ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

গ্রীনল্যান্ডের বরফের গভীরেই বরফ গলার রহস্য!

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২ নভেম্বর ২০১৮

গ্রীনল্যান্ডের বরফের গভীরেই বরফ গলার রহস্য!

বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোর জলস্তর যে বাড়ছে তার সূত্র ধারণ করে আছে গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ। বিজ্ঞানীরা গ্লেসিয়ারের গভীরে খনন করে এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জলবায়ুর হেয়ালীর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝার চেষ্টা করছেন। অধ্যাপক আসা বেনার সালমের নেতৃত্বে একটি বিজ্ঞানী দল এখন গ্রীনল্যান্ডে বসেছেন। গ্রীনল্যান্ডে জুন, জুলাই, আগস্ট এই তিন মাস গ্রীষ্মকাল। এ সময় বরফ গলে। দলটির সেখানে অবস্থানকালে গত ১৭ ও ৩১ জুলাই ও ৯ আগস্ট তিনটি বরফের আস্তরণ গলে গেছে। এই উঁচু বরফ আস্তরণের আয়তন ছিল প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার বর্গমাইলÑ যা কিনা গ্রীনল্যান্ডের মোট বরফের আস্তরণের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১২ সালের গ্রীষ্মে তুঙ্গে থাকার সময় গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণের উপরের অংশের ৯৭ ভাগেরও বেশি গলে গিয়েছিল এবং পানির তোড়ে গ্রীনল্যান্ডের অন্যতম দীর্ঘ একটি সড়ক সংলগ্ন সেতু ভেসে গিয়েছিল। এবারের বরফগলা ২০১২ সালের মতো অত মারাত্মক নয়। তথাপি গবেষকরা বরফগলা দেখে উদ্বিগ্নবোধ করছেন এবং কত দ্রুত এই বরফ গলছে সে ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ যদি উল্লেখযোগ্যভাবে গলে তাহলে গুটিকয়েক সেতুই শুধু যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, তার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু হবে। বরফ গলার কারণে সাগরের জলস্তর অনেক বেশি বেড়ে যাবে যার পরিণতিতে সারা বিশ্বের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাই এমনকি সমস্ত দ্বীপরাষ্ট্রও পানিতে তলিয়ে যাবে। অধ্যাপক আসা রেনারমামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গ্রীনল্যান্ডের বরফ আস্তরণ কত দ্রুত গলবে বলে ধারণা করা যায় তার জানার জন্য কি সেখানকার বরফের আস্তরণের বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করছেন। পরিবর্তন রেকর্ড করছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করছেন। তারা জানার চেষ্টা করছেন বরফ গলা পানি ঠিক কি পরিমাণে বরফের আস্তরণ ছেড়ে চলে যায় এবং কতটুকু পানি বরফের গভীরে থেকে যায়। বেনারমাস বলেন, আপনাদের মনে হতে পারে সবটুকু পানিই চলে যায়। কিন্তু আমাদের গবেষণা বলে অন্য কথা। অধিকতর উচ্চতায় পানির অবস্থা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে চ্যানেল তৈরি করে বেরিয়ে না গিয়ে সেই পানি তুষার ও বরফের মধ্যে ঢুকে পড়ে মজুত থাকে। বরফগলা পানি কোথায় যায় ও কতখানি হিমবাহের ভিতরে থেমে যায় বা সাগরে চলে যায় জানতে পারলে বিজ্ঞানীরা সাগরের জলস্তর বৃদ্ধির ব্যাপারে পূর্বাভাষ দিতে পারবেন। এদিকে অধ্যাপক জ্যাসন ব্রাইনারের