ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১ নভেম্বর ২০১৮

উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী

শুরুটা ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেনের নেতৃত্বে। এরপর রনেশ দাশগুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মনজুরুল আহসান খান, রাজিয়া বেগম, তাজিন সুলতানা, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখের হাত ধরে দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে উদীচী পা দিল ৫০ বছরে। লক্ষ্য ছিল আর্থ-সামাজিক শোষণ, বৈষম্য, মৌলবাদ, ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শৈল্পিক প্রতিবাদের। শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই সাংস্কৃতিক পরিম-লে এক প্রতিবাদের নাম হয়ে ওঠে উদীচী। কেবল আন্দোলন সংগ্রাম আর গণমানুষের কথা বলাতেই নয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদীচী হয়ে উঠেছে সুস্থ ধারার বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম লালন কেন্দ্র। সাংস্কৃতিক অঙ্গন কিংবা গণজাগরণই নয় দুর্যোগ, দুর্বিপাকে অসহায় মানুষের পাশে মানবিক সহায়তা নিয়েও দাঁড়িয়েছে উদীচী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদ জাগরণে উদীচীর ভূমিকাকে স্মরণ করতে হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১ সালে বাঙালীর সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী গড়ে তোলে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় উদীচীর কর্মীরা। তাদের পরিবেশনা ‘শপথ নিলাম’, ‘আলো আসছেই’, আজ ইতিহাসের অংশ। স্বাধীনতার পরও একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন ধারণ করে পথ চলেছে উদীচী। সংগঠনটির শুরু হয়েছিল উত্তর ঢাকার নারিন্দার একটি বাসায়। উদীচী শব্দের অর্থ উত্তর দিক। রবীন্দ্রনাথের একটি বাড়ির নামও ছিল উদীচী। এসব মিলিয়েই নামকরণের অনুপ্রেরণা। তবে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেন উদীচী নামকরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘উত্তরে থাকে ধ্রুবতারা। সেই ধ্রুবতারা লক্ষ্য করেই রাতের আঁধারে নাবিকরা ঠিক করে নিত তাদের গন্তব্য। সেটাই উদীচী নামকরণের তাৎপর্য।’ সত্যেন সেনের ব্যাখ্যায় এটি পরিষ্কার, শুরু থেকেই উদীচী নিতে চেয়েছে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। আর উদীচী কর্মীদের নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছিল সত্যেন সেন রচিত সঙ্গীত ‘মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচিত গান/মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ।’ তবে শুধু গণসঙ্গীতেই সীমিত ছিল না উদীচীর পথ চলা, মঞ্চনাটক, নৃত্যের পাশাপাশি সক্রিয় চারুকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগও। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর দেশে বিদেশে মোট শাখার সংখ্যা ৩৭৬টি। ২০১৩ সালে পেয়েছে একুশে পদক। তবে উদীচীর এই পথচলা কখনই ছিল না মসৃণ। যাত্রা শুরুতেই পড়তে হয়েছে পাকিস্তানী জান্তা সরকারের রোষানলে, উদীচী কর্মীরা যেমনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংগ্রামে দিয়েছে প্রাণ, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরবর্তীকালে উদীচী কর্মীরা শিকার হয়েছেন দমন পীড়নের। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার উদীচী কর্মীদের মানবতার জয়গান গাইতে গিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে দুই দফা বোমা হামলায় ১০ জনের প্রাণ হারানো ও দেড় শতাধিক আহত হওয়া। এতসব বাধা উতরিয়ে উদীচী এ বছর পূর্ণ করল তার ৫০ বছর। ‘আঁধার বৃন্তে আগুন জ্বালো, আমরা যুদ্ধ আমরা আলো’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচী পালনের ধারাবাহিকতায় গত শনিবার শুরু হয় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৩ দিনব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী সমাপনী উৎসব। শনিবার সকালে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন সংগঠনের সাবেক ৫ সভাপতি পান্না কায়সার, হাসান ইমাম, অধ্যাপক যতীন সরকার, গোলাম মোহাম্মদ টিপু ও কামাল লোহানী। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। অনুষ্ঠাণে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন উদীচীর মূল সুর নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কাজ করা। মানবতার পক্ষে কাজ করা। এবং তারা সেটি অব্যাহত রেখেছে। উদীচী বহন করে চলেছে এ দেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতির শক্তিশালী ধারা। ভূমিকা রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছড়িয়ে দেয়ায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বের হয়। যা শেষ হয় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গিয়ে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার বাকি আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিল গণসঙ্গীত, সেমিনার, আলোচনাসভা। সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে উদীচী এরই মধ্যে জাতীয় সংস্কৃতিক সম্মেলন, সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব, জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা, নৃত্য উৎসব ও লোক সংস্কৃতি উৎসব পালন করেছে। উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও মুক্তচিন্তার বিকাশের জন্য কাজ করাই উদীচীর সার্থকতা। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পথ চলছে সংগঠনটি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন জানান গৌরব উজ্জ্বল ৫০ বছরকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যেই এই সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজন। এভাবেই মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে যাক উদীচী। যেভাবে শুরু থেকে করে আসছে সেভাবেই গণমানুষের প্রতিটি সংগ্রামে সাহস ও উদ্দীপনার হাতিয়ার হয়ে বেঁচে থাকুক উদীচী। সুবর্ণজয়ন্তীর এই শুভ লগ্নে উদীচীর কাছে জাতির এই প্রত্যাশা।
×