ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের সীমানায়

প্রকাশিত: ০৭:১০, ২ নভেম্বর ২০১৮

গল্প ॥ স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের সীমানায়

সেই সকাল থেকেই এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে আছে সালমা। এখানে সে একাকী বসে নেই। তার সঙ্গে আরও ১৪ জন বিভিন্ন বয়সী নারী বসে আছে। তারা সবাই বাঙালী। সবার গন্তব্য বাংলাদেশ। সালমা কিংবা তার সঙ্গের অন্য নারীদের কারও মুখে কোন শব্দ নেই। সবাই খুব চুপচাপ, বিমর্ষ। সারা শরীর কালো বোরখায় আবৃত থাকলেও তাদের বিমর্ষ কিংবা অস্থিরতা ভাব আড়াল থাকছে না। তাদের চেহারার স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে তাদের কেউ কেউ আবার বড় বড় দীর্ঘশ^াস ফেলছে জমে থাকা হতাশা, দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনার অনুভব থেকে। সরকারী শেল্টার হোম থেকে একটি বাসে করে এনে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের ১৫ জন নারীকে। বিভিন্ন অভিযোগে তাদের সবাই গত বেশ কিছুদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ছিল। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে অবশেষে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। শেল্টার হোমে চারদিন ছিল তারা সবাই। ওখানে তাদের প্রত্যেককে পরার জন্য নতুন জামা-কাপড় এবং বোরখা দেয়া হয়েছে, যা পরে তারা দেশে ফেরত যাওয়ার অপেক্ষায়। বসে আছে, ব্যস্ত এয়ারপোর্টের এক কোনায় পেতে রাখা কয়েকটি স্টিলের লাউঞ্জ সিটে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বাইরের উত্তপ্ত মরু হাওয়ার আঁচ অনুভব না করলেও এখানে বসে থাকা ১৫ জন নারী তাদের স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণার আগুনে পুড়ছে ভেতরে ভেতরে। অনিশ্চিত আরেক জীবনের দিকে আবার ফিরে যাচ্ছে তারা সবাই। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়ছে তারা। শূন্য হাতে দেশের ফেরার কথা ভাবতে পারেনি তারা কেউই। দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আপনজনদের ছেড়ে সৌদি আরবে এসেছিল কত- না খাটাখাঁটুনি করে। কিন্তু এখানে পা রাখার পর থেকে দিনে দিনে তাদের সেই স্বপ্ন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। সালমা বাংলাদেশ ছেড়ে সৌদি আরব এসেছিল এক বছরও পুরো হয়নি। বাড়ির সবাই জানে দুই বছর বিদেশে কাটিয়ে তারপর ফিরবে সে। হাউসকিপারের চাকরি নিয়ে এসেছিল সে। এক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এখানে তার আসা। এ জন্য অবশ্য খুব বেশি টাকা পয়সা খরচ করতে হয়নি তার। দেখতে সুন্দরী বলে এজেন্সির লোকজন বেশ খাতির যতœ করে আসার আগে। ১৫ দিনের ট্রেনিং করতে হয়েছে অন্যান্য অনেক মেয়ের সঙ্গে। ট্রেনিংয়ের সময় এজেন্সির লোকজন আশ্বস্ত করে বলে তোমার খুব ভাল একটি চাকরি হয়েছে, তোমার বেতনও অন্যদের চেয়েও বেশি। আমরা তোমার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলাম। সৌদি আরবে যে বাড়িতে কাজ করবে তারা তোমার ছবি আর ভিডিও দেখে নির্বাচন করেছে তোমাকে। তারাই তোমার বেতন নির্ধারণ করেছে তুলনামূলক বেশি করে। সালমা, তোমার কপালটা অনেক ভাল, এই বলে তারা বাহবা দেয়। রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজনের কথায় মনটা ভরে যায় সালমার। আশা জাগে সোনালি নতুন জীবনের। গরিব বাবা মায়ের সংসারে অনেক দুঃখ-কষ্টে বেড়ে ওঠা মেয়েটি ভাবত, বিয়েশাদি হয়ে গেলে স্বামীর সংসারে গিয়ে সুখে দিন কাটাবে। অভাব দুঃখ-কষ্টের বোঝা বইতে হবে না আর। স্বামীর আদর ভালবাসার পাশাপাশি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে