ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান

সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় আমার রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ নভেম্বর ২০১৮

সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় আমার রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠা

১৫ আগস্টের পর বাঙালী জাতির ইতিহাসে আরেক কলঙ্কিত অধ্যায় জেলহত্যা। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করে আমাদের জাতীয় চার নেতাকে। স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। এর আড়াই মাস পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘাতকরাই বর্বরোচিতভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী চক্র জাতির পিতাকে হত্যা করে। এরপর প্রত্যক্ষভাবে খুনী মোশতাক ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ওই চক্র এ দেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যাতে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে না পারে, স্বাধীনতা যাতে ব্যর্থ হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় সেই চক্রান্ত করে এই চক্রটি। মূলত এ দেশে যেন কোনদিন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্র থেকেই নিরাপদ স্থান জেলখানার অভ্যন্তরে এই হত্যাকাণ্ড তারা সংঘটিত করে। মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থেকে জাতীয় চার নেতা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খাদ্য ও ত্রাণমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে থেকেছেন। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে যখন কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে তখন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে এই চার নেতা আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন। আসলে ঘাতক চক্রের লক্ষ্য ছিল বাঙালীকে নেতৃত্ব শূন্য করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের নতজানু করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন সেই চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হচ্ছে ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস। জেলহত্যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত এবং বিষাদময় ঘটনা। অন্যদের মতো এই ঘটনা আমাকেও নানা স্মৃতি শোকাহত করে। আমার জন্ম কিশোরগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম যে মাটিতে। আমার এই লেখায় আজ সৈয়দ নজরুল ইসলামের কিছু স্মৃতি তুলে ধরব। প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকেÑ যা কখনও ভুলা যায় না। ক্ষণে ক্ষণে মনের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। এই স্মৃতি সুখের কিংবা দুঃখেরও হতে পারে। আমার জীবনেও এমন অনেক স্মৃতি মনের কোণে জমে আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সুখ ও দুঃখ মিশ্রিত স্মৃতির কথা আজ মনে পড়েছে। ৪ নেতার মধ্যে কিশোরগঞ্জের গর্ব এবং আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ নিবেদিত নেতা ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আমার রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন এক মাইলফলক। আমি ছিলাম তাঁর অতিশয় স্নেহে লালিত একজন রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৬৬ সালে যখন বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন, তখন আমি দাবিগুলো অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে স্টাডি করি। এই দফাগুলোতে অবহেলিত, বঞ্চিত বাঙালীর ভবিষ্যত মুক্তির অন্তর্নিহিত একটি দিকদর্শন দেখতে পাই। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই। সেই থেকেই কিশোরগঞ্জের রাজনীতির সূত্রে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে আমার পরিচয়। আমার আজকের আলোচনার স্মৃতিপট মূলত ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে বৃহত্তর ময়মনসিংহের এমএনএ এবং এমসিএদের করণীয় নীতি-নির্ধারণী একটি গোপন সভা ডেকেছিলেন। সেই সভায় আমাকেও যোগদান করার জন্য নেতা নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি সভায় যোগদান করি। সভা শেষে তিনি আমাকে কিশোরগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের থানাগুলোর সংগঠকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিলেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে ইতস্তত ভাব নিলে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অত্যন্ত স্নেহের সুরে বললেন, আমি বুঝতে পারছি তুমি কি চিন্তা করছো। প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে ১০টা চাকরি দিয়ে দেব। তিনি জানতেন আমি তখন চাকরিরত ছিলাম। নেতার অনুপ্রেরণায় আমি প্রথমেই কটিয়াদী থানায় এসে সর্বদলীয় এ্যাকশন কমিটি গঠন করি এবং সকলে আমাকে কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেন (আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ঘটনা ও বিষয়াদি এখানে উল্লেখ করবো পরবর্তী কোন লেখায়)। এক পর্যায়ে আমার এলাকার কয়েকশত যুবক নিয়ে ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতে যাই। পরবর্তী এক সময়ে রণাঙ্গনে এক পর্যায়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে ভারতের ঢালু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থা খারাপ দেখে বর্তমান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের অত্যন্ত সহৃদ সহায়তায় আমাকে তুরা হাসপাতালে পাঠানো হয়। তখন জীবনে বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পরে শুনেছি বাড়িতে দু’বার খবর এসেছিল আমি মারা গেছি। এমন কঠিন দুঃসময়ে একদিন আমার শ্রদ্ধেয় নেতা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হাসপাতাল ভিজিট করতে আসেন। তিনি আমার শারীরিক অবস্থা দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। আমার সুচিকিৎসার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। আমি সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠি এবং স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটি ও আবহাওয়াতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পাই। আমার সবচেয়ে আনন্দের এবং সুখের বিষয় হলো, আমার প্রিয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। এবং দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান গর্বিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হতে পেরেছি। আমার রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠার প্রেরণাও তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমি কর্মজীবনে ফিরে যাই। তারপরও নানা সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে আমার যোগাযোগের সুযোগ হয়েছিল। দেখা হতো, কথা হতো। উপলক্ষ ছিল রাজনীতি। আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছেড়ে দিলেও পরোক্ষভাবে এলাকামুখী ছিলাম। রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে আমার সীমিত আকারেও যোগাযোগ হতো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আমরা রাজনৈতিক এতিমের মতো ছিলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হতো। বিশেষ করে আমরা যারা রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি আমাকে হতবিহ্বল করে দেয়। সেই শোকার্ত হৃদয়ে আবার বাসা বাঁধে আরেক শোক ৩ নবেম্বরের জেল হত্যা। জাতীয় চার নেতা হত্যা। এই হত্যাকা-ে ১৫ আগস্টের পর আমি দ্বিতীয়বার অভিভাবক হারালাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার সত্যিই অভিভাবক ছিলেন। সেই পথ অনুসরণ করে আমি এখনও মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। জাতির পিতার আদর্শ ও তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। আবারও মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে কেন এবং কী কারণে হত্যা করা হয় তার মূল কারণ এখনও অনুদঘাটিত। তবে ধারণা প্রশ্নাতীত যেÑ দেশী-বিদেশী অপশক্তিগুলো একত্রে কাজ করেই নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা অর্জিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি শুধু পরিবর্তনই নয়, দেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত করে। রাজনৈতিক দল এবং নেতা, গোষ্ঠী ও বিভিন্ন পেশার বাংলাদেশবিরোধীরা হত্যাকা-ের ক্ষেত্র তৈরি ও ষড়যন্ত্রে জড়িত এবং সহায়ক ছিল। কিন্তু তাদের আজও চিহ্নিত করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার যড়যন্ত্র এবং মূল ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়টি এখনও বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। হত্যাযজ্ঞে মোশতাক ও জিয়ার ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। এরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল এবং এরাই বেনিফিসিয়ারি। আমরা দেখেছি রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে জিয়া ক্ষমতা দখলের পরই দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। জিয়া-মোশতাক একই লক্ষ্যে কাজ করেছে এটাও এখন স্পষ্ট। আমরা বিশ্বাস করি, ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের হত্যাকা-ের মূল ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনে তদন্ত এবং কমিশন গঠন করা হবে এবং এটা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই করবেন। তদন্ত হলে স্পষ্ট হবে, জাতির পিতা এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার ইন্ধনদাতা কারা, কারা মূল ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। ইতিহাসের সত্য রক্ষার খাতিরেই এটা করা জরুরী। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পরিচালক বিআরটিএ
×