ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

ছায়ানটের ‘টেগোর এ্যাওয়ার্ড’ অর্জন

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১ নভেম্বর ২০১৮

ছায়ানটের ‘টেগোর এ্যাওয়ার্ড’ অর্জন

সময়টা বাংলা ১৩৬৮, ইংরেজী ১৯৬১ সাল। সে সময় রবীন্দ্রশতবার্ষিকী পালন করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানী শাসনের থমথমে পরিবেশেও কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী একত্র হয়েছিলেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষপূর্তির উৎসব করার জন্য। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানী যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। ১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান পুরনো গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বারান্দায় সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। সনজীদা খাতুন ও ফরিদা মালিক রবীন্দ্রসঙ্গীত, বজলুল করিম তবলা, মতি মিয়া বেহালা ও সেতার এবং সোহরাব হোসেন নজরুলগীতি শেখাতেন। ওই সালেই ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১ বৈশাখ, ১৩৭০ বঙ্গাব্দে ওস্তাদ আয়তে আলী খান এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন। কেবল সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরং দিনে দিনে দেশের সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের সহায়ক কেন্দ্রের রূপ লাভ করছে ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন। বাঙালীর শাশ্বত সংস্কৃতিরূপ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে ছায়ানট পরিবেশিত অনুষ্ঠানমালা জাতির প্রাণে জাগায় নতুন উদ্দীপনা, সঙ্গীত-সংস্কৃতির চর্চা-সূত্রে জাতিসত্তার চেতনা বলবান হতে থাকে। ছায়ানটের উদ্যোগে জাতির শৈল্পিক ও মননশীল মেধার সম্মিলন ও অনুশীলন জাতিকে যোগায় বিকাশের বিবিধ অবলম্বন। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদ-কর্মী, বিজ্ঞানী, সমাব্রতী ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধনে পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা। সৃজনের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়েছিল ছায়ানটের প্রতিরোধী ও সর্বোপরি সংস্কৃতি-সাধনা। বাংলা নববষের প্রভাতী সঙ্গীতায়োজনের সুবাদে ছায়ানট বাঙালিত্বকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে স্বভূমিতে, স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনে যা হয়ে ওঠে প্রেরণাদায়ক। ইংরেজী ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১ বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ছায়ানট সব দুর্যোগ দুর্বিপাকে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাজটি ছায়ানটের দায় এবং ঐতিহ্যগত। ষাটের দশকের আরম্ভে দেশের দক্ষিণোপকূলে গোর্কি আঘাত হানার পর কোন সরকারী সাহায্য ছাড়া উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ছায়ানট। গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষামিছিল করে পথচারী, রিক্সাচালক, মায় ভিখারীদের কাছ থেকে পাঁচ পয়সা দশ পয়সা করে নিয়েও জমেছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে সংগ্রহের অনেকাংশ দুর্যোগকালের আশ্রয়স্থল, দুটি বিদ্যালয় ভবন উন্নয়নের জন্য দেয়া হয়। এরপর ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাস ও উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এবং পরবর্তীকালে যতবারই দেশ সিডর ইত্যাদি কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত হয়েছে ততবারই ত্রাণ নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এ সংগঠন। সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘ছায়ানট’ ভারত সরকারের ‘টেগোর এ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমনি’ পেয়েছে। একটি মূল্যবান সম্মাননা স্মারকের সঙ্গে বাংলাদেশের ছায়ানটকে দেয়া হবে নগদ এক কোটি রুপি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন একটি জুরি বোর্ড বাছাই করেছে ছায়ানটকে। তিনি এই জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মদিন স্মরণ করতে প্রতিবছর পুরস্কারের প্রবর্তন করে ভারত সরকার। ২০১৫ সালের ‘দ্য টেগোর এ্যাওয়ার্ড ফর কালচারাল হারমনি’ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে ছায়ানট। ২০১২ সালে এই পুরস্কার প্রথম দেয়া হয়। প্রথম পুরস্কারটি দেয়া হয় পণ্ডিত রবি শংকরকে। ২০১৩ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন জুবিন মেহতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার টুইটারে টুইট করে বলেছেন, ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, ছায়ানট বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও অংশ ছিল যখন পূর্ব পাকিস্তানের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এটি সঙ্গে যুক্ত সবাইকে অভিনন্দন। ২০০১ সালে এই ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালীন হয়েছিল ভয়াবহ বিস্ফোরণ। তাতে মৃত্যু হয় কম করে ১০ জনের। জখম হয়েছিলেন অনেকে। এই নাশকতায় জড়িয়ে যায় হরকত উল জিহাদি বাংলাদেশ (হুজি-বি) জঙ্গীগোষ্ঠী। বারে বারে এই জঙ্গী সংগঠন বাংলাদেশে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সেই রক্তাক্ত ঘটনার পরেও ছায়ানট তার সুস্থ সাংস্কৃতিক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
×