সংসারে। তার মতো সুন্দরী যুবতী নারী কর্মীকে পেয়ে এজেন্সির লোকজন বেশ খুশি হয়। কারণ সৌদি আরব, জর্দান, লেবানন, কাতার, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সুন্দরী অল্প বয়সী নারী কর্মীর বিশেষ চাহিদা রয়েছে; যদিও এ বিষয়টি নিয়ে এজেন্সির লোকজন মুখ খুলে না সহজে। বিদেশে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যেতে আগ্রহী মেয়েদের মধ্যে সুন্দরী এবং অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ একটু বেশি। বিদেশী নিয়োগ কর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী কম বয়সী সুন্দরী গৃহকর্মী পাঠাতে পারলে বেশি কমিশন পাওয়া যায় বলে তাদের আগ্রহটা বেশি থাকে। ছেলে সোহাগকে ভালভাবে লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভাল স্কুলে পড়াতে হলে অনেক টাকা পয়সা দরকার। দেশে গার্মেন্টসের চাকরি করে দু’বেলা কোন রকম খাবার জুটে, এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার কিংবা করার সুযোগ নেই। বিদেশে মেয়েদের চাকরি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আগে তেমন শোনা না গেলেও আজকাল অনেক মেয়েই চাকরি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে জেনেছে সালমা। বিদেশের চাকরিতেও অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু বিনিময়ে বেশ ভাল আয় হয়, যা দিয়ে পরিবারের সব খরচ চালিয়েও টাকা-পয়সা জমানো যায়। গ্রামের অনেক মানুষকে সৌদি আরব, দুবাই, কুয়েত, কাতারে চাকরি করে বাড়িতে পাকা বিল্ডিং করতে দেখেছে। তাদের জমিজমার পরিমাণও বেড়েছে দিনে দিনে। সালমাও তেমন ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়। একদিন তাই উড়াল দেয় সে আরব দেশে। সালমার সৌদি নিয়োগ কর্তার বাড়িটি বেশ বড়। কয়েক তলার বাড়িতে লোকজন তেমন বেশি নেই। বাড়িতে যাওয়ার পর সালমাকে দামি সুগন্ধী সাবানসহ নতুন জামা কাপড় দিয়ে ভালভাবে গোসল করে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বলা হয় তাকে। সালমার থাকার জন্য যে ঘরটি দেয়া হয় সেটি খুব বেশি বড় না হলেও মোটামুটি সুন্দর। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরও তার দু’চোখে ঘুম আসে না। বার বার সোহাগের কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেটি এখন মধুপুর গ্রামের বাড়িতে কিভাবে আছে? কি করছে? কে জানে? মায়ের কথা কি ভাবছে সে? ঘুমিয়ে পড়েছিল সালমা। তখনই দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলতেই ভিনদেশী অচেনা এক নারীকে দেখতে পায় সে। ইশারা ইঙ্গিতে সেই নারী জানায়, সেও তার মতো একজন গৃহকর্মী। নাম কণিকা, ভারত থেকে গেছে। এই বাড়িতে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে। মালিকের খুব বিশ^স্ত। এখানে তিন চারজন গৃহকর্মী নারী রয়েছে। তাদের সবার কাজকর্মের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়াসহ তাদের দেখভালের দায়িত্বও তার ওপর দেয়া হয়েছে। কণিকা সালমাকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখায়। তার কী কী কাজ করতে হবে বুঝিয়ে দেয়। বেশ আগ্রহ নিয়ে তার যা যা করতে হবে বুঝে নেয় সালমা। সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কাজের ব্যস্ততায় সব ভুলে যায় সালমা। বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে মরুভূমির দেশে এসেছে সে চাকরি নিয়ে। এখানে কাজকর্ম করে নিজের ভাগ্যের চাকা বদলাতে চায়। সন্তানের জন্য সুন্দর জীবন গড়ে দিতে চায়। দিন শেষে কর্মক্লান্তি নিয়ে নিজের থাকার ঘরটিতে ফেরার পর দেশের কথা, বাড়ির কথা, সন্তান সোহাগের কথা বাবা মায়ের কথা খুব