ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকো

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২ নভেম্বর ২০১৮

শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকো

২২ সেপ্টেম্বর শনিবার ‘নভো-এয়ার’ বিমানে করে ঢাকা থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি দুপুর ২-৩০ মিনিটে। সময়মতো বিমান ছেড়ে যায়। সঙ্গে মেয়ে নমিকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র রবীন্দ্রতীর্থ দর্শন। যেখানে শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতীই শুধু নয় তার সঙ্গে ঐতিহ্যিক ঠাকুর বাড়ি এবং ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে প্রতিষ্ঠা করা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনের এক অপার অনুভব নিয়ে যে যাত্রা শুরু করি তার সময় ছিল মাত্র ৬ দিন। ঢাকায় বসে তৈরি করা ছকে পুরো গন্তব্যে কোন ধরনের বিভ্রাট ঘটেনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করে সরাসরি বোলপুরের উদ্দেশে রওনা দিই। নমি অনলাইনে সমস্ত হোটেল বুকিং করে রাখে। বিমানবন্দর থেকে মূলত ১টি ট্যাক্সি ভাড়া করে শান্তিনিকেতন যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। যেহেতু সড়ক পথে যাত্রা সুতরাং হাওড়া স্টেশন অবধি আমাদের যেতে হয়নি। বিকেল ৫টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। যেতে যেতে পথে এক সময়ের অবিভক্ত বাংলার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে বিমুগ্ধ হলাম। নৈসর্গিক বৈভবে দুই বাংলার পার্থক্য তেমন চোখেও পড়ে না। প্রতিদিনের যাপিত জীবনেরও কোন ফারাক লক্ষিত হয় না। ভাষা থেকে আরম্ভ করে রাস্তার ধারে বিভিন্ন চায়ের দোকান সঙ্গে গরম গরম সিঙ্গাড়া, পেঁয়াজি, বেগুনি এসব তো আছেই। বিদেশ ভ্রমণের কোন ধরনের চমক কিংবা অজানা কিছুই নেই। মনে হলো নিজের দেশেই অন্য কোন জেলা কিংবা গ্রামে প্রবেশ করছি। এই এক অদ্ভুত মেলবন্ধন যা আজও দুই বাংলার মানুষকে এক আত্মিক বোধে উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছে। সেই অনুভব তো আরও আগে। যখন ঢাকা থেকে যশোর জেলা অতিক্রম করছিলাম। মাইক্রোফোনে ভেসে আসল বিমান ক্রুর কণ্ঠÑ যশোর পার হচ্ছি আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দর অবতরণ করব। বোলপুরে যাত্রাপথে পার হচ্ছিলাম বর্ধমান জেলা। বাংলা সাহিত্যের আর এক কিংবদন্তি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। সেই আর এক ঐতিহ্যিক এলাকা দেখার লোক সম্ভরণ করলাম। প্রায়ই ৪ ঘণ্টার যাত্রা সময় পার করে অবশেষে আমরা বোলপুর হয়ে শান্তি নিকেতনে ঢুকলাম। সেই ছায়াঘেরা, শান্ত, ¯িœগ্ধ, মনোরম পল্লীবালা যা কবির সৃজন দ্যোতনায় বার বার ঝঙ্কৃত হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করার সময় নজর এলো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের চমৎকার বাড়ির ফটক। আমরা মূলত বিশ্ব ভারতীর পাশেই এক ভদ্রলোকের আবাসস্থলে অতিথি হিসেবে থাকার স্থান নির্ধারণ করেছিলাম ঢাকায় বসে। এখানে আমরা মূলত তিন রাতযাপন করি। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে অতিথি আপ্যায়নের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে অভিভূত হলাম। আমাদের যারা স্বাগত জানালেন তারাও বাঙালী এবং সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে সমচেতনায় বিশ্বাসী। তাদের আপ্যায়নেও একদম বাঙালিয়ানা। প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্ন এবং নৈশভোজ এক সঙ্গেই হতো, আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী প্রাতঃরাশ হোটেল ভাড়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থাকলেও আমরা দুপুর ও রাতের খাবার এক সঙ্গেই খেতাম তবে সে মূল্যটুকু আলাদা পরিশোধ করতে হতো। এমন মোহনীয় পরিবেশে মাতৃভূমির ছোঁয়া পাওয়া সেও এক ভিন্ন মাত্রার আবেশ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়ে তৈরি যে শান্তি নিকেতনের শুভযাত্রা আজও সেখানে এই নিবেদিত ঈশ্বর সাধকের স্মৃতিবিজড়িত