ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জহুরুল ইসলাম

প্রেম ও নিসর্গের কবি

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ২ নভেম্বর ২০১৮

প্রেম ও নিসর্গের কবি

একটি তীক্ষ্ন টিল বিদ্ধ করে মনের অতলে যদি কেউ ভেবে দেখে কি হয় সেখানে... (বেদনার মন) এই দুঃখের কারখানার কারিগর কবি ওমর আলী বাংলা সাহিত্যের একটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, অন্ধকারের জ্যোতি। শব্দের কারিগর, কাব্য নির্মাতা। নির্ভেজাল, নিরহঙ্কার। সাদামাটা, মাটির মানুষ। স্বল্পবাক নিভৃতচারী কবিতা প্রেমিক। তাঁর আত্মবিশ্বাসী অভিমানী মন- ধুলা মাটিতেই ছিল নিত্য বসবাস। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর আর কখনও ওমুখো হননি। সব ফেলে, সব কোলাহল ছেড়ে ফিরে আসেন ঘরে। কি জানি, কি অভিমানে! তিনি ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক। সবশেষে পাবনা সরকারী শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে অধ্যাপনার সময় ১৯৯৯ সালের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সে সময়েই বুলবুল কলেজের উত্তর পাশে এক কামরার একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। অবশ্য সেখানে তিনি রাত কাটাতেন না, দিনে এসে থাকতেন। ঘরের আসবাবপত্র বলতে চেয়ার টেবিল আর দু’খানা বেঞ্চ। সেগুলোও ছিল বইয়ের দখলে। সারা ঘরময় ছিল বই আর বই। সেটা ছিল ওমর আলীর বইয়ের সংসার। ওখানে তিনি পড়তেন, লিখতেন এবং পড়াতেন। সেখানে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বসতে দেয়ার জায়গা পেতেন না। বই সরিয়ে বসতে দিতেন। তিনি ছিলেন কবিতার প্রকৃত পাঠক। জীবনানন্দ দাশ, অমীয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন প্রভৃতি কবিদের রচনা প্রচুর পড়তেন। জীবনান্দ দাশের কবিতা তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’-এর আদলে লিখেছেন- ‘জিনিয়া হোসেন’- ‘এই যে শুনুন, আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি, বুঝলেন- জোনাকির মতো দুটি চোখ তুলে বললেন জিনিয়া হোসেন। চুল তার সুচিকন কচুরি পানার কালো শিকড়ের মতো শ্যাম্পু করার ফলে ফুরফুরে বাতাসে উড়ছে অবিরত... (শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃঃ ৪৯৫) প্রেম ও নিসর্গের কবি ওমর আলী। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন মানবীয় প্রেম ফুটে উঠেছে অন্যদিকে নিসর্গের চিত্র ধরা দিয়েছে অনায়াসে- উন্মুক্ত সবুজ মাঠ, বুনো ঝাউ, শয্যার মতন ঘাস, অরণ্যের সাদা, লাল ফুল, শিয়াল কাঁটার বন, ঝুমকো লতা, উড়ন্ত কপোতের ডানায় রৌদ্রের সৌন্দর্য, তারপর বকুলের পাতা ঝরা মাঠে- ওইখানে চলো শুয়ে থাকি সারাদিন সারারাত যেখানে সুন্দর নদী। শিয়াল কাঁটার ঘন বন। বকুলের পাতাঝরা মাঠ কিংবা হাওয়ার আঘাত তৃণশীর্ষে। ঝুমকোলতার বুকে আনে শিহরণ... (গ্রামে : শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃঃ ৩৮) আমাদের কাব্য সম্পদের নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা নেই। শুধু আমাদের কেন পৃথিবীর কোন জাতির কোন ভাষারই বোধহয় তা নেই। মাটি ও মানুষের রসে সিঞ্চিত হয়ে কবিতা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, প্রাণবন্ত হয়। কবির চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকে কবিতার উপকরণ। খোলা মাঠ, মাঠের কৃষক, সবুজ শস্যক্ষেত্রের ওপর উড়ন্ত সাদাবক, স্বাস্থ্যবতী রমণী, গ্রামীণ যুবকের গান, মৌমাছি, পাখি, প্রজাপতি, পুকুরের ফুটন্ত শাপলা, এ সবই যেন এক স্বগীয় আবেশ, দেশকে সুখী ও সুন্দর করতে তিনি প্রবল আগ্রহী, উৎসাহী; এতে যত বাধাই আসুক। সমস্ত বাধা ডিঙোবার শক্তি সঞ্চিত রয়েছে তার হৃদয়ের একান্ত গোপন কোনে। তিনি কৃষকের হয়ে স্বপ্ন দেখেন- আমার দেশকে আমি কি দিতে পেরেছি, দিতে পারি, শষ্যক্ষেত্রে বলিষ্ঠ কৃষক, গ্রামের জলার ধারে সাদা সাদা বক, নদী থেকে জল নিয়ে ফিরে যায় স্বাস্থ্যবতী নারী... সাগর পাড়ের এই