মনে হতে থাকে। বাড়িতে তারা সবাই নিশ্চয়ই সালমার কথা ভাবছে। বাড়ির সবার সাথে কথা বলতে মনটা অস্থির হয়ে ওঠে তার। কিন্তু সঙ্গে মোবাইল ফোন না থাকায় ফোন করা হয়ে ওঠে না আর। সালমা গতকাল নিয়োগ কর্তার যুবক বয়সী ছেলের ঘরের বিছানার চাদর বদলাতে গিয়েছিল। ছেলেটি বয়সে তার চেয়ে ছোট হবে। কিন্তু লাম্পট্যে সেরা। একাকী নিজের কাজকর্ম সারছিল সালমা। হঠাৎ বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সালমাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেটি। তার এমন ব্যবহারের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। যদিও এ বাড়িতে আসার পর গত এক মাসে সঙ্গের অন্যান্য গৃহকর্মী মেয়েদের কথাবার্তায় জেনেছে। জেনেছে যে এদেশে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতে আসা বিভিন্ন দেশের মেয়েদের মালিকের মন জুগিয়ে চলতে হয়। তাদের ইচ্ছেমতো না চললে অসুবিধা। মালিকের কোনো কাজে বাধা দিলে তারা পশুর মতো হিংস্র আর নির্মম হয়ে ওঠে। এখানে চাকরি করতে হলে নীরবে সব মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। প্রতিবাদ করলেই চুরি কিংবা অন্য কোন গুরুতর অভিযোগ এনে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এভাবে অনেক মেয়ে প্রতিবাদ করে চাকরি হারিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে গেছে। যারা চাকরি করছে বিভিন্ন বাড়িতে তাদের প্রায় সবার অবস্থা একই রকম। কণিকার কাছে বিষয়টি জানায় সালমা। এর কি কোন প্রতিকার নেই, জানতে চায়। কণিকা তার কথায় কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর বলে, ‘তুমি এখানে এসেছ কেন, তোমার ছেলে সোহাগকে মানুষ করতে অনেক টাকা পয়সা দরকার। সেই টাকার জন্যই তো তোমার আসা। যারা তোমাকে সেই টাকা দেবে তাদের বিরুদ্ধে যেতে চাও তুমি, তাহলে কি তুমি এখানে থাকতে পারবে? একবার ঠা-া মাথায় চিন্তা কর, আমি এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’ কণিকার কথায় হতাশা আর দুঃখ ঘিরে ধরে সালমাকে। সে ভেবেছিল কণিকা হয়ত তার সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তার বদলে মালিক পক্ষের ইচ্ছের বলি হওয়ার ব্যাপারে তাকে নসিহত করছে। তা না হলে চাকরি হারিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে হবে। এখানকার অলিখিত নিয়ম এটা, তার কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে কণিকা। মালিকের কিংবা ছেলেদের বা ভাইয়ের ঘরে তাৎক্ষণিক ফাইফরমাশ অনুযায়ী কাজ করে দেয়ার পরও তাদের অবাঞ্ছিত অশালীন আচরণ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে দিনে দিনে। এখানে চাকরি টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের কথামতো কাজ করতে হবে, ইজ্জত সম্মান খোয়ানোর কথা ভাবতেই সারা শরীর ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। একপর্যায়ে দিশেহারা হয়ে ওঠে সালমা। এ জন্যই কি সৌদি আরব এসেছিল সে, এর জবাব ভেবে পায় না। ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সালমা জেনে এসেছে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি সৌদি আরব। যেখানে প্রতিবছর গোনাহ মাফের জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে লাখ লাখ মুসলমান ভিড় করেন, হজ শেষে নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরে যান এখান থেকে। সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে এ কারণেও বেশ খুশি হয়েছিল সালমা। মানুষ কত টাকা পয়সা খরচ করে সৌদি আরব হজ করতে যায়। সেই পবিত্র ভূমিতে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করেছিল সে। কিন্তু এমন