বহু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে সেই সময়কার গ্রামীণ অর্থনীতির কারুশিল্পের নয়নাভিরাম সুচারু সূচি কর্মদ্যোতনা এখনও পর্যন্ত বাজার-বাণিজ্যকে সচল করে রেখেছে। তবে এসব কারুশিল্পীর জীবন মানের সাড়ম্বরতা তেমনভাবে দৃশমান নয়। অতি সাধারণভাবে মাটিতে মাদুর পেতে তারা নান্দনিক পণ্য সামগ্রী দর্শনার্থীর সামনে হাজির করে। শুধু তাই নয় গ্রামীণ নির্মল আবহে বাণিজ্যিকীকরণকে তারা সেভাবে আয়ত্তেও আনতে পারেনি, কোনমতে নিজেদের শ্রম আর উৎপাদন খরচের মূল্যটুকু আদায় করে। আর কলকাতার বাবুরা সেই অসামান্য পণ্য বাজারে কত লাভে যে বিক্রি করে তা এসব হস্তশিল্পীর ধারণার বাইরে। সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে। সেটাই তাদের রুজি-রোজগারের একমাত্র পথ। প্রতি সপ্তাহের হাট ধরাও অত সহজ ব্যাপার নয়। কারণ শাড়ি, থ্রি পিস, ফতুয়া, কুর্তি এমনকি হাতের ব্যাগও তৈরি করতে যা সময় লাগে তাতে এক সপ্তাহ কোন কিছুই নয়। তার ওপর কারুকার্যখচিত শৈল্পিক সৌন্দর্যের যে অভিনব নান্দনিকতা তাকে গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দিতে প্রচুর সময় লাগে। প্রযুক্তির ছোঁয়া এখানে নেই বললেই চলে। হস্তশিল্পের অপরূপ মাধুর্যে এই মনোরম বস্ত্র তৈরি এক অভাবনীয় সৃষ্টি বৈচিত্র্য। শান্তিনিকেতনের বাটিক শিল্পও সাধারণ মানুষের চাহিদায় বাজার বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করে আছে। ২৩ তারিখ সারাদিন শান্তি নিকেতনের আশপাশের গ্রামাঞ্চলে ঘুরে এসব ঐতিহ্যিক উপকরণ প্রত্যক্ষ করে মনে হলো সত্যিই এ দেশের সিংহভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীও কতখানি সৃষ্টিদ্যোতনায় নিমগ্ন হয়ে প্রতিদিনের যাপিত জীবনে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। গ্রাম বাংলার এই নান্দনিক শৌর্য যা শুধু প্রকৃতির অবারিত দানই নয় মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে, অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রতিদিনের সংগ্রামী অভিযাত্রাও বটে। যা আবার কিনা শিল্পসত্তায় সমৃদ্ধ এক অভাবনীয় সম্পদ। সত্যিই দেখা এবং উপভোগ করার মতো সমস্ত আনন্দযোগ এই পল্লীবালার নিভৃত কু-েও বহমান। ২৪ তারিখ সোমবার একেবারে রবীন্দ্রদর্শন। একজন রবীন্দ্রভক্ত, অনুরাগীর যে মাত্রায় কবি গুরুকে সমস্ত অর্ঘ নিবেদন করা সেখানে তিরোধানের প্রায় ৭৭ বছর পরও তাঁকে নতুন স্পর্শে জাগিয়ে তোলা সে অনুভূতিও ব্যক্ত করা অসম্ভব। বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে আর এক নতুন সংযোজন ‘বাংলাদেশ ভবন’ ঐতিহ্যিকে ও ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা। জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং মিলনায়তনের পরিকল্পনায় নির্মিত এই দ্বিতল সুরম্য ভবনটির অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ এখনও বাকি। শুধুমাত্র ‘জাদুঘরই’ সাজানো-গোছানো হয়েছে। গ্রন্থাগার এবং মিলনায়তনের কক্ষ নির্মিত হলেও সেভাবে এখনও দর্শনীয় করে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে জাদুঘরটি দেখার মতো। ২৫০০ বছরের পুরনো বটেশ্বর ঐতিহ্য দিয়ে শুরু করা এই জাদুঘরের কার্যক্রমে আবহমান বাংলা তার সমৃদ্ধ বৈভব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন স্থাপত্য আর হস্তশিল্পের নমুনা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই বিশেষ প্রাঙ্গণটির শোভাবর্ধন করা হয়। ভাষা সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধই নয়, ষাটের দশকের সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার সুশৃঙ্খল নিদর্শনও জাদুঘরটিকে নানা মাত্রিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দুঃসহ রক্তাক্ত বেদনা পুরো আবহকে শোকাভিভূতও করে তোলে। পরের দিন কলকাতা শহরের শপিং মলগুলো দেখার ইচ্ছে নিয়ে নমিসহ ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। শ্রীলেদার, খাদিম, অজন্তার মতো জুতা আর ব্যাগের দোকান দেখা শেষ করে নিজেদের জন্য এবং কিছু উপহার সামগ্রীও কেনা হলো। সন্ধ্যা