দেশে মুখ ফেরালেই চোখে পড়ে হাসি মাখা অবলা নারীর মুখ। তার সরলতা আইভি লতার মতো। সদ্য¯œাত সে রমণী ভিজা চুল রোদ্রে শুকায়। তার এই সরলতার কারণ কি? কবি মনে করেন, সে এ দেশের মাটি দিয়ে গড়া- তাই। এই শ্যামল রঙা রমণী হরিণীর মতো অবাক চোখে চেয়ে থাকে, তার সমস্ত শরীরে এদেশের নদীর মতোই বাঁধভাঙ্গা জোয়ার, হাল্কা লতার মতো শাড়ি নারীর যৌবনকে ডেকে রাখে। বাঙালী রমণী শাড়িতেই মানায়, অন্য কিছুতে নয়। সংসার প্রিয় বাঙালী নারীর এক হাতে কোলের শিশু অন্য হাতে রান্নার উনান। তার মরদের মন্দ আশঙ্কায় সর্বদা চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার সাজানো-গোছানো সংসারকে সে কখন ভাঙে না, ভাঙতে চায় না। কবি ওমর আলীর কবিতা পড়ে আরেক খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘তোমার কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতির যে গন্ধ পাওয়া যায় তাতে আমার মতো মানুষ বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারি।’ কারণ, কবি আল মাহমুদ কবি ওমর আলীর এদেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছেন- এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি, আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা; সে নাকি স্নানের পরে ভেজা চুল শুকায় রোদ্দুরে রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা... (এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি) বাঙালী হার না মানার জাতি, বীরের জাতি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের পর বাঙালী জাতি ও জাতীয়তাবাদের ওপর নেমে আসে অসুরের খড়গ। কোটি প্রাণের প্রাণ প্রবাহকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য চলতে থাকে গোপন চক্রান্ত। নেমে আসে মাতৃভাষার ওপর তুমুল আঘাত। মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় রাজপথে এদেশের সাহসী সন্তানেরা। থেমে থাকেননি কবি-সাহিত্যিকগণও। কবি ওমর আলী প্রচন্ড ঘৃণায় ফেটে পড়েন- প্রচ- বজ্রের মতো আমার কণ্ঠ- যদি হতো আর ফেটে পড়ত ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের রাস্তার মিছিলে অগ্নিগিরির উত্তাপ লাভার মতো উনিশ শ’ বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন... (বুলেটবিদ্ধ হয়ে বাংলাভাষা : স্বাধীনতার কবিতা) ১৯৭১ সালে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে কবি ওমর আলীর কাটে নির্ঘুম উদ্বেগের রাত্রি। তার ব্যথিত হৃদয় আর্তি জানায়- কি নিষ্ঠুর পরিহাস আমাকে দিয়েই খোঁড়া হলো আমার কবর আমাকে জীবিত তাতে চাপা দেয়া হলো কিংবা তার আগে আমি দাঁড়িয়ে আমার কাঠস্বর- স্তব্ধ আর বারংবার গুলিবিদ্ধ আমি- (বাংলাদেশ : ১৯৭১) ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি ওমর আলী। সারা জীবন কাব্য সাধনায় মগ্ন হয়ে অর্থবিত্তকে পায়ে ঠেলেছেন। অর্থের প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। হয়ত এ কারণেই সৎ ভাবে সহজ-সরল জীবনযাপন করতে পেরেছেন। কবি-সাহিত্যিকগণ কখনও প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন না। তবু এক সময় তা আপনিতেই এসে ধরা দেয়। কবি ওমর আলী ‘এ দেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। কবি ওমর আলী শেষ বয়সে এসে হঠাৎ (২৩ মার্চ ২০১২) অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলাচলের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, এমনকি তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। ঢাকা ল্যাব এইড হাসপাতাল তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার আর তেমন উন্নতি হয়নি। অসহায় এ কবির পাশে পাবনার বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকগণ তার নিয়মিত খোঁজখবর নেন। তাঁদের মধ্যে ড. আশরাফ পিন্টু, কবি মানিক মজুমদার, দেওয়ান বাদল, আজাদ এহতেশাম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কবি ও গবেষক ড. আশরাফ পিন্টু