ঘটনার ফলে সে দারুণ একটা হোঁচট খায়। পবিত্র আরব দেশ সম্বন্ধে তার আগে ধারণা আমূল বদলে যায়। এখন সে কী করবে ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে পড়ে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে তার মতো একটা সাধারণ মেয়ে কী-বা করতে পারে। মালিকের কথামতো কাজ করলে বা তাদের অপকর্মের কোনরূপ প্রতিবাদ করলে চাকরি থাকে না, এ নিয়ে বাইরে কোথাও অভিযোগ করলেও কোন সুরাহা মেলে না। গৃহকর্মীদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর কেউ নেই এখানে। কেউ কোন সাক্ষী দেয় না নির্যাতিত গৃহকর্মীর পক্ষে। মালিকের বিরুদ্ধে বাইরে কোথাও অভিযোগ জানানোর ফল একটাই, চাকরি হারানো। বরং সেই সঙ্গে চুরি কিংবা গুরুতর কোন অভিযোগে পুলিশের কাছে সোপর্দ হওয়ার ভয়। কেউ হয়ত অভিযোগ করে, প্রতিবাদ জানায়, মালিকের তা-ব লালসার বিরুদ্ধে কিন্তু এরপর তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না আর। বিদেশ-বিভুঁইয়ে চরম অসহায়ত্ব এবং প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা এক রকম অসম্ভব। চাকরি হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না সালমা। মনের সঙ্গে কয়েক দিন অনেক যুদ্ধ করে। দেশে একমাত্র সন্তান সোহাগকে রেখে এসেছে। তাকে মানুষ করে তুলতে কত টাকা পয়সা দরকার। সেই টাকা জোগাড় না করে দেশে ফিরে যাবে কীভাবে, কোন সাহসে? অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে এদেশে এসেছে সে। এরপর দেখতে দেখতে কয়েকটি মাস কেটে যায়। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়ে জীবনস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয় সালমা। সে দেখতে চায় নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যায়। নিজের ওপর মাঝে মাঝে ভীষণ ঘৃণা জাগে। নিজের রূপ-যৌবনকে আশীর্বাদের বদলে চরম অভিশাপ মনে হতে থাকে তার। সৌদি নিয়োগ কর্তার বাড়িতে প্রতিরাতে লাম্পট্যের বর্বরতার নতুন নতুন উদাহরণ প্রত্যক্ষ করতে করতে এই পবিত্র ভূমি আসল রূপটি তার সামনে খুলে পড়ে। এখানকার মানুষগুলো অর্থবিত্তের জোরে প্রভাব খাঁটিয়ে পবিত্র ভূমিকে এভাবে অপবিত্র করছে। জঘন্য পাপ করে বেড়াচ্ছে, ঘরে ঘরে অসহায় নারী গৃহকর্মীদের তা-ব লালসা পূরণের কাজে ব্যবহার করছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না, তাদের অন্যায়ের প্রতিকার হচ্ছে না কোনভাবেই। পরিস্থিতি চাপে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেও এক ধরনের অপরাধবোধ সালমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তার কিই-বা করার আছে। একদিন কাজ করার সময় হঠাৎ তার মাথা ঘুরে ওঠে। সারা শরীর টলতে থাকে। ভীষণ বমি ভাব লাগে। ছুটে যায় নিজের ঘরে। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। এ রকম শরীর খারাপ লাগেনি তো আগে। মনে পড়ে যায়, সোহাগ পেটে আসার পর সেই দিনগুলোর কথা। তখনও তেমন শরীর খারাপ লাগত। তাহলে কি সালমা আবার সন্তানের মা হতে চলেছে? ব্যাপারটা ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে তাকে। কী করবে এখন সে, ভেবে কূল পায় না। কণিকাকে নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানায় সালমা। অসুস্থতার লক্ষণ শোনার পর কণিকার কপালে কিছুটা ভাঁজ পড়ে। তাকে অনেকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হয়। সে কিছু বলে না, সালমাকে বিশ্রাম নিতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অসুস্থতার কারণে কয়েক দিন কোন কাজকর্ম না করে নিজের ঘরে শুয়ে নয়ত একাকী বসে থাকে সালমা। কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তার। তার