ছয়টায় দেখা করলাম বিখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে, ফোনে তার সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে ঠিকানাও নিলাম। উল্টো ডাঙ্গায় সিটি হাসপাতালের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসে এই যশস্ব কবির বাসা। রবীন্দ্র অনুরাগী, গবেষক, পর্যবেক্ষক কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতায় আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শুধু একজন গুণমুগ্ধ ভক্তের সঙ্গে এক নিভৃত সৃজন সত্তার চমৎকার সময় কাটানোর দুর্লভ মুহূর্ত। সিংহভাগ কথা বললেন রবীন্দ্রনাথের ওপর। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী ও বিস্ময়কর প্রতিভায় সম্পর্কিত একজন রবীন্দ্র বোদ্ধা কিভাবে শ্রদ্ধায়, অর্ঘ্য,ে নিবেদনে কবিকে স্মরণ করলেন সেও এক অভিভূক্ত হওয়ার ব্যাপার। সাধাণের মধ্যে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অল্প সময় কথা বলে কোন কিছুই যে বলতে পারলাম না সেই কষ্টে তার বাসা থেকে বের হলাম। স্মরণীয় এই মুহূর্তগুলো চিরস্থায়ী চেতনায় গাঁথা হয়ে রইল। কলকাতায় অবস্থান করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অধরা রেখে চলে আসার কথা চিন্তাই করা যায় না। সর্বশেষ অমৃত তুলে রাখা ছিল ফেরার আগের দিনের জন্য। ২৭ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী রোড এবং গিরিশ পার্কের মাঝামাঝি স্থানটিতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করলাম। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি ফটকের ভেতরে ঢুকতেই নজরে এলো। এই বিশাল ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠা করা হয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ বৈভব এখনও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য সম্পদ। যে ঠাকুরবাড়িতে কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, সৃষ্টিশীল জগত তৈরি করা তারচেয়ে বেশি জীবনের অন্তিম সময়গুলোতে এই ঠাকুরবাড়ির আঙিনাতে চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার সবই করা হয়েছে। অন্তিম যাত্রাও শুরু হয় ঠাকুরবাড়ির বিশাল জায়গা থেকে কবির শবদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এখন এই ঠাকুরবাড়ির অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত ‘রবীন্দ্রভারতী জাদুঘর।’ যেখানে রবীন্দ্রনাথের জন্মখাট থেকে শুরু করে ব্যবহৃত যাবতীয় উপকরণই শুধু নয় শেষ শয়ানের চিহ্নও সেই অবস্থায় রেখে দেয়া আছে। দুনিয়া ভ্রমণ করা এই বিশেষ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিশ্ববরেণ্য প-িতদের দেখা-আলাপচারিতা সবই সুসংবদ্ধভাবে সাজানো আছে। আরও সুশৃঙ্খলভাবে যেমন কবির জাপান ভ্রমণ যা একটি নির্দিষ্ট কক্ষে প্রাসঙ্গিক সব নিদর্শন দিয়ে প্রণালীবদ্ধভাবে গোছানো। শুধু তাই নয় প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ, চীনে রবীন্দ্রনাথ এভাবে বিশেষ বিশেষ কক্ষে কবিকে সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সত্যিই মনোমুগ্ধকর, চমকপদ এবং অভিনব। এই জাদুঘরটি রবীন্দ্র আবহে নিজেকে পরিপূর্ণ করার এক স্মৃতি সাগর। তার পরেও জীবন্ত রবীন্দ্রনাথকেও খুঁজে পেতে দেরি হয় না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বাংলা ও বাঙালীর প্রতিদিনের জীবন ধারার যে আধুনিকতা এবং সময়ের ¯্রােতকে সংযোজন করে তা আজও এই বঙ্গভূমিকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। বাঙালীর যথার্থ তীর্থভূমি এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিস্তীর্ণ আঙিনা বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিরও অন্যতম মিলনযজ্ঞ। যেখান থেকে উনিশ শতকীয় নবজাগরণের অনেক বিজ্ঞজনের যাত্রা শুরুই হয়নি বিকশিত হয়ে আধুনিকতার বরমাল্যকেও চিরস্থায়িত্বের রূপ প্রদান করে। এমন নন্দিত, সমৃদ্ধ প্রাঙ্গণ একদিনের দেখায় কোন কিছুই পূর্ণতায় পৌঁছে না। সেই আশাহতের বেদনা নিয়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।
×