকাশে তা একক স্বর মনে হলেও বহুস্বরের সমন্বয়। বহু স্বর এক হয়ে বাজে আর তা সমাজে বিদ্যমান উৎসগুলোরই এক অভিজ্ঞতা, যেখানে ইচ্ছেগুলো,অভিজ্ঞতাগুলো এবং নিদানগুলো ভিন্নভিন্ন আকারে উপস্থাপিত, মৌলিকভাবে এর মিলনপর্ব রয়েছে। ‘অথচ এখন ম্লান হয়ে এল বেলা রোদ্দুর ক্রমে বিষাদিত অভিমানে তোমার চোখের সকরুণ অবহেলা আমার পৃথিবী রূপময় উদ্যানে- ম্লানতায় কেন ছায়া ফেলে দ্বিধাহীন’ এই স্বর ব্যক্তির, ‘অথচ’ দিয়ে বাক্য শুরু, বুঝে নেয়া যায় তার পূর্ব সূচনা সংযোগ আছে আর তা প্রত্যাশাময়, কাক্সক্ষার। সেটা হয়নি, যেমন বহুর আকাক্সক্ষাগুলোরও রূপ-রস চেতনা একই রূপ এবং প্রত্যেকের উচ্চারণে ভিন্নভিন্ন অবয়ব পেলেও মূল সার একই সংগঠন থেকে উৎসারিত যে ছিল প্রত্যাশিত কিন্তু তা অস্তিত্বমান নয়, ‘এখন ম্লান হয়ে এলো বেলা’ তে ‘অথচ’ কে নিশ্চিত করল হৃদয়াকুলতা যার প্রত্যাশা ছিল, সে কেবল একার নয়, সকল অস্তিত্বগুলোরই সামাজিক চাহিদা যা এক কবির স্বরের মধ্য দিয়ে বহুস্বরকে বিন্যস্ত করে এবং পরিপাশর্^কে যে অনুভব দেয় তা এমন ‘রোদ্দুর ক্রমে বিষাদিত অভিমানে’ রোদ যার উপস্থিতি আলোকময় এবং স্বাভাবিক জীবন প্রণোদনার সে বিষাদিত এবং অভিমান যেন ‘তোমার চোখের সকরুণ অবহেলা’কেই স্মরণ করিয়ে শরণার্থী করে আর বিস্ময় জাগায় এভাবে ‘আমার পৃথিবী রূপময় উদ্যানে’-/ম্লানতায় কেন ছায়া ফেলে দ্বিধাহীন’ এই ‘কোনো’ কোনো এক বিষণœতাকে সামনে নিয়ে আসে এবং যুক্ত করে সামাজিক সংকটগুলোর সঙ্গে যা থেকে উত্থিত ‘অথচ’ যে উহ্য রেখেছে এমন কিছু যা বলেনি ‘অথচ’ পরবর্তী ক্রিয়া লক্ষ্য করলেই বুঝে নেয়া যায় যে বলাটা চলমান, বিষয়টাও একটা গতিধারার মধ্য দিয়ে বহুস্বরের বিন্যাস নিয়ে উপস্থিত এবং বহুকে জিজ্ঞেস করলে একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করবে। তারপরই একটা প্রকাশ্য বাস্তবতার আবরণ ছিঁড়ে বের হয়ে পড়ে আর তা হলো ‘আমি কি ভীষণ দুঃখে কাটাই দিন’ এখানে অভিজ্ঞতার নিশ্চিতকরণে হা বা না নয়, প্রশ্ন কিংবা প্রশ্নবোধকও নয় এই ‘কি’ একটা পরিস্থিতি একটা সময় একটা অবস্থিতি এবং একটা পরিমাপের সঙ্গে যুক্ত হয়, প্রশ্ন করে এবং বিবৃতির নিজস্বতায় পরিমাপে পরিমাণগত অবস্থানকে ইঙ্গিত করে। হাইডেগার তার দর্শনে যেমন বলেন : ‘মৃত্যু সব সময় ব্যক্তির নিজের। কারও মৃত্য কেউ গ্রহণ করতে পারে না। অন্যের মরা কেউ মরতেও পারে না।’ তাই বলে কি মৃত্যুই সব, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব কিছুই কি চুকেবুকে যায়? হাইডেগার বলেন মানুষের এমন একটা কিছু রয়ে যায় যা এখনও হয়ে উঠেনি। এইটে সবসময় বাকি কিছু। এই বাকিটা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে মানুষ আর থাকে না। হাউডেগার বলেন, এই শেষ হওয়াটা যখন ঘটে সেটা এমন কিছু যা অন্য করও পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়। তিনি উল্লেখ করেন যে কোন মানুষের যা বাকি আছে তা তার নিজের। মানুষ যেদিন জন্মেছে সেদিন থেকেই সে মৃত্যুর অভিমুুখী। আর মৃণাল বসু চৌধুরী ‘প্রিয় আমার সন্ধ্যাবেলা’ কবিতায় বলেন. ‘ফিরিয়ে নে তোর উর্মিমালার কলোচ্ছ্বাস’ আবেগের ভুবন বিস্তারি এই ভ্রমণ এক বিষণœতা নিয়ে, জীবনের খেদ নিয়ে বেদনার জ্বলন্ত চুল্লি নিয়ে। এখানে