পরও কণিকা তার জন্য খাবার-দাবার নিয়ে আসে। সালমাকে কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে দেখানোর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না তাদের মধ্যে। ডাক্তারের কাছে না গেলেও সালমা টের পায়, মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। ক্রমশ তার গর্ভে বেড়ে উঠছে মালিকের পরিবারের পুরুষগুলোর তা-ব লালসার ফসল। সালমাকে বিভিন্ন দিন বিভিন্ন পুরুষের ঘরে যেতে হতো। কোন দিন মাঝ বয়সী বাবার ঘরে আবার কোনদিন যুবক ছেলে কিংবা ভাইয়ের ঘরে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পুরুষগুলো সালমার ওপর চড়াও হয়েছে অনেকবার। এভাবেই সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে তার। নিজের সর্বনাশ টের পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে সালমা। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। কণিকার নিস্পৃহভাব তাকে অস্থির করে তোলে। একসময় সালমা কণিকার পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এ অবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য মিনতি জানায়। কণিকা চাপা গলায় জানায়, ‘আমার কিছুই করার নেই, তোমাকে যদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই আর মালিক যদি তা জানতে পারে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে আর তোমাকে মেরে ঠিক গুম করে ফেলবে। কেউ কিছুই করতে পারবে না তাদের।’ এভাবে আরও বেশ কয়েকটি দিন কেটে যায়। কণিকা তার জন্য কিছুই করবে না বুঝে নেয় সালমা। যা করার তার নিজের করতে হবে, সিদ্ধান্ত নেয় সে। একদিন তাই সাহস সঞ্চয় করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির খোঁজে। তার ওপর মালিক পরিবারের পুরুষদের বারবার চড়াও হওয়ার কথা এবং এর ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়ার বিষয়টি জানিয়ে এর বিচার চাইবে সৌদি পুলিশের কাছে। দিগি¦দিক হুঁশ হারিয়ে মরিয়া হয়ে ছুটে সালমা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় অনেকটা পথ চলে আসে। এখানকার পথঘাট, থানা পুলিশ কিছুই চেনে না সে। তবু সে জিদ করে খোঁজাখুঁজি করতেই থাকে। ওদিকে মালিকের বাড়িতে হুলুস্থ’ূল পড়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া গৃহকর্মী সালমাকে না পেয়ে মালিক পক্ষের মেজাজ বিগড়ে যায়। কোন চুলোয় গেল কাজের মেয়েটা। তারা সঙ্গে সঙ্গে দলবলসহ গাড়ির বহর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সালমার সন্ধানে। গাড়ি নিয়ে চষে বেড়াতে থাকে আশপাশের সব জায়গা আর অলিগলি। থানায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেশ করার আগেই যাতে মেয়েটাকে আটকানো সম্ভব হয়। তারা সফল হয় এক্ষেত্রে। স্থানীয় থানায় যাবার আগেই তাদের হাতে ধরা পড়ে যায় বাঙালী যুবতী সালমা। বেচারি থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সুযোগ আর পায় না। একসময় তাদের গাড়িগুলো দেখে চিনতে পেরে ভয়ের চোটে সালমা লুকোতে চেষ্টা করছিল। তখন সে দৌড়ে তাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এখানকার পথঘাট, জনপদ সবই তার অচেনা থাকায় ছুটে পালাতে চেষ্টা করলেও বেশিক্ষণ আড়াল রাখতে পারেনি নিজেকে। সালমার দৌড় আর কদ্দুর হবে, এটা জানত যেন মালিক পক্ষ। একপর্যায় তারা সালমাকে ধরে ফেলে এবং গাড়িতে জোর করে তুলে সোজা বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এনে মালিকের লোকজন বেদমভাবে মারতে থাকে অসহায় সালমাকে। মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলে তার শরীর। