ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবন ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২ নভেম্বর ২০১৮

সুন্দরবন ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট ॥ দস্যুতার উপদ্রব থেকে মুক্ত হলো বিশ্বের একক বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। বৃহস্পতিবার দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সুন্দরবন দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করেন। সর্বশেষ ছয়টি বাহিনীর ৫৪ বনদস্যু ৫৮ আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রায় সাড়ে তিন হাজার গুলিসহ জমা দিয়ে এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। সুন্দবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করায় বনজীবী, জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক, মাঝিমাল্লাসহ বনসংলগ্ন এলাকাবাসী সকলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। এমনকি আত্মসমর্পণকারী বনদস্যু ও তাদের পরিবারবর্গ স্বস্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, এখন জেলে-বাওয়ালিরা শঙ্কাহীন চিত্তে সুন্দরবনে যেতে পারবেন। মৎস্যজীবীরা নিরাপদে সমুদ্রে ইলিশ আহরণ করবে। পাশাপাশি বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষা পাবে। আত্মসমর্পণ উপলক্ষে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদের সভাপতিত্বে বাগেরহাটের শেখ হেলাল উদ্দিন স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন কেসিসি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, ডাঃ মোজাস্মেল হোসেন এমপি, এ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা এমপি, তালুকদার হাবিবুন্নাহার এমপি, খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসাইন মিয়া, খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মদ, র‌্যাব-৬ এর অধিনায়ক হাসান ইমন আল রাজিব, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়সহ র‌্যাব, পুলিশ ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পাঁচ সহ¯্রাধিক ব্যক্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুন্দরবনের আনোয়ারুল বাহিনীর আট সদস্য, তৈয়াবুর বাহিনীর পাঁচ, শরিফ বাহিনীর ১৭, ছাত্তার বাহিনীর ১২, সিদ্দিক বাহিনীর সাত ও আল আমিন বাহিনীর পাঁচ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে ৫৮ অস্ত্র ও তিন হাজার ৩৫১টি গোলাবারুদ জমা দেন। সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বনদস্যুরা এখন আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে। তারা অস্বাভাবিক জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। তাদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি এখন সরকার দেখছে। আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া তারা যে কাজ করতে আগ্রহী তাদের সেসব কাজে সহায়তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। র‌্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনও তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সার্বিক সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বনদস্যুদের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জেলেরা আতঙ্কে ছিল। মাছ ধরতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়ত। কিন্তু এখন তারা নিরাপদ জীবনে ফিরে এসেছে। এজন্য তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং র‌্যাব ও পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা সুন্দরবনে অভিযান পরিচালনা করেছি। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে বলেছি। অনেকেই আত্মসমর্পণ করেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরেও আর কেউ যদি সুন্দরবনে দস্যুতা করে তাহলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। ছয়টি বাহিনীর ৫৪ সদস্যের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি সব কথা বলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার জন্য আমরা সুন্দরবনে র‌্যাবের চারটি ক্যাম্প করব। যেখান থেকে সার্বক্ষণিকভাবে সুন্দরবনকে সুরক্ষার জন্য কাজ করা হবে। এরপরেও কেউ যদি সুন্দরবনে দস্যুতা করার সাহস দেখায় তাহলে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘোষণা দেন র‌্যাব কর্মকর্তা। এর আগে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী ছাত্তার বাহিনীর প্রধান ছাত্তার ও বনদস্যু নাসিম শেখের মেয়ে নাসরিন সুলতানাসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শোনেন। পরে প্রধানমন্ত্রী আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়া যেসব মামলা রয়েছে সেসব মামলা আইনী পদ্ধতিতে প্রত্যাহার করতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। এছাড়াও আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের মধ্যে যাদের ঘর নেই তাদের ঘর এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করার জন্য প্রত্যেক দস্যুকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ এক লাখ টাকা, র‌্যাবের পক্ষ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকাসহ শীতবস্ত্র ও একটি করে মোবাইল সেট দেয়া হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার নিয়ে গঠিত বিশ্বের একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করায় বনজীবী, জেলে-বাওয়ালী, ট্রলার মালিক, আড়তদারসহ এখানে সর্বস্তরের জনগণ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের পরিবারও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। এর আগে র‌্যাবের তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ মে প্রথম মোংলা বন্দরের ফুয়েল জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও পাঁচ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দিয়ে ৯ সহযোগীসহ ‘মাস্টার বাহিনীর’ প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার আত্মসমর্পণ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে মানজার বাহিনী প্রধান মানজার সরদার, মজিদ বাহিনী প্রধান তাকবির বাগচী মজিদ, বড় ভাই বাহিনী প্রধান আবদুল ওয়াহেদ মোল্লা, ভাই ভাই বাহিনী প্রধান মোঃ ফারুক মোড়ল, সুমন বাহিনী প্রধান জামাল শরিফ সুমন, দাদা ভাই বাহিনী প্রধান রাজন, হান্নান বাহিনী প্রধান হান্নান, আমির বাহিনী প্রধান আমির আলী, মুন্না বাহিনী প্রধান মুন্না, ছোট শামছু বাহিনী প্রধান শামছুর রহমান, মানজু বাহিনী প্রধান মানজু সরদার ও সূর্য বাহিনী প্রধান সূর্যসহ ২৯টি বনদস্যু বাহিনীর ২৭৪ সদস্য ৪০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৯ হাজার ১৫৩ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবনে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১শ ৩৫ জন বনদস্যু নিহত হয়।
×