ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

প্রকাশনা শিল্পে শাম্মী শাহরিয়ার

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ২ নভেম্বর ২০১৮

প্রকাশনা শিল্পে শাম্মী শাহরিয়ার

সমৃদ্ধির পথে নিরন্তর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নারীরা প্রচলিত ও গতানুগতিক অবস্থা থেকে বের হয়ে সর্বক্ষেত্রে নিজের অবস্থান জোরদার করছে। তার পরেও এমন কিছু বিশিষ্ট পর্যায় আছে যেখানে নারীরা এখনও অবারিত তো নয়ই স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করে না। প্রকাশনা শিল্পও তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অঙ্গন যেখানে নারীদের অবাধ গতিপথ এখনও সেভাবে নির্দেশিত হয়নি। তার পরেও কিছু নারী এই পথপরিক্রমায় নিজেদের অংশীদারিত্বকে স্পষ্টতই প্রকাশ করছে। শাম্মী আকতার তেমনই একজন অন্যমাত্রার নারী ব্যক্তিত্ব যিনি কিনা ভেতরের বোধ আর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে প্রকাশনা শিল্পের মতো একটি অতি আবশ্যিক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে এগিয়ে এসেছেন। বাবা মোহাম্মদ আনিস, মা আকতারা পারভিন। এক গতানুগতিক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া শাম্মী মায়ের অনুপ্রেরণায় স্বপ্ন দেখেছেন এবং পূর্ণ করতেও পিছপা হননি। বাবা ব্যবসায়ী হলেও যৌথ পরিবারে তার বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবনে প্রবেশ করা এবং শেষ অবধি নিজের প্রত্যাশিত-আকাক্সক্ষার দিকে নিয়তই এগিয়ে যাওয়া। কথা প্রসঙ্গে বার বার মাকে স্মরণ করলেন। এক পর্যায়ে বললেন যে পরিবারে জন্ম সেখানে মেয়েদের এসএসসির পর আর শিক্ষার্থী জীবন চালিত করা প্রায়ই অসম্ভব ছিল। কিন্তু মাই সব সময় স্বপ্নদ্রষ্টার ভূমিকায় নেমে শাম্মীকে পথনির্দেশনা দিয়েছেন। সেই অনমনীয় চেতনায় এক সময় রাজশাহীর রহনপুর রাবেয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করে নিউ ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহীতে ভর্তি হন। ২০০১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। ইতোমধ্যে সময়মতো প্রাণিবিদ্যায় (সম্মান) স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জিত হয় ২০০৭ সালে। শাম্মীর মনে হয়েছিল রাজশাহীতে কর্মক্ষেত্রের সুযোগ সীমিত থাকায় ঢাকায় চলে আসা ছাড়া আর কোন পথ নেই। নতুন পেশাগত জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে বৃহত্তর রাজধানী যে অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় সেটা বুঝতেও বেশি সময় লাগেনি। ২০০৮ সালে ঢাকায় এসে জীবনকে নতুন করে গোছানোর পরিকল্পনা করলেও অত সহজে সেই আকাক্সিক্ষত স্বপ্নকে ধরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু হালও ছাড়েনি কোন সময়। জীবনের দুর্বার মিছিলে বিয়ে হওয়া এবং এক কন্যা সন্তানের জননী হিসেবে মাতৃত্বের মহিমায় নিজেকে ভরিয়ে তোলা সেও চলার পথের অন্যতম প্রধান শুভ অধ্যায়ের নবসূচনা। সেই পালাক্রমে লালিত স্বপ্নও হাতছানি দিয়ে ডাকে। চাকরি করার ইচ্ছে এবং আগ্রহ থাকলেও চিরয়িত বাঙালিয়ানা স্বামী, সংসার এবং সন্তানের পরিচর্যায় সময় এগিয়ে যায়। তারপর আসে জীবনের একা মহাযোগ। অতি বাল্যকাল থেকে যে বই তাকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে অবাক করে দিত সেটা শুধু পাঠক হিসেবেই নয় পুরো গ্রন্থটি হাতের কাছে পাওয়ার যাবতীয় কর্মপ্রণালীর ব্যাপারেও। অর্থাৎ একটি বই কিভাবে পাঠকের দ্বার গোড়ায় পৌঁছায় তার প্রয়োজনীয় শৈল্পিক আর কর্ম দ্যোতনাও শাম্মীকে বার বার তাড়িত করে। প্রকাশক ও কবি খোরশেদ বাহারের সঙ্গে অভাবনীয় পরিচয় সূত্র সেই অদম্য ইচ্ছায় গ্রন্থি বেঁধে দিল। প্রকাশনা শিল্পের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংযুক্ত থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া জীবনের এক অন্যতম কর্মযোগ যাকে আজও তিনি অন্তরের গভীর বোধ থেকে লালন-ধারণ করে যাচ্ছেন। খোরশেদ বাহারের