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে সে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে থাকে সালমা। বীভৎস আর্তনাদ করতে থাকে নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে। তার আর্তনাদ, কান্না বিরাট অট্টালিকার বাইরের কেউ শুনতে পায় না। কেউ জানতে পারে না একজন মেয়ের দুরবস্থার ঘটনা। বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই এক অসহায় বাঙালী নারীর আর্তনাদ, কান্না চাপা পড়ে যায়। বাঙালী গৃহকর্মী সালমা বেগম অনেক মূল্যবান গয়নাগাটি, নগদ অর্থ চুরি করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে হাতেনাতে। পালাতে চেষ্টা করে রাস্তায় পড়ে আহত হয়েছে। এমনভাবে ঘটনা সাজিয়ে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করে সালমার নিয়োগ কর্তা। টেলিফোনে অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় থানা থেকে কয়েক পুলিশ ছুটে আসে বাড়িতে। মালিক পক্ষ তাকে চোর সাজিয়ে নিজেদের সব অপকর্ম আর অপরাধ আড়ালের চেষ্টা করে এবং সফল হয়। সালমাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে তারা। সালমা চিৎকার করে পুলিশকে বলতে থাকে, ‘বিশ^াস করেন স্যার, আমি চোর না, আমি কিছু চুরি করি নাই, আমি এই বাড়িতে কাজ করতে আইছিলাম চাকরি নিয়া, সারাদিন অনেক কষ্ট করতাম, সব কাজকর্ম করতাম, কিন্তু তারা আমার সর্বনাশ করছে, চরম সর্বনাশ করছে। আমার ইজ্জত লুটছে, আমি বাধা দিছি কত। হেরা আমারে চাকরি থিকা বাইর কইরা দেওনের ভয় দেখাইয়া প্রত্যেক রাইতে জোর কইরা যা মনে চাইত তাই করত। আমি হেই কথা জানাইতে আপনাগো কাছে যাইতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারি নাই, হেরা আমারে রাস্তা থিকা ধইরা আইন্যা অনেক মারছে। মারতে মারতে রক্ত বাইর কইরা ফেলাইছে, এখন আমারে চোর বানাইয়া ধরাইয়া দিতাছে আফনেদের কাছে। আমার কথা বিশ^াস করেন ভাই, আল্লাহর দোহাই লাগে। হেরা যে অপরাধ করছে, আমার ইজ্জত লুটছে তার বিচার করেন। এই দ্যাশে আমাগো নবীজি জন্ম নিছিলেন, এই দ্যাশে মাটি অনেক পবিত্র মনে করতাম, কিন্তু এখানকার মানুষগুলা এত্ত খারাপ হইয়া জানতাম না। এইখানের পবিত্র মাটির ওপর এত্ত আকাম চলতেছে, আমি আগে যা ভাইবা এই দেশে আইছিলাম এখন দেখতেছি এগুলা হাছা না। পাপে পাপে নষ্ট হইয়া গেছে এইখানের মাটি। এই অন্যায় আল্লায় সহ্য করব না, ভয়ানক গজব পড়ব। আমি অভিশাপ দিতেছি, সব ধ্বংস হইয়া যাইব গা।’ সালমার এই আবেদনভরা ক্ষোভ মিশ্রিত কথাগুলো সৌদি পুলিশকে প্রভাবিত করে না মোটেও। পুলিশ সদস্যরা তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় থানায়। সেখানে নিয়ে আটকে রাখে দু’দিন। নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সালমা থানায় আসার পর থেকে নির্বাক হয়ে গেছে। তার ওপর এতবড় অন্যায় হলো অথচ কোন সুবিচার পেল না সে। যে দেশটিকে মুসলমানরা পবিত্র তীর্থভূমি বলে জানে সেই আরব দেশে এহেন অবিচার। এ রকম কত যে জুলুম-অত্যাচার চলছে অসহায় মানুষের ওপর নিয়ত ঘটছে সেখানে তার খবর কেই-বা রাখে। এমন সব ভাবনা ভেবে মুষড়ে পড়ে তখন সালমা। সেখান থেকে সোজা শেল্টার হোমে পাঠানো হয় সালমাকে। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কয়েক কর্মকর্তা আসেন শেল্টার হোমে থাকা বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে। অন্যান্য সবাই তাদের নানা অভাব অভিযোগ জানালেও সালমা কিছুই বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। তার কোন অভিযোগ আছে কি না জানতে চান একজন দূতাবাস কর্মকর্তা। জবাবে কী বলবে সে? তার ওপর যে এতবড় অন্যায় অবিচার হয়েছে তা আগেই পুলিশের কাছে বলতে চেষ্টা করেছে। তখন কেউ তার অভিযোগ শোনেনি। বরং তাকে