ছিলেন কবির অত্যান্ত স্লেহাস্পদ। আশরাফ পিন্টু কবির সাহিত্য কর্মের ওপর একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনার তাগিদ অনেকদিন ধরেই অনুভব করে আসছিলেন। যখন তার সাহিত্যকর্মের কাজ শুরু করেন (২০ জুলাই ২০১৫) তখন কবি অসুস্থ নির্বাক, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ড. আশরাফ পিন্টু এবং আজাদ এহতেশাম প্রায় ছয় মাসব্যাপী একটানা নিরলস পরিশ্রম করে ‘ওমর আলী জীবন ও সাহিত্যকর্ম’ নামক একটি চমকপ্রদ গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। কবি ওমর আলী সম্পর্কে এটিই প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। বাংলাদেশ কবিতা সংসদ পাবনা এর সভাপতি, কবি ও প্রাবন্ধিক মানিক মজুমদার কবির অকৃত্রিম সহচর ছিলেন। কবি ওমর আলী তাঁকে ভাইয়ের আদরে স্নেহ করতেন। মানিকদা সুদিনে যেমন কবির পাশে ছিলেন তেমনি দুর্দিনেও। অসুস্থ থাকাবস্থায় কবির খাবার কিনে দিয়েছেন। এমনকি কাপড় পাল্টিয়ে তার বিছানা করে দিয়েছেন। কবি ওমর আলী মানিক দাকে কতটুকু ভালবাসতেন তা কবির লেখনিতেই প্রকাশ পায়- মানিক মজুমদার একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু আমার বনের মধ্যে যেতে যেতে ভালুক দেখে চড়ে না একাগাছে আমি গাছে চড়তে জানিা একথা ভাল জানা আছে তার ভালুক মৃত মানুষ খায় না এও তার বেশ জানা আছে দু’জনেই শুয়ে পড়ব মাটিতে মরার মতো পড়ে থাকব ফলে ভালুক তখন নাক কান শুঁকে চলে যাবে বাঁচবে জীবন মানুষ মজুমদারকে স্বার্থপর বলে গালি দিত না তাহলে সবাই গল্পটা জানত অন্য রকমভাবে খুশি হতো মন কবি মানিক মজুমদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবি ওমর আলীর জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর গ্রন্থ ‘নিভৃতচারী কবি ওমর আলী।’ এ ছাড়া দেওয়াল বাদল ও মাসুদ মোস্তফা কবির জীবন ও সাহিত্য কর্মের ওপর নির্মাণ করেন ‘নিঃশব্দ বাড়ি’ নামক এক প্রামাণ্যচিত্র। মনোবেদনার হেতু- ‘কবি ওমর আলী পুরস্কার পাচ্ছেন ড. রকিবুল হাসান’, খবরটি প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক যুগান্তর’-এর সাহিত্য পাতায় ১২ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে। তা পাক, দুঃখ নেই। তিনিও গবেষক। তবে কবি ওমর আলীর ওপর তাঁর প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থ, সম্পাদনা গ্রন্থ আছে কি না তা আমার জানা নেই। কবি ওমর আলীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী এবং ইদ্রিস আলী সম্পাদিত ফোল্ডার পত্রিকার ৩৯ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এ পুরস্কার প্রদান করা হবে বলে জানা যায়। উক্ত পুরুস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচকও তিনি। এর পূর্বে পাবনার কয়েকজন সাহিত্য সংগঠক ‘বাচিক’-এর ব্যানারে (কবি ওমর আলী ‘একুশে পদক’ পাবার পর) ‘একুশে’র একটি অনুষ্ঠান করে, সেখানেও উক্ত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অথচ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এমন এক ব্যক্তিকে যিনি ড. আশরাফ পিন্টুর ‘ওমর আলী জীবন ও সাহিত্য কর্ম’ গ্রন্থটি থেকে প্রবন্ধ নিয়ে একটি সম্পাদিত গ্রন্থ করেছিলেন। যারা কবির জীবন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি তাদের চেয়ে এই কবি সম্পর্কে কে এত ভাল বলতে পারবেন। যারা কবিকে নিয়ে গবেষণা করলেন, প্রামাণ্যচিত্র বানালেন তাঁরা প্রধান আলোচক তো দূরের কথা একটি দাওয়াতপত্র পর্যন্ত পেলেন না। এহেন কৃতকর্ম কবির প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল বলে আমার মনে হয়। কেনন না, তিনি অতি তুচ্ছ কবি নন, তাঁর নামে পুরস্কারও অতি তুচ্ছ নয়। এহেন কৃতকর্ম নিন্দনীয়। তাঁর সম্পর্কে গভীর আলোচনা ও ব্যাপক গবেষণার দাবি রাখে। কবি ওমর আলীর কবিতা দিয়েই এ প্রবন্ধের ইতি টানতে চাই- আমার ভেতরে সেই চৌচির তৃষ্ণা কেঁদে ওঠে। শীতল পাত্রভরা এখন তোমাকে চাই চাই... (আমার ভেতরে তৃষ্ণা কাঁদে : যে তুমি আড়ালে)
×