নেতৃত্বে আরেক গবেষক দল গ্রীনল্যান্ডের বরফ আস্তরণ কত দ্রুত গলছে পরীক্ষা করতে গিয়ে এমনটি দেখার আশা করছেন যে গ্রীষ্মকালে উষ্ণতর বায়ু প্রবাহের পরিণতিতে সুমেরু অঞ্চলে বাড়তি তুষার জমা হতে পারে। উষ্ণ বায়ু অধিকতর আর্দ্রতা নিয়ে আসে। সেই আর্দ্রতা থেকেই তুষারপাত হয়। সুমেরুতে এমনিভাবে তুষারপাত হলে বরফের আস্তরণ সঙ্কুচিত হয়ে আসার হার হ্রাস পেতে পারে। তার দলটি নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে সে তুষারপাত, তাপমাত্রা কিংবা এই দুইয়ের মিলিত কারণে বরফগলা প্রভাবিত হয় কিনা। এটা জানতে পারলে বিজ্ঞানীরা আরও নির্ভুল কম্পিউটার মডেল তৈরি করে পূর্বাভাস দিতে পারবেন বরফ আস্তরণ কতটুকু সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং সাগরের জলস্তর কতটুকু বাড়ছে। ঐ মডেলগুলো থেকে মৌলিক কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে। জানা যেতে পারে হঠাৎ করে জলবায়ুর পরিবর্তন কিংবা ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ফলে বরফের আস্তরণ ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রভাবিত হবে কিনা। আরেকজন বিজ্ঞানী এই গ্রীষ্মে কাজ করেছেন উত্তর-পূর্ব গ্রীনল্যান্ডে বায়ুতাড়িত সুমেরুর বরফাঞ্চলে। ‘ইস্ট গ্রীনল্যান্ড আইসকোর প্রজেক্ট’ এর এই দলটি ড্রিলিং করে সেখানকার বরফের কেন্দ্রস্থলের সার অংশ সংগ্রহ করেছেন। উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে অতীতের দিকে দৃষ্টি দেয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সূত্র খুঁজে বের করা। প্রকল্পের চেয়ারম্যান ডরথি ডাল-জেনসেন বলেন, পাঁচ হাজার থেকে ৮ হাজার বছর আগে উষ্ণ জলবায়ুর এক অধ্যায় বিরাজ করেছিল। সেই অধ্যায়ের নাম ক্লাইমেট অপটিমাস। সেই অধ্যায়টি এবং এর আগের এই ধরনের উষ্ণ অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জানতে পারা এবং সেই অধ্যায়গুলোর সঙ্গে আমাদের বর্তমানের উষ্ণ অধ্যায়টির কোন সাদৃশ্য আছে কিনা, থাকলে কোন কোন দিক দিয়ে আছে তা দেখতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডাল-জেনসেন বলেন, গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ দু’ভাবে তার ভর হারাচ্ছে। একটা হলো গ্রীনল্যান্ডের উপকূল বরাবর তটরেখা ধরে বরফ গলার কারণে এবং দ্বিতীয়ত বরফের এইসব প্রবাহের মাধ্যমে বরফ চলে যাওয়ার কারণে। তিনি বলেন, বরফের এই প্রবাহ সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি অথচ গ্রীনল্যান্ডের বরফের আস্তরণ থেকে প্রায় অর্ধেক ভর কর্মে যাওয়ার জন্য এই প্রবাহই দায়ী। ডাল-জেনসেনের মতে বরফের প্রবাহের এত গভীরে ড্রিল করে এর শাঁস অংশটুকু আহরণের উদ্যোগ এই প্রথম। ড্রিলিং করা হচ্ছে বরফের প্রবাহের মধ্য দিয়ে একেবারে নিচের নিরেট পাথুরে অংশ পর্যন্ত। অনুমিত দূরত্ব ২৫৫০ মিটার বা প্রায় ৮৪০০ ফুট। ২০১৭ সালে বরফের সার অংশ ড্রিলিংয়ের কাজ শুরু হয়। সে বছর বিজ্ঞানীরা ৩ হাজার ফুট গভীরের সার অংশ এবং ২০১৮ সালে আরও ২৫০০ ফুট গভীরের সার অংশ আহরণ করেন। আরও ৯ মিটার গভীর পর্যন্ত যাওয়া বাকি আছে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×