সঙ্গে আলাপচারিতায় বুঝতে পারলেন কবির নিজেরই একটি প্রকাশনা সংস্থা আছে সেখানে আর্থিক সাফল্যের চাইতেও বেশি কাজ করে তার শৈল্পিক চেতনা। অর্থাৎ প্রকাশনাটি সেভাবে বৈষয়িক ব্যাপার পর্যন্ত এখনও যেতে পারেনি। নিবেদিত পাঠক শাম্মীর বইয়ের নেশায় নিমগ্ন হওয়ার ব্যাপারটি অনুরণিত হতে থাকে অন্তর্নিহিত নান্দনিকশৈলীতে। বই পড়ার আনন্দের সঙ্গে সব সময় গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যেত ছন্দোবদ্ধ শব্দ চয়নের বিশুদ্ধ কাব্যিক আবহ। ফলে আবৃত্তি করতেও ভালবাসেন। ভালবাসার মহিমা আর অন্তরের গভীর টান থেকে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে সেই যে সখ্য তা আজ অবধি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, অবিচলিত স্বপ্নে আপন কর্ম পরিধির গতি নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। চিত্রা প্রকাশনীর সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টির অভিব্যক্তি এমনি করেই তুলে ধরলেন শাম্মী। প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল প্রকাশনা শিল্পের গুরু দায়িত্ব। লেখক থেকে আরম্ভ করে পাঠকের মাঝখানে যে দূরত্ব সেখানে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর যে দায়বদ্ধতা তা প্রতি মুহূর্তে মনে রেখে মানসম্মত গ্রন্থ পাঠককে উপহার দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হয়। নতুন বানান নীতি এখনও সেভাবে প্রচলন করা সম্ভব না হলেও বাংলা একামেডি কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম বিধি অনুসরণ করেই এই বিশেষ অঙ্গনটিকে পাঠকের সামনে হাজির করতে হয়। প্রকাশনার প্রয়োজনীয় পর্যায়গুলো অতিক্রম করে একটা পূর্ণাঙ্গ বই যখন পাঠকের হাতে পৌঁছায় তার অনাবিল আনন্দটুকু যে কতখানি তৃপ্তি আর স্বস্তির ব্যাপার তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একটি বই বের করার মধ্য দিয়ে প্রকাশনার সার্বিক দায়িত্ব মিটে যায় না। বরং তা কতখানি নির্ভুল আর পরিশীলিতভাবে পাঠকের নজরে আসা বাঞ্ছনীয় তাকেও বিশেষভাবে আমলে নিতে হয়। হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে এক সময় এসে যায় এক অবর্ণনীয় সুযোগ। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রিন্টিং এ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ’ নামে একটি নতুন বিভাগ তার যাত্রা শুরু করে। আর শাম্মী ছিলেন সেই নবতর বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। বাস্তব কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে অনবচ্ছেদ সম্পর্ক সেটাও তাকে বিভিন্নভাবে আলোড়িত করে। বই প্রকাশ করতে গিয়ে নিয়ামানুগ যে প্রতিটি ধাপ পার হতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তা আরও বিজ্ঞানভিত্তিক পঠন-পাঠনে নিজেকে এই বিশেষ শিল্প সংস্থায় মনোযোগী করে তোলে। কোন নতুন বইয়ের মলাট, প্রচ্ছদ থেকে আরম্ভ করে সামগ্রিক অবয়বের যে দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণ সেটাকে অন্যতম গুরুত্ব হিসেবে বিবেচনায় আনতে হয়। এরপর বানান, প্রুফ দেখা, অক্ষরের নির্ভুল স্পষ্টতা সব বিষয়েই আলাদাভাবে শেখানও হয় এই বিভাগে। তা ছাড়া প্রকাশনার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে মাত্রায় সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের ভূমিকায় নিজেকে নিমগ্ন করতে হয় তা যেমন গভীর মনসংযোগের ব্যাপার একইভাবে শৈল্পিক সুষমাকেও স্পষ্ট করা বিশেষ দায়বদ্ধতা। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই নির্দিষ্ট বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জিত হয়। ফলে আরও নতুন উদ্যমে এই পেশায় নিজেকে এগিয়ে নিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য গতিতেই চালিত হচ্ছেন। সময়ের তেমন কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা না থাকায় স্বামী-সন্তান আর সংসার নিয়েও কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না।
×