অবশিষ্ট থাকে একজন মানুষ যে কেবল সকল কিছুর নীরব দর্শক তার আশা আশ^াস সব কিছু বিষাদলিপ্ত, যার আর কোন ভাগী নেই, গ্রহণ করবার লোকও নেই। কেবলমাত্র প্রকাশই হয়ে ওঠে সেই অন্য কিছু এবং অপেক্ষা সব কিছু চুকেবুকে যাবার। এই কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনাই তুমুল আকারে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু প্রতীক্ষা কবিতায় চমৎকার উপস্থিতিকে উপস্থাপিত করেছেন কবি, যেমন ‘মাঠের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে খুব জোরে হাততালি দিল/তারপর জ্যোৎস্নায় নির্জন বৃত্তের গায়ে/মাথা রেখে প্রতিধ্বনির/অপেক্ষা করল সারা রাত।’ এই হলো একটা কিছু থেকে যাওয়া বা আছে। মানুষ ধ্বংস হবার নিমিত্ত নিয়ে জন্মায় না, এইখানে তার সমাজ বিজয়, বিজয়ই তার অভীষ্ট। ০২. স্বপ্নের গতি এক রৈখিক নয়, নানাভাবে নানা কিছু প্রতীক আকারে যেমন উপস্থিত হয়, তেমনি কবি মনক্রিয়া শব্দের মৌলিক অর্থকে প্রতীকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন নির্মাণে। এজন্য প্রাচীনকালের এমনকী গোষ্ঠী জীবনের বিশ^াস অবিশ^াস লোকনির্মাণ প্রতীক আকারে কবিতায় উপস্থিত হয়। পাঠকের নিবিষ্টতা না থাকলে- যেমন স্বপ্ন প্রসঙ্গে ধারণা না থাকলে স্বপ্নের আগাম সংবেদ, সংবেদিত নির্দেশ যা ব্যক্তিমনের অচেতন থেকে উঠে আসে তা উপলব্ধিতে ব্যক্তি অপারগ হয় বিপর্যয় ঘটে তেমনি কবিতার গঠিত চিন্তা¯্রােত যা কবির অচেতন মন থেকে চেতনায় যে আলো ফেলতে চায় তাও বুঝতে ব্যর্থতা থাকলে যে বিপর্যয়ে পাঠক পড়েন তা থেকে কবিতার প্রতি পাঠকের অনীহাও তৈরি হতে পারে। হঠাৎ কখন ঘূর্ণিঝড়ে উড়ল তোমার মুখ/সদ্য পরিচিতার সঙ্গে বদল হলো সুখ/জানাগুলো বন্ধ ছিল, হঠাৎ গেল খুলে/গোপনে কেউ রাখল দু-হাত ছিন্ন হৃদয় মূলে/আমি নিজেকে দিই ফাঁকি/না, তাকেই কাছে ডাকি/যাবার আগেই জড়িয়ে গেছি মহৎ একটি ভুলে/সত্যি কি কেউ রাখল দু-হাত ছিন্ন হৃদয় মূলে ‘ছিন্ন হৃদয়মূলে’ হৃদয় ছোঁয়া এই পঙ্ক্তিমালা পরিমিত পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত এক বর্ণাঢ্যতা নিয়ে পাঠকের হৃদয়কে আপ্লুত করে এবং প্রচলিত ও অপ্রচলিত ধারণার বাইরে এমন একটি অনুভূতির জগত তৈরি করে যা অনুভবের মধ্য দিয়ে জাগায় ‘হৃদির অনুভব’। আবার বসু বলেন : পবিত্র ধমনী জুড়ে/ছায়াময় নদী আর/অন্তরঙ্গ নিজস্ব নীলিমা/ছাড়া/কিছুই স্বপক্ষে নেই /তাই বসে আছি/নীরব শুভেচ্ছা নিয়ে বসে আছি-’ মিল আর অমিলটা তুল্যমূল্যে বুঝে নেয়া যায়। মৃণাল বসু চৌধুরীর নির্বাচিততে রয়েছে আরও অনেক কবিতা এবং চমৎকার পঙ্ক্তিমালা। তবে একটা কথা কী, কবিতা এ সময়ে আমাদের চেনা পথকে অতিক্রম করে আকারে প্রকারে রূপে রসে প্রকাশে বুদ্ধির দিপ্তীতে সৃজনে ও নির্মাণে বদল করে নিতে পেরেছে তার পথ, চৌধুরীর বিষয়ে বৈচিত্র্যতা থাকলেও নির্মাণ রীতিতে নতুনের ছোঁয়া প্রবল হয়ে লাগেনি। জীবন এখন অন্তরগত নয় জীবন বহির্মুখী তাই কবিতাও দাবি করে নতুন সম্ভাবনা। কবিতার ভাষা ও বাস্তবতা প্রসঙ্গে কবি ও প্রাবন্ধিক কুমার চক্রবর্তীর প্রবন্ধের একটি লাইন উল্লেখ করে আলোচনায় ইতি টানব। তিনি বলেন, ‘কবিতা নিয়ে যখন আমরা ভাবি, আমাদের ভেতরে এক গোপন ও অন্তর্গূঢ় পরিবর্তন ঘটতে থাকে’ সত্যি তাই।
×