চোর সাব্যস্ত করে লাঞ্ছিত করেছে। এখন বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকজনদের কাছে আসল ঘটনা খুলে বললেও তারা কিছুই করতে পারবে না; কারণ, সৌদি সরকার এর মধ্যেই তাকে অপরাধী বিবেচনা করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো নির্দেশ জারি করেছে। সৌদি আরবে থাকার কিংবা চাকরি করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে সালমা সেই নির্দেশের কারণে। দাম্মাম এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা সৌদি এয়ারলাইন্সের বড় বিমানটিতে এর মধ্যে সব যাত্রী চড়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের শাহজালাল বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। সালমা এবং তার সঙ্গের অন্য মেয়েগুলো বিমানে যার যার সিটে বসে আছে আনমনা হয়ে। বাংলাদেশে যাবার পর তার কী হবে, কোথায়, কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে সে। তার গর্ভবতী হয়ে পড়ার ব্যাপারটি কেউ সহজভাবে মেনে নেবে না। পাড়া-প্রতিবেশী গ্রামবাসী আত্মীয়স্বজনদের সামনে গিয়ে মুখ দেখাবে সে কেমন করে? তার নিজের পরিবারের লোকজনও ব্যাপারটি গ্রহণ করবে না। নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে কী জবাব দেবে? সে একজন বিধবা নারী অথচ এখন সে সন্তানসম্ভবা। এই সর্বনাশের জন্য তাকেই অভিযুক্ত করবে সবাই। তাকে দিবে ধিক্কার। তার নামে কুৎসা রটাবে। পদে পদে সে অপমানিত হবে। কেউই সহানুভূতি বা সমবেদনার ছিটেফোঁটাও জানাবে না। শিক্ষিত না হলেও সালমা তা ঠিক বুঝে ফেলে। প্লেন থেকে নেমে তাহলে কোথায় যাবে সে, এ কথা ভাবতে তার চোখে নেমে আসে পানি। স্বপ্ন ডানায় ভর করে অনেক আশা নিয়ে অর্থবিত্তের দেশ পুণ্যভূমি সৌদি আরব গিয়েছিল। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সমাজের কাছে পরিবারের কাছে সে এখন কলঙ্কিনী, দুশ্চরিত্রের নারী। এই অপবাদ নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকবে সে কীভাবে? কিন্তু তার গর্ভের সন্তানটি বেড়ে উঠছে ক্রমেই। ওটা ফেলে দিয়ে জঞ্জালমুক্ত হওয়ার কথা ভাবলেও একসময় খেয়াল হয় এর মধ্যে বেশ অনেক মাস হয়ে গেছে। এখন গর্ভপাত করাতে গেলে যে তার নিজেরই বড় ধরনের বিপদ হতে পারে এটা- এ কারণে এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে, এইটুকু বোঝার ক্ষমতা তার আছে।। কিন্তু তার আরেক সন্তান সোহাগকে অসহায় এবং একাকী রেখে পৃৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায় না সালমা। প্লেন ল্যান্ড করে একসময় ঢাকার মাটিতে। বিরাট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সালমা। প্লেন থেকে নেমে বিমানবন্দরের লোকজনের ভিড়ে পরিচিত কাউকে দেখতে পায় না সালমা। মনটা খারাপ হয়ে যায় আরও। হঠাৎ খেয়াল হয় তার দেশে ফিরে আসার কথা তো পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনদের কেউ জানে না। এখন তার হাতে তেমন টাকা পয়সাও নেই। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তার দেয়া কিছু টাকা পয়সা আছে সঙ্গে, যা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে হয়তবা যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ অবস্থায় বাড়ি যাওয়া নিয়ে দ্বিধা। তাই যাবার কথা ভাবতে ভাবতেই বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সালমা আনমনা হয়ে হাঁটতে শুরু করে- অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দুঃস্বপ্নের ভয়ঙ্কর ঘোরে পথ চলতে থাকে সে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাজধানী ঢাকার বিশাল জনারণ্যে মিশে যায় সালমা নামের এক চির দুঃখী মেয়ে।
×